শ্যামলাল গোসাঁই
আপডেট: ১৭:৩৭, ২৩ জানুয়ারি ২০২৪
শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্য পুস্তকের একটি অধ্যায়ে শরীফ শরীফার গল্প নিয়ে দেশ জুড়ে তুমুল হৈচৈ চলছে। এই হৈচৈয়ে কেউ জেনে চেঁচাচ্ছেন আর কেউ বরের সাথে বরযাত্রী হিসেবে (না জেনেই) চেঁচাচ্ছেন। সারাদেশে গত দুইদিনে শরীফ শরীফার গল্পটি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তর্ক-বিতর্কের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। এর জের ধরে ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক বইটির ওই গল্পের পৃষ্ঠাগুলো ছিঁড়েছেন জনসম্মুখে! এরজন্য সাময়িকভাবে তাঁকে বহিষ্কারও করেছে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ। এখন আবার তাঁর বহিষ্কারাদেশ বাতিলের দাবীতে আন্দোলন করছেন সেই শিক্ষকপন্থি কিছু শিক্ষার্থী। সবমিলিয়ে সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবই থেকে শরীফার গল্পটি এখন জাতীয় ক্ষেত্রে আলোচ্য বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
শুরুতেই যে গল্প নিয়ে এতো কাণ্ড সেই শরীফার গল্পে কী লেখা আছে তা জানা দরকার। সংক্ষেপে বললে, বইটির মানুষে মানুষে সাদৃশ্য ও ভিন্নতা অংশে শরীফার গল্প নামে একটি গল্প আছে। সেই গল্পটি মূলত, সমাজের হিজড়া জনগোষ্ঠীকে নিয়ে। সেখানে শরীফ নামের একজন চরিত্র আছেন যিনি একটা সময় আবিষ্কার করেন শারিরীকভাবে তিনি ছেলেদের মতো হলেও, তাঁর মানসিক গঠন মেয়েদের মতো। অর্থাৎ, তিনি মনেমনে নিজেকে মেয়েরূপে আবিষ্কার করেন। এরপর ধীরে ধীরে তাঁর স্বভাব, চলাফেরা, খেলাধূলার মধ্য দিয়েও এই বিষয়টি পরিবারের চোখে ধরা পড়ে এবং তাঁরা শরীফ/শরীফাকে খারাপভাবে নেন। এরপর একদিন তাঁর দেখা হয় একজন মানুষের সাথে যিনি শরীফ/শরীফাকে জানান যে, আসলে সে একজন হিজড়া। ওই লোকটি শরীফকে হিজড়াদের সম্পর্কে অনেক তথ্য জানায়। যেমন তাঁদের একজন গুরু মা থাকে, তাঁরা কীভাবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে আনে।
ট্রান্সজেন্ডার বা রূপান্তরিত লিঙ্গের মানুষের ব্যাপারে শরীফ শরীফার গল্পে কিছু লিখা হয়নি। কারো আগ্রহ থাকলে সপ্তম বইয়ের আলোচিত গল্পটি নিজে পড়ে দেখতে পারেন। সেখানে শুধুমাত্র হিজড়া সম্প্রদায়কে নিয়ে একটি গল্প বলা হয়েছে। কিন্তু, এই গল্পে ট্রান্সজেন্ডার শব্দটি যোগ করে ছড়ানো হয়েছে। এটি যে করেছে তাঁকে গ্রেফতারের আওতায় নিয়ে আসা দরকার। এখনো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে বেশকিছু পাঠ্যপুস্তকের ছবি রয়েছে যেখানে ট্রান্সজেণ্ডার লেখা আছে। অথচ, এই শব্দটি সপ্তম শ্রেণীর বইয়ে ওই গল্পেই নেই।
তারপর একদিন শরীফাও নিজের মুক্তির জন্য বাড়ি ছেড়ে চলে যায় হিজড়া সমাজে। তাঁদের সাথে সে থাকতে শুরু করে। এবং সে মনে করে এখানে তাঁকে বাড়ির বা আত্মীয়স্বজনদের মতো কেউ কটু কথা বলে না। তবু, শরীফার মাঝেমাঝে তাঁর বাড়ির কথা মনে পড়ে। তাঁর বাবা-মায়ের কথা, ভাইবোনের কথা। কেননা, সেও একজন মানুষ। তাঁরও মানুষের মতো অনুভূতি আছে। তবে শরীফাদের মতো হিজড়ারা খুশি হয় যখন ২০১৩ সালে বাংলাদেশ সরকার হিজড়াদের সামাজিক স্বীকৃতি দেন। শরীফা এখন জানে, দেশে অনেক হিজড়া নিজ যোগ্যতার সফল হয়েছেন, পেশাগত জীবনে সাফল্য পেয়েছেন। শরীফাদের মতো অনেকেই এখন বাড়িতে বসে পড়াশোনা করে শিক্ষিত হচ্ছেন। এখন সবাই আর আগের মতো বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষের কাছ থেকে টাকা তুলে না।
