আলমগীর শাহরিয়ার
একজন আনিসুল হক ও “কখনো আমার মাকে”
একজন আনিসুল হক ও “কখনো আমার মাকে”।
লেখক আনিসুল হককে দেখলাম অনেকে ঈর্ষা করেন। করাই স্বাভাবিক। প্রথমেই বলে নিই তাঁর সাথে আমার খুব ব্যক্তিগত বা অন্তরঙ্গ সম্পর্ক নেই। সেটা জরুরিও নয়। তাঁর লেখালেখি ও সৃষ্টির সঙ্গে আমার পরিচয় আছে। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের একান্ত সচিব হিসেবে কাজ করার সময় স্যার আমাকে ‘আলোর ইশকুল’-এর একটি বিজ্ঞাপন দিয়ে আনিসুল হকের কাছে পাঠালেন প্রথম আলো অফিসে।
আনিস ভাইকে ফোন দিয়ে গেলাম এবং সেদিন তাঁর সঙ্গে একটু আলাপ হলো। তার আগে যখন মানবজমিনে কাজ করি তখন একবার আলাপ হয়েছে বাংলা একাডেমির মিলনায়তনে। বইমেলায় সৈয়দ শামসুল হক থেকে আনিসুল হক—এমন অনেক লেখকের সঙ্গেই সেবার আলাপ করেছি, তাঁদের বক্তব্য নিয়েছি। বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে নানা উপলক্ষ্যে বার কয়েক আরও দেখা হয়েছে। এসব আনুষ্ঠানিক আলাপে ঠিক ব্যক্তিগত দারুণ কোনো সম্পর্ক গড়ে ওঠেনি। তাই সম্পর্কের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আনিসুল হক উত্তরবঙ্গের মানুষ। রংপুরে বাড়ি। তাঁর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মধ্যে একটা সারল্য আছে। সহজপ্রিয়তা আছে।
আনিসুল হকের পাঠকপ্রিয়তা ঈর্ষনীয়। বইমেলায় প্রথমা প্রকাশনীর স্টলে তাঁর অটোগ্রাফের জন্য ভিড় দেখলে টের পাওয়া যায়। হুমায়ূন আহমেদের পর জাফর ইকবাল ছাড়া বইমেলায় দীর্ঘসময় পাঠকের কৌতূহলে থাকা লেখকও তিনি। ইমদাদুল হক মিলনও ছিলেন এক সময়। সম্প্রতি বসুন্ধরা গ্রুপ এবং তাদের ফরমায়েশি মিডিয়া তাঁকে একেবারে গিলে ফেলেছে। শেষ করে দিয়েছে। হয়তো তাঁর আর দেবারও কিছু নেই। তসলিমা নাসরিনও মেলায় বেশ সাড়া জাগিয়েছিলেন। নির্বাসনে যেতে বাধ্য না হলে তসলিমা নাসরিন মেলায় অন্যতম আকর্ষণ হিসেবে থাকতেন। টিএসসি থেকে এগোলেই দূর থেকে দেখা যেত ওই যে নির্মলেন্দু গুণ মেলায় হাঁটছেন। তখন মূল রাস্তার পাশেও স্টল বসতো। আশেপাশে তাঁর কাব্যানুরাগীদের ভিড়। আমি আর আমার বন্ধু দীন মহসিন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে মেলায় যেয়ে দশ টাকা নিয়েছিলাম গুণদার কাছ থেকে টিএসসিতে চা খাবার জন্য। এখন মেলায় প্রকৃত লেখককে ঘিরে পাঠকের ভিড়ের শূন্যতা প্রকট। ফলে প্রতিবছর মোটিভেশনাল স্পিকার, ক্যারিয়ারের বই, অপার্থিব জগতের ভয়ভীতি দেখানো বই, অনলাইন ভূঁইফোড় সেলিব্রেটিদের বই ও মওসুমী অলেখকরা আলোচনায় থাকেন।
