শ্যামলাল গোসাঁই
নিয়মের ভেতরে-বাহিরে
নিয়মের ভেতরে-বাহিরে | প্রবন্ধ | শ্যামলাল গোসাঁই
'নিয়ম' এমন একটি নির্দেশিকা, যা আপনাকে আপনার মতো করে নয়, নির্দেশিত নিয়মানুযায়ী কোনোকিছু করতে বাধ্য করে। এবং অনেকে মিলে একটি কাজ এক নিয়মে একইভাবে করতে থাকেন। এতে করে সম্পাদনের কাজটি দশ জনের দশভাবে করার বৈচিত্র্যময় সম্ভাবনা কমে যায়। যদিও 'নিয়ম' সুন্দর আর সাবলিল দেখতে। কিন্তু, এটি মানুষের স্বভাববিরুদ্ধ এবং বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বার্থসিদ্ধ।
অনেকেই বলতে পারেন আমি 'নিয়ম'বিরুদ্ধ কথা লিখছি কেন। তাদের উদ্দেশ্যে বলবো, প্রতিটি বুদ্ধিসম্পন্ন মানুষের উচিৎ তাঁর সঙ্গে জড়িয়ে থাকা আনুষাঙ্গিক সবকিছু নিয়ে প্রশ্ন তোলা এবং এর জাত্যর্থ যাচাই করা। আমি এ লেখায় 'নিয়ম' বিষয়টির জাত্যর্থ নিয়ে কথা বলছি। আমাদের বুঝা দরকার ঐক্য এবং শৃঙখলার মধ্য দিয়ে কল্যান হাসিল করা যাবে কি না। 'নিয়ম' আমাদেরকে শৃঙখলিত করার বিপরীতে কোনো মানসিক উৎপীড়নের জন্ম দিচ্ছে কি না। যা আমরা প্রকাশ করতে চাই না। কিন্তু, আমাদের আচার-আচরণে প্রকাশ পায়।
নিয়ম কেন, কীভাবে গড়ে ওঠে। এটি কার্যকর কীভাবে হচ্ছে এবং এর ফলস্বরূপ আমরা কী হাসিল করছি, করতে না পারলে কেন হাসিল হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে। প্রয়োজনে নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়মের পথ খুঁজতে হবে। শাসকের পক্ষে লাভজনক নিয়মগুলোই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রথায় রূপ নিয়েছে। যে নিয়মগুলো কাজে এসেছে সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের। নিয়মের শিকার সবথেকে দুঃখী প্রাণীটির নাম বললে নারীর কথা বলতে হয়। বাংলাদেশে নারীদের জন্য এমন সব নিয়ম আছে যা তাঁদের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে।
কিছু সহজ বিষয় নিয়ে লিখলে বুঝতে সুবিধা হবে। দুই হাত তোলে মোনাজাত করা মুসলিম ধর্মের 'নিয়ম'৷ হিন্দু ধর্মের অনেক নিয়মের একটি 'নিয়ম' ঠাকুরকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ। কিন্তু, যৌক্তিকতা এবং ধর্মগুলোর ঘোষণা বলছে, এমন নয় নিয়মের বাইরে গিয়ে আপনি দুই হাত না তোলে শুধু আকাশের দিকে মুখ তোলে মোনাজাত করলে আল্লাহ শুনবেন না। বা ঠাকুরকে পুষ্পার্ঘ্যর বদলে কচুর লতি দিয়ে অর্ঘ্য দিলে তিনি তা ঠেলে ফেলে দেবেন। যেহেতু ধার্মিকরা বলেন, আল্লাহ মানুষের সব অবস্থার খবরই রাখেন এবং ঠাকুরও সর্বজায়গায় বিরাজমান। তাহলে হাত তোলে মোনাজত আর পুষ্পার্ঘ্য দেওয়াই আলাদা করে 'নিয়ম' হলো কেন? কারণ তা নাহলে, একেকজন একেকভাবে মোনাজাত করবে। একেকজন একেকভাবে ঠাকুরের আচারাদি পালন করবে৷ কেউ গান গেয়ে গেয়ে আল্লার কাছে মোনাজাত করবে। কেউ জবা পুষ্পের বদলে ঠাকুরকে কচুর লতি দিয়ে পূজা দিতে চাইবে। এতে ধর্মের কতৃত্ব হালকা হয়ে যাবে, সাম্প্রদায়িক ঐক্য ভেঙে পড়বে। তাই প্রয়োজন নিয়মের। কেননা, 'নিয়ম' একাধিক মানুষকে একই ছায়াতলে রাখতে পারে।
