মো. রাইহান হোসেন
রংপুরের নদী, তোমরা কি কোনো কথা কও?
তিস্তা-করতোয়া অববাহিকায় অবস্থিত উত্তরের এক অবহেলিত জনপদ রংপুর।
তিস্তা-করতোয়া অববাহিকায় অবস্থিত উত্তরের এক অবহেলিত জনপদ রংপুর। তিস্তার নদীবিধৌত এই অঞ্চলের রয়েছে প্রাণ ও জীবিকার সুদীর্ঘ এক ইতিহাস। অপার সম্ভাবনাময় রংপুর এক কৃষিনির্ভর এলাকা। এ অঞ্চল শিল্প তথা কৃষিশিল্প স্থাপনের দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছে। রংপুরকে বলা হয় উত্তরের খাদ্যভান্ডার। এখানে ধানের পাশপাশি আলুসহ নানা ধরনের সবজি উৎপাদন হয়। এ অঞ্চলে কৃষিভিত্তিক শিল্প বিকাশের সুবিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। সমগ্র রংপুর জেলায় জালের মতো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য নদী।
রংপুরের প্রাচীন রেকর্ড থেকে জানা যাচ্ছে, ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তা-করতোয়া অববাহিকায় যে ভয়াবহ বৃষ্টি ও বন্যা হয়েছে, সেটি এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড়ো ঘটনা হয়ে আছে। ওই বছরের ২৬শে মার্চ থেকে শুরু হওয়া বৃষ্টি একনাগাড়ে চার মাস চলেছিল। ফলে সৃষ্টি হয়েছিল বর্তমান সময়ের যমুনা নদী। তিস্তার ওই প্লাবনের ফলে বাংলাদেশের মধ্যাঞ্চলের (বৃহত্তর ঢাকা, ফরিদপুর, পাবনা) অনেক নদ-নদীতে পরিবর্তন ঘটে। হঠাৎ করেই প্রকৃতির এই বিরূপ আচরণে রংপুর বিভাগের তিস্তা-করতোয়া অববাহিকার ব্যাপক অঞ্চল প্লাবিত হয়ে যায়।
রংপুর শহরের পানিনিষ্কাশন ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে ঊনবিংশ শতাব্দীর সরকারি নথিপত্রে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য রয়েছে। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে রংপুর ছিল অস্বাস্থ্যকর, নিচু জলাশয় আর ঝোপঝাড়ে পরিপূর্ণ একটি শহর। ডা. কৃষ্ণধন ঘোষ (ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের নেতা অরবিন্দ ঘোষের পিতা) ছিলেন তৎকালীন রংপুর জেলার সিভিল সার্জন। তিনি রংপুর শহরের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ দূর করার উদ্দেশ্যে ১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে নিজ উদ্যোগে সাত মাইল দীর্ঘ একটি খাল খনন করেন। খালটি উত্তরের চিকলি ও কুকরুল বিল এবং শহর থেকে পাঁচ মাইল পশ্চিমে ঘাঘট নদের সঙ্গে সংযুক্ত করা হয়। এর ফলে ওই বিল দুটির অতিরিক্ত পানি এবং শহরের যাবতীয় তরল বর্জ্য এবং অতিরিক্ত আবদ্ধ পানি নির্গমনে সহায়ক হয়েছিল।
প্রায় একই সময়ে রংপুরে কর্মরত কালেক্টর মিস্টার স্ক্রাইন উদ্যোগ গ্রহণ করে শহরে আরেকটি খাল খনন করালেন। প্রথম খালটির নাম ঘোষের খাল এবং দ্বিতীয়টি স্ক্রাইনি খাল নামে পরিচিত। ১৮৯৭ খ্রিষ্টাব্দের প্রলয়ংকরী ভ‚মিকম্পে এই দুই খালের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পরবর্তী সময়ে ঘোষের খাল পুনঃখননের পর সেটি শ্যামাসুন্দরী খাল নামে পরিচিতি পায়। ডিমলার জমিদার এবং ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিকে রংপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান জানকী বল্লভ সেনের মায়ের নামে খালটির নাম রাখা হয়। ঘোষের খালটির উত্তর-পূর্ব দিকের অংশটি বর্তমানে কেডি খাল নামে পরিচিত। শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত খালগুলো চলমান থাকায় রংপুর শহরে জনস্বাস্থ্যের বেশ উন্নতি হয়।