যা হোক, এদেশে প্রচুর আলতু ফালতু লোকজন জনপ্রিয় হয় সেখানে একজন লেখকের জনপ্রিয়তা আনন্দের এবং উদযাপনের। লেখক ও শিল্পীরা একে অপরের সাফল্য প্রাণ খুলে উদযাপন করতে পারেন না। সহজে প্রশংসা করেন না। উলটো এক ধরনের হিংসা ও পরশ্রীকাতরতা সবসময় চোখে পড়ে। আনিসুল হকের মধ্যে এই ঈর্ষাকাতরতা খুব কম দেখেছি। তাঁর নিন্দুকদের তিনি উপেক্ষা করতে জানেন। এটা তাঁর একটা চারিত্রিক গুণ ও সাফল্য। সরাসরি তাঁর নিন্দুকদের তিনি জবাব দেন না। একই সঙ্গে বলা দরকার অনেকে মনে করেন, তিনি দেশের শীর্ষ একটি পত্রিকার প্লাটফর্মকে ব্যক্তিগত বিজ্ঞাপনে দৃষ্টিকটুভাবে কাজে লাগিয়েছেন এবং অভিযোগ আছে আনন্দবাজার গোষ্ঠীর মতো প্রথম আলোও তাদের সিন্ডিকেটের বাইরে কাউকে পাত্তা দেয় না। লেখক মনে করে না। তাদের বর্ষসেরা পুরস্কার নিয়েও বিতর্ক আছে। আনিসুল হক এই সিন্ডিকেটের পালের গোদা। সিন্ডিকেটের অভিযোগ অন্যায্য না হলেও পত্রিকায় তাঁর বিজ্ঞাপনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে সমর্থন করি। আমাদের দেশে কত আজেবাজে জিনিসের বিজ্ঞাপন হয় সেখানে একজন লেখকের বিজ্ঞাপন হচ্ছে এতে অখুশি হবার বা মন খারাপের কিছু নেই। তবে প্রথমার বাইরে অন্যান্য ভালো লেখক ও মানসম্পন্ন বইয়ের প্রচারও তাদের মাধ্যমে কাম্য।
যা হোক, আনিসুল হকের একটি বই আছে “মা”। আমার পড়া আনিসুল হকের প্রথম উপন্যাস। অমর একুশে বইমেলা ২০২৪-এ বইটির ১১০তম মুদ্রণ প্রকাশ হয়েছে। আমাদের সাহিত্য জগতে অনেক বড় একটি ঘটনা! আর কোনো উপন্যাসের শততমের বেশি মুদ্রণ প্রকাশ হয়েছে কিনা আমার জানা নেই। প্রকাশনা জগতে এটি উদযাপন করবার মতোই একটি ঘটনা। আনিসুল হকের 'মা' আমাদের মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি উপন্যাস। এর রসদ জীবন থেকে থেকে নেওয়া। লেখক এই বাস্তব কাহিনীর সন্ধান পান গেরিলা বীরমুক্তিযোদ্ধা ও নাট্যব্যক্তিত্ব নাসিরউদ্দিন ইউসুফ বাচ্চুর নিকট থেকে।
উপন্যাসের কাহিনী মুক্তিযোদ্ধা মাগফার আহমেদ চৌধুরী আজাদ এবং তার মায়ের জীবন নিয়ে । শহীদ আজাদের মা মোস্মামৎ সাফিয়া বেগম ছিলেন ঢাকার সবচেয়ে প্রভাবশালী ব্যক্তিদের একজনের স্ত্রী। মগবাজারে তাদের রাজসিক বাড়ি। তিনি আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নারী। তাই তার স্বামী যখন দ্বিতীয় বিবাহ করলেন, তখন তিনি তা মেনে নেননি। ছোট্ট আজাদকে নিয়ে শত বিলাসিতা আর প্রাচুর্যের আকর্ষণ উপেক্ষা করে নেমে এসেছিলেন নিজের গড়া যুদ্ধক্ষেত্রে। সেই যুদ্ধের তিনি ছিলেন সফল যোদ্ধা। অভাব অনটনকে পেছনে ফেলে নিজ হাতে তিনি মানুষের মত মানুষ করে তুলেছিলেন