মোটামুটি এই হচ্ছে সপ্তম শ্রেণীর পাঠ্যবইয়ে শরীফ শরীফার গল্প। এই গল্প নিয়ে সারাদেশে তুলকালাম কাণ্ড চলছে। ব্রাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক দোকান থেকে পাঠ্যবই কিনে বই থেকে ওই গল্পের দুই পৃষ্ঠা ছিঁড়ে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। অপরদিকে, তাঁর এহেন কর্মকাণ্ডের প্রতি ক্ষোভ জানিয়ে প্রতিবাদ করেছেন সচেতন সমাজের অনেকেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও চলছে পক্ষে-বিপক্ষে আলাপ।
কিন্তু, এখানে বিতর্কের মতো বা শিশু শিক্ষার্থীদের জন্য আপত্তিকর আছে এমন কিছুই আমি পেলাম না। এটিকে অন্য দশটি গল্পের মতোই মনে হয়েছে। যেখানে ব্যতিক্রম শুধু তৃতীয় লিঙ্গ হওয়াটা। এই গল্পের কথক বা মূল চরিত্র একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ। এ গল্পের তাঁর জীবনের ঘটনাগুলো তুলে আনা হয়েছে। এখানে আপত্তিকর অন্তত একটি শব্দও আছে বলে আমার মনে হয় না। বরং, এই গল্পে চেষ্টা করা হয়েছে সমাজে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের প্রতি আমাদের যে অবজ্ঞা তা কমানোর। এই গল্পে মূলত, একজন তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের স্বার্বিক কথাই বলা হয়েছে। যেটা আমরা খুবই সাধারণভাবে নিজেদের বেলা বা অন্যদের বেলাও লিখতে পারি।
প্রশ্ন হচ্ছে, তবু কেন শরীফ শরীফার গল্প নিয়ে দেশে এমন হইরই ব্যাপার ঘটছে? এর নেপথ্যে আছে আমাদের সামাজিক পশ্চাদপদতা। সেই সঙ্গে মনস্তাত্বিক পূর্ণ বিকাশের অভাব। প্রথম কথা, আমরা আমাদের সুদীর্ঘ অতীত কাল থেকে আমাদের সমাজে হিজড়া সম্প্রদায়কে যে চোখে দেখে এসেছি এখন হুট করে তাই তাদেরকে পাঠ্যপুস্তকের বিষয় হয়ে যেতে দেখে আমরা গ্রহণ করতে পারছি না। আমরা হয়তো কস্মিনকালে ভাবিনি, হিজড়াদের নিয়ে আমাদেরকে পাঠ্যপুস্তকে পড়াশোনা করতে হবে। কারণ, আমরা ধরেই নিয়েছি নারী আর পুরুষের বাইরে তৃতীয় লিঙ্গের কেউ সুস্থ সমাজের অংশ হতে পারে না! যদিও বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ এসব মানহীন চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। কিন্তু, আমরা পারছি না। পারছি না, কারণ, আমাদের চর্চার গণ্ডগোল।
হিজড়াদের সাথে আমাদের সামাজিক বৈষম্য এ ধরনের ঘটনার পেছনের অনেক বড় কারণ। যার ফলে, একজন শিক্ষকও সহজেই তাঁর জ্ঞানের বাতিক রেখে ধর্মের বাতিক থেকে বই ছিঁড়ে ফেলার মতো কাজ করতে পেরেছেন। আমাদের মতো পুরুষতান্ত্রিক সমাজে এই ভেদ বৈষম্য অনেকটাই স্বীকৃত। যেকারণে, শিক্ষক সমাজের অনেককেই এসব কাজ করতে দেখা যায় এখন।
কিন্তু, কথা হচ্ছে, এরকমটা কেন হচ্ছে? তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে সরকার ২০১৩ সালে সামাজিক স্বীকৃতি দিলেও, সামাজিক ভাবে আমরা সাধারণেরা যে এখনো তাদেরকে স্বীকৃতি দিতে পারিনি বা দিতে অনিচ্ছুক শরীফার গল্প নিয়ে এই বাজার গরম করা ইস্যু এর একটি বহিঃপ্রকাশ বলা যায়।
২.
