শ্যামলাল গোসাঁই
বাঙালী মুসলমানদের আলিম-উলামা সমাচার
বাঙালী মুসলমানদের আলিম-উলামা সমাচার।
বাংলাদেশের এক শ্রেণীর আলিম-উলামা, হুজুরদের দেখা মেলে। এরা সবসময় ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে নিজেদের স্বার্থে। ধর্মরক্ষার নামে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে এরা সাধারণ মুসলমানদের এরা ঠেলে ডিচ বিপদের দিকে। শান্তির বাণী নিয়ে আসা ইসলামের অনুসারী মুসলমানদের এরা সবসময় অশান্ত রাখতে চায়। কারণ, অশান্তি জিইয়ে রাখা গেলে মানুষকে শান্তির কথা বলে কাছে টানা যায়। তাই এরা চায় সাধারণ মুসলমানদের সবসময় অশান্তির মাঝে রাখতে।
যদিও এরা শুধু বাংলাদেশে নয়, পাকিস্তান, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান সব দেশেই স্ব স্ব পরিবেশে টিকে আছেন এবং কার্য চালিয়ে যাচ্ছেন। এদের মধ্যে অনেকে নামকরা হয়েছেন। যেমন বাঙালী মুসলমান সমাজে নামকরা হয়েছিলেন গোলাম আজম নামের একজন অধ্যাপক, দেলোয়ার হোসাইন সাঈদি, মতিউর রহমান নিজামী। এদের মধ্যে গোলাম আজম নাকি একবার ভাষণে বলেছিলেন- বিশ্বে একটিও সহীহ মুসলমান রাষ্ট্র নাই। বাংলাদেশকে তিনি শরিয়াভিত্তিক মুসলমান রাষ্ট্র বানাতে চেয়েছিলেন। সেই চেষ্টা করেছিলেন। সে চেষ্টা এখনও চলছে।
বাঙালী মুসলমানদের ধর্মীয় অভিভাবকদের সংখ্যা অনেক। এদেশে থরেবিথরে পীর, আলিম, উলামা মুর্শিদের দেখা পাওয়া যায়। সাধারণ মুসলমানরা দুইদিন পর পর যেসব বয়কট, আন্দোলনে নামেন এসবের নেপথ্যে থাকেন এই আলিম-উলামারা। এরা মুখে বলেন ইসলাম ধর্মের কথা, কিন্তু চর্চা করেন অনৈসলামিক বিষয়ের। ধর্ম রক্ষার নাম করে এরা ধর্মকে ব্যবহার করে যাচ্ছেন যেমন খুশি তেমন ভাবে। যদিও তাদের দাবি, তারা ইসলামের হেফাজতে নিয়োজিত এবং তাদের সব কাজ ইসলামের স্বার্থে। ইসলামের স্বার্থে এ শ্রেণীর আলিম-উলামারা ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের হাতে থলে আর রিসিট দিয়ে ছেড়ে দেন রাস্তায় রাস্তায়। বিভিন্ন মসজিদ, এতিমখানা নির্মাণের কথা বলে এই শিক্ষার্থীরা মানুষের কাছ থেকে টাকা এনে তাদের ওস্তাদদের হাতে তোলে দেয়। অথচ ইসলামে এ ধরনের ভিক্ষাবৃত্তির কোনো চর্চা নেই। তবু, তাঁরা বলবেন এভাবেই ইসলামের সেবা হয়। বাংলাদেশের মুসলমানদের মাঝে তাই এই চর্চা প্রকট৷ যেখানে সেখানে দেখা মেলে ইসলামের সেবায় চাঁদা আদায়কারী সদস্যদের। এই টাকা শেষমেশ কতোখানি ইসলামের সেবায় আসে তা সহজেই অনুমেয়। মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে ভিক্ষা তুলতেন বুদ্ধ ও তাঁর অনুসারীরা। অনেকে এ ধরনের ভিক্ষাকে বলেন মাধুকরী আহরণ। মানবসেবায় ভিক্ষা আহরণের চর্চা শুরু করেছিলেন বুদ্ধগামীরা৷ বাঙালী মুসলমান সমাজে বর্তমান আলিম-উলামা ও হুজুররা শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করছেন ধর্মের নামে অর্থ আহরণে।
কিছুদিন আগেও বলা হতো৷ মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার কারণ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া। এ কথা বর্তমান সময়ে খাটে না। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী এখন শিক্ষিত জাতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু, শিক্ষিত হবার পরও বাঙালী মুসলমান অগ্রসর হচ্ছে না। কারণ, তারা লাখ টাকা খরচা করে শিক্ষিত হবার পরেও মুরিদ হয় অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ পীর, আলিম-উলামা, হুজুরদের। একজন শিক্ষিত বাঙালী মুসলমান শিক্ষকও যখন পীরমুখী থাকেন তখন তাকে আর অগ্রসরতা বলা যায় না।