আজাদকে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের মেধাবী শিক্ষার্থী আজাদ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তার বন্ধুদের সাথে যুদ্ধে যোগ দেন। ঢাকায় ক্র্যাক প্লাটুনের একজন যোদ্ধা ছিলেন তিনি। এই গেরিলা দলটি তৎকালীন সময়ে “হিট এন্ড রান" পদ্ধতিতে বেশ কিছু সংখ্যক আক্রমণ পরিচালনা করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মধ্যে ব্যাপক ত্রাসের সঞ্চার করেন। ১৯৭১ সালের ২৯ আগস্ট পাকিস্তানি বাহিনী রেইড চালিয়ে ক্র্যাক প্লাটুন এবং সংশ্লিষ্ট অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিদের ধরে নিয়ে যায়। আজাদের বাড়িতেও রেইড হয়, আজাদ তার সহযোদ্ধাদের সাথে ধরা পড়েন।
পাকিস্তানিরা তাদের নির্মমভাবে নির্যাতন করে তথ্য জানতে চায়। প্রচণ্ড অত্যাচারের মুখেও তারা আজাদের মুখ থেকে কিছু বের করতে পারে না। তখন তার মাকে বলা হয়, ছেলে যদি সবার নাম-ধাম পরিচয় বলে দেয়, রাজসাক্ষী হয়; তবে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে। আজাদের মা থানায় ছেলেকে দেখতে যেয়ে বলেন উলটো। কিছুই যেন স্বীকার না করে। আজাদ বলে, মা ওরা অনেক টর্চার করে। দুদিন ধরে ভাত খাই না, পারলে কাল একটু ভাত নিয়ে এসো। মা পরের দিন আজাদের পছন্দের সব খাবার টিফিন ক্যারিয়ারে সাজিয়ে হাজির হন রমনা থানায়। কিন্তু ছেলের দেখা আর মেলে না। ইতোমধ্যে অন্যান্য সঙ্গীদের সঙ্গে আজাদকে অন্যত্র নিয়ে গেছে এবং হত্যা করেছে পাকবাহিনী। আজাদকে ভাত খাওয়াতে না পেরে আজাদের মা নিজে জীবনে আর কোনোদিনও ভাত খাননি। বিছানায় ঘুমোননি। যুদ্ধের ১৪ বছর পরে এই মা মারা যান নিঃস্ব অবস্থায়। জুরাইন কবরস্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।
মৃত্যুর আগে এই মা বলেছিলেন, আমার কবরে যেন লেখা থাকে স্বামী বা পিতার নাম নয় শুধু "শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আজাদের মা"। এমন অজস্র মায়েদের আত্মত্যাগে পাওয়া আমাদের এই দেশ। স্বাধীনতার মাস মার্চে কিংবা সারাবছর যে কোনো সময়ই এই বইটি আমাদের তরুণ প্রজন্মের সকলের পাঠ্য হোক। তারা জানুক কত রক্ত আর অশ্রুনদী পেরিয়ে পাওয়া এই স্বাধীনতা।
“কখনো আমার মাকে”— আনিসুল হকের নতুন একটি উপন্যাস। বইমেলায় এটিরও ১০ম মুদ্রণ প্রকাশ হয়েছে। একজন লেখক তাঁর সৃষ্টির সাফল্যে বেঁচে থাকুন। পরমায়ু লাভ করুন। অভিনন্দন লেখক আনিসুল হক। জন্মদিনে আপনাকে শুভেচ্ছা।
লেখক- আলমগীর শাহরিয়ার, লেখক ও সংবাদকর্মী
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