আমাদের দেশের একটি পক্ষ আছে, এরা কোনোসময় বিজ্ঞানসম্মত কিছু স্বীকার করতে চায় না, কিন্তু, বিজ্ঞানের সব সুবিধাই গ্রহণ করে। এই পক্ষের লোকজন সবসময় বিজ্ঞানের সাথে নিজেদের ধর্মের এক অবোধ তুলনা করেন। এই সম্প্রদায় কখনো চায় না দেশে আধুনিক শিক্ষাক্রম চালু হোক। তাঁরা চায় পশ্চাদপদতা। তাঁরা অনেকেই প্রকাশ্যে বলে বেড়ায়, 'দেশে আফগানিস্তানের মতো শরীয়াহ শাসন থাকলে ভালো হতো।' শরীফ শরীফাদের গল্প নিয়ে সমস্যার নেপথ্যেও এই সম্প্রদায়ের মানুষজন। যারা, আসলে সবসময়ই আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থার বিরোধিতা করে এসেছে।
কিছুদিন আগে, নতুন শিক্ষাক্রমের আওতায় প্রাথমিকের শিক্ষকদের ট্রেনিং নিয়েও এই সম্প্রদায়ের মানুষ অনেক কিছু বলেছেন উল্টাসিধা। তাঁরা পাঠ্যবইয়ে কিশোর-কিশোরীদের বয়সঃন্ধিকালীন পাঠ নিয়েও আপত্তি তোলেছিলেন। তাঁদের মতে, এগুলো পাঠ্যপুস্তকে বিষয় নয়, এগুলো কেন আমাদের সন্তানরা স্কুলে গিয়ে শিখবে? তাঁদের ভাষ্যমতে, মেয়েলি ব্যাপার মেয়েরা বাসায় বসেই শিখতে পারে। এগুলো পাঠ্যবইয়ে নিয়ে আসাকে তাঁরা মনে করেন শিক্ষাক্রম নষ্ট করা!
সুতরাং, সহজেই অনুমেয় আমাদের দেশে শরীফ শরীফার গল্প নিয়ে এমন হৈচৈ কাণ্ড বেঁধে যাওয়া আসলে অস্বাভাবিক কিছু না। জাতিগতভাবে আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষই চান পশ্চাদপদতা। তাঁরা পাঠ্যপুস্তকে সত্য পড়তে, ব্যবহারিক জ্ঞান পড়তে লজ্জাবোধ করেন। এবং আরও বিপদের বিষয় হচ্ছে- এরকম শিক্ষক দিয়েই আমাদের শিক্ষার কাজ চলছে বহুদিন ধরে। এখন যখন সরকার শিক্ষার আধুনিকায়ন ও সময়উপযোগী করার উদ্যোগ নিয়েছেন, তখন আমাদের সেই পুরোনো পশ্চাদপদতার ক্ষতগুলো প্রকাশিত হচ্ছে। এটা নতুন কিছু নয়।
আই নিউজ/এইচএ
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