১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বঙ্গ প্রদেশের যে পঞ্চবার্ষিক জরিপ হয়েছিল, তাতে রংপুর শহরকে সরকারিভাবে সমগ্র বিভাগের মধ্যে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর শহর হিসাবে আখ্যা দেওয়া হয়। পরিসংখ্যানে উল্লেখ রয়েছে, ১৯০৮ খ্রিষ্টাব্দে পুরো বঙ্গ প্রদেশের শহরগুলোতে প্রতি বর্গমাইলে বার্ষিক মৃত্যুর গড় হার ছিল ২৪ দশমিক ১ জন। আর রংপুর শহরে প্রতি বর্গমাইলে যা ছিল ১৯ দশমিক ৯ জন। রংপুর শহরে প্রাকৃতিক ও কৃত্রিম প্রবাহ মিলে মোট সাতটি নদী ও খাল রয়েছে। এগুলোর মধ্যে প্রাকৃতিক প্রবাহ বা নদ-নদী হলো ঘাঘট, খোকশাঘাঘট, ইছামতী, বুরাইল ও আলাইকুমারী। কৃত্রিম প্রবাহ দুটি হচ্ছে শ্যামাসুন্দরী ও কেডিখাল। পানি নির্গমনের এত বেশি প্রাকৃতিক ব্যবস্থা বাংলাদেশের অন্য কোনো জেলা শহরে নেই। প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে রংপুর শহরের পানি নির্গমন ব্যবস্থাপনা ষোলো আনা ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশে এর কারণ খুঁজতে বেশি দূর যেতে হবে না। বাংলাদেশের প্রতিটি মহানগর, জেলা ও উপজেলা শহরের মধ্য দিয়ে কিংবা আশপাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে কোনো না কোনো নদী বা খাল। শহরের যাবতীয় তরল বর্জ্য ছোটো-বড়ো নর্দমা ও খালের মাধ্যমে নদীতে গিয়ে পড়ছে। এই নদ-নদীগুলো আগের চেহারায় এখন আর নেই। চিরবহতা বাংলাদেশের অধিকাংশ নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়েছে এবং ভরাটের পর্যায়ে রয়েছে। এই অবস্থা সৃষ্টির প্রধান কারণ শতাধিক অভিন্ন নদীর পানি একতরফাভাবে প্রত্যাহার, যেটি ঘটে চলেছে দীর্ঘ চার দশক ধরে। ফলে এগুলোর এখন আর ক্ষমতা নেই হঠাৎ করেই বৃষ্টি বা বন্যার অতিরিক্ত পানি ধারণ করার।
রংপুর শহরের নিষ্কাশন ব্যবস্থার যে চিত্র, একই অবস্থা বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি শহরের। এটি এক দিনে ঘটেনি। উন্নয়ন আর নগরায়ণের নামে বিগত প্রায় চার দশকের মধ্যে বাংলাদেশের শত শত শহর-বন্দরে কত হাজার হেক্টর মৃত নদ-নদী, খাল ও জলাভূমি ভরাট করে প্রকৃতিকে ভারসাম্যহীন করে ফেলা হয়েছে, এর সঠিক হিসাব আমাদের জানা নেই। এর পাশাপাশি বন্যা নিয়ন্ত্রণের নামে নদীর উৎসমুখ চিরতরে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অপরিকল্পিত শত শত রেগুলেটর, স্লুইসগেট, ক্রস ড্যাম, রাবার ড্যাম ইত্যাদি স্থাপনা করে প্রবহমান নদীকে মেরে ফেলা হয়েছে। নগরায়ণ, শিল্পায়ন তথা উন্নয়নের নামে স্রোতস্বিনী নদ-নদীসহ প্রায় বিলুপ্ত অসংখ্য নদী ভরাট করা হয়েছে। এরূপ অপরিণামদর্শী কর্মকাণ্ড এখনো অব্যাহত রয়েছে। নগরায়ণ ও শিল্পায়নের দোহাই দিয় যখন যেভাবে খুশি গড়ে তোলা হচ্ছে অবকাঠামো। এতে করে ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে চিরায়ত প্রকৃতি-পরিবেশ এবং প্রতিবেশের জীবনীশক্তি।
বাংলাদেশের প্রায় প্রতিটি জেলা শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হতো স্রোতস্বিনী নদী বা খাল। প্রতিটি শহর-বন্দর ঘিরে ছিল নদী, খাল, বিল হাওরসহ উন্মুক্ত জলাশয়। ছিল বুকভরে নিশ্বাস নেওয়ার মতো উন্মুক্ত প্রান্তর। সেই বাতাবরণ এখন আর নেই। তথাকথিত উন্নয়নের লাগামহীন ঘোড়া ছুটে চলেছে অবিরাম গতিতে। আগের চেয়ে পানির ব্যবহার বেড়েছে অনেক গুণ। স্বাভাবিকভাবে শহরের মধ্যে নির্মিত পাকা নর্দমা দিয়ে তরল বর্জ্য প্রবাহের মাত্রাও বৃদ্ধি পেয়েছে। হঠাৎ করেই অতিবর্ষণ শুরু হলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই জনজীবন প্রায় স্তব্ধ হয়ে পড়ে। শহরের পানি গড়িয়ে যেতে সময় নেয় কয়েক ঘণ্টা কিংবা দু-তিন দিন।