'নিয়ম' শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দের দিকে লক্ষ্য করলে এর জাত্যর্থ সম্পর্কে কিছুটা আভাস পাওয়া যায়। ইংরেজি rule শব্দটিকে নিয়মের সবথেকে কাছাকাছি শব্দ হিসেবে ধরা যায়। এই শব্দকে বাংলায় ভাঙলে আপনি যে শব্দগুলো পাবেন তা হচ্ছে- নিয়ম, বিধি, বিধান, রীতি ইত্যাদি। এই শব্দগুলোর জন্মেই লেগে আছে কতৃত্ব বা নিয়ন্ত্রণ করার স্পর্শ। সেটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই আবার ধর্মপ্রধান। কেননা, 'নিয়ম' মানুষের আদি চর্চাগুলোর একটি। আর ধর্ম মানুষের আদিতম চর্চার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্র। তাই অনুমানে বলা যেতে পারে, 'নিয়ম' সৃষ্টির সাথে ধর্মের একটা নিগুঢ় সম্পর্ক রয়েছে। যদিও বর্তমানে এটি বিজ্ঞান, ধর্ম, কর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি সবকিছুতে ছেয়ে গেছে। কিন্তু, নিয়মের শুরুটা ধর্মের হাত ধরে। এর প্রমাণ হিসেবে ধর্মগ্রন্থগুলো পড়া যেতে পারে। যে বইয়ের বেশিরভাগ অংশেই আসলে রচনা করা হয়েছে কোনো গোষ্ঠীকে ঐক্যবন্ধনের ভেতর দিয়ে কতৃত্বের শিকার বানানোর পন্থা। যাকে 'নিয়ম' বা ধর্মীয় বিধিবিধান বলা হচ্ছে।
খেয়াল করলে দেখবেন— মানুষ সুযোগ পেলেই 'নিয়ম' ভঙ্গ করে। বস্তুত, মানুষ নিয়মের মধ্যে থেকেও অনিয়ম করে। এমন নয় শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই অনিয়ম করে বেড়ান। সকল মানুষ পদে পদে নিয়মভঙ্গ করে। এর কারণ, আমরা নিয়মের বাইরে মুক্তভাবে বিচরণ করেছি কয়েক হাজার বছর। নিয়মগুলো সেদিনের মস্তিষ্কপ্রসূত আবিষ্কার। তাই এখনো নিয়ম আমাদের অভ্যাস হয়ে উঠতে পারেনি। আমরা অনিয়মের অভ্যাসপ্রসূত প্রাণী হয়ে আছি। নিয়মের চাইতে অনিয়মকে মানুষ সহজ মনে করে৷ আপন মনে করে। এই প্রবৃত্তিগুলো স্বাভাবিক। দোষের নয়। একটি পাখি পায়খানা করার সময় আমাদের মতো টয়লেটে যাওয়ার 'নিয়ম' মানছে না। আপনার কাছে এটি একটি অসুন্দর কাজ মনে হতে পারে। বাস্তবতা হচ্ছে, এতে তার এবং পৃথিবীর কোনো সমস্যা হচ্ছে না। কিন্তু, মানুষ সকালে মুখ ধোয়া থেকে শুরু করে রাতে শুতে যাওয়ার আগ পর্যন্ত প্রতি কাজে 'নিয়ম' পালনে দীর্ঘ সময় ব্যয় করছে। তারপরও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। পৃথিবীর, রাষ্ট্রের, সমাজের দুর্ভোগ বেড়ে চলেছে। তবে কী পৃথিবীতে তৈরি আমাদের এতো নিয়ম কোন কল্যানকর কাজে আসছে না?
এখানেই প্রশ্ন ওঠে, নিয়মের মাধ্যমে কি কল্যান হাসিল করা সম্ভব? নিয়ম আমাদের বাহ্যিক কার্যাবলিকে ঝকঝকে করছে বটে; মনের অন্ধকার, অজ্ঞতা, সামাজিক অবক্ষয়, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা দূর করতে পারছে না। মানুষ নিয়মানুবর্তী হয়েও পৃথিবীর জন্য হানিকারক হিসেবে আজ বিবেচিত। অন্যদিকে কুল কায়নাতের বাকি সব প্রাণী নিয়মের তোয়াক্কা না করেও (যাদের আমরা নির্বোধ উপাধী দিয়েছি) পৃথিবীর জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠেনি। তাহলে নিয়ম নামক বিষয়টি মানুষের কোন কাজে লাগছে? আমি বলব স্বার্থের কাজে। আমরা স্বার্থের জন্যই নিয়ম বানিয়েছি। আমরা হাত তোলে মোনাজাতের নিয়ম যেমন ধর্মের স্বার্থে বানিয়েছি। আমরা সামাজিক স্বার্থে বিয়ে, অর্থনৈতিক স্বার্থে বিনিময়ের নিয়ম বানিয়েছি, সংঘবদ্ধকরণের স্বার্থে ধর্মপালনের নিয়ম বানিয়েছি। এর সবই স্বার্থসাধন। নিয়ম যে সাধনকে করেছে শৃঙখল, ঐক্যবদ্ধ। আর সম্ভাবনাকে করেছে মলিন।
