আলমগীর শাহরিয়ার
আপডেট: ২০:০৯, ৩ এপ্রিল ২০২৪
মূর্খের দেশে কিসের বিশ্ববিদ্যালয়— কারা বলে?
মূর্খের দেশে কিসের বিশ্ববিদ্যালয়— কারা বলে?
Two things are infinite: the universe and human stupidity”. ১৯৪১ সালে রবীন্দ্রনাথের মৃত্যুর আরও ছয় বছর পর সাতচল্লিশে দেশভাগ হয়। রবীন্দ্রনাথের জীবদ্দশায় ভারতবর্ষ কাঁটাতারে ভাগ হয়নি। একই ছিল। অভিন্ন ছিল দেশটি।
এক বছর দূরে থাক ছয় মাস আগেও গান্ধী, নেহেরু, জিন্নাহ, সোহরাওয়ার্দীরা জানতেন না যে ব্রিটিশরা ভারতবর্ষের স্বাধীনতা কিভাবে ঘোষণা করবে, আদৌ দেশভাগ হবে কিনা, সীমান্তরেখা কেমন হবে। সোহরাওয়ার্দী দেশভাগের বহু পরে গান্ধীজির সঙ্গে দাঙ্গা কবলিত এলাকাগুলোয় সম্প্রীতি সফর শেষে বাংলার রাজনীতির কেন্দ্র তাঁর প্রিয় শহর কলকাতা ছাড়েন এবং সাধের পাকিস্তানে তাঁর গঞ্জনা ও অপমানের দিন শুরু হয়। নামে মাত্র স্বপ্নের পাকিস্তানে প্রধানমন্ত্রী হলেও তাঁর কোনো অস্তিত্ব নেই আজ পাকিস্তানে। বরং ঢাকার বুকে তার নামে একটি উদ্যান আছে। মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল আছে। বাংলার রাজধানী শহর কলকাতা হাতছাড়া করার ক্ষতিপূরণ হিসেবে ৩৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাবার কথা ছিল। সে-ও আদায় করতে পারেননি সোহরাওয়ার্দী।
পাকিস্তানি মূর্খ শাসকশ্রেণি ভয় পেতো তাঁর দানবীয় সৃষ্টিশীলতা ও প্রতিভাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সগৌরবে সশ্রদ্ধ চিত্তে বাঙালির হৃদয়ের আসনে বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর গানকে করেছিলেন জাতীয় সংগীত। তবুও পাকিস্তানি ভাবধারার কতিপয় বাঙালি মুসলমান আজও তাঁকে আপন ভাবতে পারে না! তার ছবিতে এঁকে দেয় ক্রস চিহ্ন! মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের দোসর যাদের দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয় এই সংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার।
“মূর্খের দেশে কিসের বিশ্ববিদ্যালয়?” রবীন্দ্রনাথের ভাষা, ব্যক্তিত্ব আমাদের মতো এতো দুর্বল না, চটুল না, আটপৌরে না। হলে তিনি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ শিল্পী হতেন না। রাম-রহিমই থাকতেন। কেউ কেউ বলছেন দেশ বলতে এলাকা বুঝিয়ে থাকতে পারেন। দেশ না, “দ্যাশের বাড়ি”- কই? এমন প্রশ্ন সচরাচর বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের লোকজন করে থাকেন। আমাদের সিলেট অঞ্চলের লোকজনকেই এমন প্রশ্ন করতে দেখিনি। খুবই আঞ্চলিক দোষে দুষ্ট, দুর্বল ও খোঁড়া এই যুক্তি। রবীন্দ্রনাথের মনের ভাব, মুখের ভাষা বরিশাল-প্রভাবিত না। তবে পূর্ববঙ্গ রবীন্দ্রনাথের সত্তারই সমান। আলাদা বা বিচ্ছিন্ন কিছু নয়। রবীন্দ্রনাথের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা কলকাতায় হলেও যৌবনের কর্মক্ষেত্র, সৃজনক্ষেত্র পূর্ববাংলা অর্থাৎ বর্তমান বাংলাদেশকে কতোটা হৃদয়ে ধারণ করতেন, ভালোবাসতেন তার অসামান্য দলিল “ছিন্নপত্র” নামক পত্রসাহিত্যটি। পরতে পরতে তার উজ্জ্বল বর্ণনা। মূর্খের দেশে… এসব কথা যারা বলে তারা কোনোদিন কেউ বইটি পড়েছেন বলে মনে হয় না।