নদী দূষণ, জলাবদ্ধতার পাশাপাশি রংপুর অঞ্চলের আরেকটি বড়ো চ্যালেঞ্জ হলো খরা প্রবণতা। পরিবর্তিত জলবায়ু ও কৃষিতে এর প্রভাবের ফলে খাদ্য উৎপাদন ও খাদ্য নিরাপত্তার ওপর পরিবর্তিত জলবায়ুর প্রভাব সারা বিশ্বে প্রতীয়মান হচ্ছে। তবে বাংলাদেশের ওপর এর প্রভাব অতি গভীর। বর্ধিষ্ণু জনসংখ্যার কারণে আমাদের কৃষি ইতোমধ্যেই বেশ চাপের সম্মুখীন। এর সাথে পরিবর্তিত জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব এটিকে আরও নাজুক অবস্থার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। কৃষির সাথে আবহাওয়া ও জলবায়ুর সম্পর্ক অত্যন্ত নিবিড়। বিশেষ করে বাংলাদেশের পরিপ্রেক্ষিতে এ সম্পর্ক আরও গভীর। জলবায়ু যেহেতু দীর্ঘ সময়ের, তাই এর ভিত্তিতেই কোনো এলাকার কৃষি-সংস্কৃতি গড়ে উঠে। প্রতিটি ফসলের জন্য নির্দিষ্ট সুবিধাজনক আবহাওয়াগত পরিস্থিতির প্রয়োজন। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে আবহমান কালের চিরচেনা ঋতুর আবর্তন অনেকটা অনিয়মিত হয়ে গেছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়ছে আমাদের কৃষি সংস্কৃতির ওপর।
রংপুর অঞ্চল তেমন শিল্পপ্রধান না হলেও দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ছোঁয়া লেগেছে এখানেও। বিভিন্ন কৃষিপ্রধান শিল্প যেমন রাইস মিল, হিমাগারের পাশাপাশি নানা শিল্পকারখানা, ইটভাটা গড়ে উঠছে সময়ের দাবি মেটাতে গিয়ে। এদিকে ক্রমবর্ধমান শিল্পায়ন, নগরায়ণের ফলে বাড়ছে পরিবেশ দূষণ। বায়ু দূষণের পাশাপাশি মাটি দূষণ, শব্দ দূষণ এবং পানি দূষণও বাড়ছে একে অপরকে পাল্লা দিয়ে। তিস্তা শুকিয়ে তার নাব্যতা হারিয়ে ফেলার উপক্রম, শ্যামাসুন্দরীও আজ মরা খালে পরিণত হয়েছে। দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত রংপুরের শ্যামাসুন্দরী খাল। ময়লা আবর্জনার ভাগাড় এখন এককালের স্বচ্ছসলিলা এ জলাধার। তলদেশ ভরাট হয়ে যাওয়ায় একটু বেশি বৃষ্টি হলেই উপচে পড়ে শ্যামাসুন্দরী। তৈরি হয় জলাবদ্ধতা। মাটি ভরাটে এখন মৃতপ্রায় রংপুরের আরেক ঐতিহ্যবাহী শালমারা নদী। উন্নয়নের পিছু ছুটতে গিয়ে আমরা অরণ্যকে গ্রাস করে নগর গড়ছি। অথচ পরিবেশের এই সামগ্রিক বিপর্যয় মোকাবিলা করে উন্নয়নকে এগিয়ে না নিলে তা টেকসই হবে না।
জীবনানন্দ দাশ লিখেছেন, ‘নদী, তুমি কোন কথা কও?’ সেখান থেকেই এ লেখার শিরোনাম। নদীর আক্ষরিক কোনো ভাষা না থাকলেও কারও কারও কাছে যেন নদীর ভাষা আছে। কবির পক্ষে হয়তো সেই ভাষা বোঝা সহজ। নদীর সেই কথা শোনা গেলে এক সময়ের স্রোতস্বিনী নদীর দূষণে পচে-গলে যাওয়ার চাপাকান্না শুনতে পেত মানুষ। কিশোর কবি সুকান্তের ভাষায় বলতে চাই— ‘এ বিশ্বকে শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি, নবজাতকের কাছে এ আমার অঙ্গীকার।’ এই দেশকে আমাদের এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে, আমাদের শিশুরা যেন সুন্দরভাবে বাঁচতে পারে, চলতে পারে, উন্নত জীবন পেতে পারে আর শিক্ষা দীক্ষায় সুস্বাস্থ্যের অধিকারী হয়। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর যেমন তার কাব্যে লিখেছেন, ‘আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে’, তেমনি আকুলতায় বলতে চাই আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন থাকে সুন্দর পরিবেশে।
লেখক: মো. রাইহান হোসেন, সহকারী পরিচালক, পরিবেশ অধিদপ্তর, রংপুর বিভাগীয় কার্যালয়
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