নির্দিষ্ট নিয়ম দিয়ে ঐক্য আসে, শৃঙখলা আসে। কল্যান আসবে কি না তার গ্যারান্টি নেই। একই নিয়মের আওতায় থাকা দুই জন একে অন্যের কল্যান নাও চাইতে পারেন। ঐক্য আর কল্যান এক নয়। ঐক্য কল্যানকর হবে কি না সেটি নির্ভর করে কারা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন তাদের উপর। কোন কোন নিয়মে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন তার উপর নয়। বাটপার, দুর্নীতিবাজ, নির্লজ্জ, জঙ্গীদের ঐক্য সুস্থ মানুষের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কিন্তু, তাই বলে তারা কল্যানকর নয়। তাদেরকে ঐক্যবদ্ধ করেছে কিছু নিয়ম। তথাপি, তারা সমাজের জন্য হুমকিস্বরূপ। সুতরাং, বোঝা যাচ্ছে নিয়ম কল্যান বয়ে আনে না। ঐক্য গড়ে তোলতে সাহায্য করে, শৃঙখলিত করতে পারে। এই ঐক্য ঘুষখোরদের হতে পারে, সুদখোর, ভূমিখেকোদের হতে পারে। ধর্মান্ধদের হতে পারে, শিক্ষিতদেরও হতে পারে৷ কিন্তু, জ্ঞানীদের সম্ভাবনা কম। যিনি জ্ঞানী, বিবেকবুদ্ধি ব্যবহার করতে জানেন এবং যিনি কল্যানব্রতী,— তাকে অন্য কতৃক নির্দেশিত নিয়ম রক্ষা করে জীবন যাপন করতে হয় না। কেননা, তিনি প্রশ্ন তোলতে জানেন এবং উত্থাপিত প্রশ্নের সূত্র ধরে নতুন প্রশ্ন করার পথ সুগম করে দিতে জানেন। নিয়ম, বিধিবিধান, Rule- দীর্ঘদিন পালিত হয়ে আসলে প্রথার রূপ নেয়। তখন এটিকে স্বার্থসিদ্ধির কাজে ব্যবহার করা হয় বেশি। বেশি ব্যবহার করেন রাজনীতিবিদ, আইনপ্রণেতা, এজেন্ট অব গডেরা সর্বোপরি শোসকরা। শাসিত শুধু নিয়ম পালন করে যায়।
তাহলে কি আপনি নিয়মানুবর্তী হবেন না? আপনাকে বুঝতে হবে আপনি যে কাজটি করতে যাচ্ছেন সেটিতে আদৌ কোনো নির্দেশিত নিয়মের প্রয়োজন আছে কি না৷ আপনি একজন দুস্থকে সাহায্য করতে চাইলে নিয়মের বালাই খুঁজতে হবে না যদি আপনার অবস্থা সাহায্য করার মতো থাকে। কেননা, একজন দুস্থকে সাহায্য করতে ভালো নিয়মের চাইতে কল্যানকামী মন থাকা বেশি জরুরি।
এই নাতিদীর্ঘ লেখার লক্ষ্য নয় কাউকে নিয়মবিমুখ করে তোলা। বরং, যেই নিয়মটি কল্যানের চেয়ে অকল্যান বয়ে আনছে বেশি সেই নিয়মগুলো নিয়ে প্রশ্ন তোলা আমার লেখার উদ্দেশ্য। লেখায় মূলত, দেখাতে চেয়েছি নিয়ম কেন, কীভাবে গড়ে ওঠে। কিন্তু, এটি কার্যকর কীভাবে হচ্ছে এবং এর ফলস্বরূপ আমরা কী হাসিল করছি, করতে না পারলে কেন হাসিল হচ্ছে না তা নিয়ে প্রশ্ন তুলতে হবে। প্রয়োজনে নিয়ম ভেঙে নতুন নিয়মের পথ খুঁজতে হবে। শাসকের পক্ষে লাভজনক নিয়মগুলোই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি প্রথায় রূপ নিয়েছে। যে নিয়মগুলো কাজে এসেছে সমাজের মুষ্টিমেয় মানুষের। নিয়মের শিকার সবথেকে দুঃখী প্রাণীটির নাম বললে নারীর কথা বলতে হয়। বাংলাদেশে নারীদের জন্য এমন সব নিয়ম আছে যা তাঁদের অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে। আইন প্রশাসনে এমন সব নিয়ম তৈরি করা হয়েছে যা মানুষের বাক স্বাধীনতা কেড়ে নিয়েছে। নির্বাচন ব্যবস্থায় এমন নিয়ম তৈরি করা হচ্ছে যেখানে শাসক শ্রেণীর সুবিধা হয় এমনভাবে তা প্রণীত হচ্ছে। সুতরাং, আপনাকে নিয়ম নিয়ে প্রশ্ন তোলতে হবে।
নিয়ম তৈরি হয় মুষ্টিমেয় মানুষের মাধ্যমে। কিন্তু, তা বাস্তবায়িত হয় সমাজের বৃহত্তর অংশের উপর। তাই প্রত্যেক নিয়ম নিয়েই আমাদের সন্দেহ এবং প্রশ্ন তোলা উচিৎ। প্রশ্ন না তোললে, এর অগ্রহণযোগ্যতা বা গ্রহণযোগ্যতা কোনোটিই বোঝা সম্ভব নয়।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