পূর্ববঙ্গে তাঁর পূর্বপুরুষের শুধু আদি বসতিই না তাঁর মাতুতালয়, শ্বশুরালয়; কন্যা বিয়ে দিয়েছিলেন বরিশালে। যৌবনের শ্রেষ্ঠ সময় কাটিয়েছেন পূর্ববাংলার শিলাইদহে, পতিসরে, সাজাদপুরে। তাঁর সৃষ্টিশীল জীবনে অসামান্য প্রভাব পূর্ববাংলার, নদী পদ্মার এবং নদী সংলগ্ন মানুষ, জনপদ ও প্রকৃতির। নিজের নোবেল পুরস্কারের সবটাকা খরচ করেছেন পূর্ববাংলার গরীব হিন্দু-মুসলমান কৃষকদের উন্নতির জন্য। ক্ষুদ্রঋণ তাঁরই ধারণা। ফেরত পাননি কানাকড়িও। ঋণের দায়ে উলটো বিপর্যস্ত হয়েছেন। ছেলেকে, জামাতাকে, বন্ধুপুত্রকে উৎসাহিত করেছিলেন আমেরিকা পাঠিয়েছিলেন ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে নয়, কৃষি বিষয়ে পড়তে যাতে পূর্ববাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজের উন্নতিতে কাজ করতে পারেন। বিদেশ থেকে আনিয়েছিলেন কৃষির আধুনিক যন্ত্রপাতিও।
ঢাকার জনসাধারণ থেকে সহস্র ক্রোশ দূরে দেয়াল-ঘেরা ঢাকার নবাব পরিবারসহ আশরাফ বাঙালির মুখের ভাষা যখন ছিল উর্দু, রাজভাষা ছিল ফারসি, ইংরেজি, হিন্দি তখন আতরাফ মুসলমান ও নিম্নবর্ণের হিন্দু চাষাভুষা বাঙালির ভাষিক পরিচয় বাংলাকে গৌরব দিয়েছেন, মহিমান্বিত করেছেন রবীন্দ্রনাথ। এই সেদিন জাদুঘর হবার পূর্বে ঢাকার আহসান মঞ্জিলে কোনো গরীব কৃষক প্রবেশের কথা কল্পনাও করেনি কোনোদিন। কিন্তু জমিদার রবীন্দ্রনাথ বৈষম্য হটিয়ে শিলাইদহে কুটিবাড়িতে একই শতরঞ্জিতে বসতে দিয়েছেন হিন্দু মুসলমানকে সমান আসনে। প্রথম নন-ইউরোপীয়ান এশিয়ান হিসেবে সাহিত্যে নোবেল জয় করে বিশ্বমঞ্চে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন বাংলাকে। উর্দু হরফে বাংলা চালু করতে চাওয়া পাকিস্তানি শাসকরা নিষিদ্ধ করেছিল তাঁকে। কিন্তু সূর্যকে কি কেউ নিষিদ্ধ করতে পারে? আটকাতে পারে তার সর্বগ্রাসী ও অন্তর্ভেদী আলো?
পাকিস্তানি মূর্খ শাসকশ্রেণি ভয় পেতো তাঁর দানবীয় সৃষ্টিশীলতা ও প্রতিভাকে। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু সগৌরবে সশ্রদ্ধ চিত্তে বাঙালির হৃদয়ের আসনে বসিয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথকে। তাঁর গানকে করেছিলেন জাতীয় সংগীত। তবুও পাকিস্তানি ভাবধারার কতিপয় বাঙালি মুসলমান আজও তাঁকে আপন ভাবতে পারে না! তার ছবিতে এঁকে দেয় ক্রস চিহ্ন! মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের দোসর যাদের দালাল আইনে গ্রেফতার করা হয় এই সংখ্যা ছিল ৩৭ হাজার। স্বাধীনতার পঞ্চাশ বছর পর উর্বর ফার্টিলিটির দেশে পাকিস্তানের এই দালালদের সন্তান-সন্ততির সংখ্যা কয়েক লাখ ছাড়িয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। রবীন্দ্রনাথকে অপমান করার আস্ফালন, বাগাড়ম্বর, ও মিথ্যাচার তারাই করে অবলীলায়। রবীন্দ্রনাথের মতো হিমালয়-হৃদয় নিয়ে তবু বলতে ইচ্ছে করে, “যাহারা তোমার বিষাইছে বায়ু, নিভাইছে তব আলো, তুমি কি তাদের ক্ষমা করিয়াছ, তুমি কি বেসেছ ভালো?”
লেখক: আলমগীর শাহরিয়ার, কলামিস্ট ও সংবাদকর্মী
লেখকের আরও লেখা পড়ুন-
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