শুধু অর্থনৈতিক ব্যাপার নয়, বাংলাদেশে আলিম উলামারা নানানসময় নানান ফতোয়াও দিয়ে থাকেন। গান বাজনাকে হারাম বলে শুধুমাত্র এ অঞ্চলের আলিম-উলামারাই ফতোয়া দিয়েছেন। মুসলিম বিশ্বের অনেক দেশের গান বাজনার সমৃদ্ধ ইতিহাস আছে। এ অঞ্চলের মুসলমানদের নেই। আমরা সৌদি আরবের শেখদের হাতে তলোয়ার নিয়ে নিজস্ব আরব্য গান গাইতে দেখি, ইরানে সংগীতের সমৃদ্ধ ইতিহাস পাই, তালেবান ঘেরা আফগানদেরও আছে নিজস্ব সংগীতের ইতিহাস, পাকিস্তানের কাওয়ালি, গজল বিশ্ব জোড়া খ্যাতি পায়, উইঘুর মুসলমানরা নি র্যা ত নে র মাঝেও ধরে রেখেছে নিজেদের সাংগীতিক ঐতিহ্য। নেই শুধু এ অঞ্চলের বাঙালী মুসলমানদের গান গাইবার অধিকার। কারণ, এ অঞ্চলের ইসলামে নাকি বলা হয়েছে এটি হারাম। এই ব্যাখ্যা এসেছে এদেশের আলিম-উলামাদের মাধ্যমে। যা সরল-ধর্মভীরু আপামর মুসলমান মেনে নিয়েছেন বেহেশতের লোভ আর জাহান্নামের ভয়ে। এ শ্রেণীর হুজুর-আলিমরা আরও নানা বিষয়েও ফতোয়া দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে পাকিস্তানের পক্ষে ফতোয়া, রবীন্দ্রনাথের বিরুদ্ধে ফতোয়া এদের অতীত ইতিহাস৷ কিন্তু, বাঙালী মুসলমান আলিম-উলামাদের এই কথায় কথায় ফতোয়া দেওয়া বা স্বীয় স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করার ইতিহাসের শুরু ইসলামের প্রাথমিক সময় থেকেই।
খলিফা ওসমানের সময় থেকে ইসলাম নানা দোষে দুষ্টু হতে শুরু করে৷ কারবালায় আলীপূত্রকে হত্যার মধ্য দিয়ে ইসলামের শান্তি ও সাম্যের বাণী চিরতরে কলুষিত হয়। এই সময় থেকেই শুরু হয় ইসলামের দ্বিচারিণী স্বভাব৷ যেই জন্য দায়ী সেসময়ের মুসলমান স্বৈরাচারী শাসক ও তাদের মদদদাতা মুসলমান আলিম-উলামারা। এই আলিম- উলামারা শুরুতে কোরানের ব্যাখ্যার কাজ করতেন। আরব বিশ্ব ছাড়া বাকি জাতিগোষ্ঠীর কাছে কোরান বোধগম্য ছিল না। তাছাড়া, মুসলমানদের মাঝেও সঠিক ব্যাখ্যা নিয়ে দ্বন্ধ দেখা যেত৷ কোরানের ব্যাখ্যার জন্য জন্ম হয় আলিম-উলামা শ্রেণীর। এদেরকে ইরানে বলা হতো ইমাম৷ ইরানি সমাজ খলিফা মানতো না। তারা মানতো ইমাম। এই ইমাম ইসলামে পরবর্তীতে প্রভাবশালী এক চরিত্রে রূপ নেয়। বাংলাদেশে এখন ইমাম বলতে শুধু মসজিদে নামাজ পড়ানো হুজুরকে বোঝানো হয়। কিন্তু, পারস্যের মুসলমান সমাজে একজন ইমামের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁরা অনেকসময় সামাজিক বিধি নিষেধের আরোপের ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করেন। রাষ্ট্রনায়করা তাই এই ইমামদের প্রতিপালন করতেন। তবে, যেহেতু কারবালার পর ইসলামে একটি সংঘাতময় ইতিহাসের শুরু হয় তাই ইমামদের মধ্যেও তখন দুই শ্রেণীর জন্ম হয়। এক পক্ষ ইসলামের প্রকৃত ব্যাখ্যা ও অনুশাসনের কথা বলেছেন। অন্য পক্ষ সময়ে সময়ে স্বৈরাচার শাসককে মদদ জুগিয়েছেন ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে।
ইসলামে ইমাম আবু হানিফা, ইমাম আবু বুখারীর নাম শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়৷ কারণ, তারা সত্যিকার ইসলামের শান্তির কথা ব্যাখ্যা করতেন। তবে যেহেতু ইসলাম অলঙ্ঘনীয় এবং সংস্কার অযোগ্য তাই কোরানের অনেক কিছুই শাসকদের শাসনকে সীমাবদ্ধ করে রাখতো। যা শাসকদের পছন্দের নয়। তাঁরা চাইতেন শাসনের বিস্তৃতি। সেটা অন্যায় ভাবে হলেও। কিন্তু, শাসক যেহেতু ইসলামের সাথে অঙ্গাঅঙ্গিভাবে জড়িত এবং শাসককে ইসলামিক হতে হবে; তাই তাঁরা সাহায্য নেন ওই শ্রেণীর ইমামদের। যারা, ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে শাসকদের অন্যায়কে প্রতিষ্ঠা করতে সহায়তা করতেন। যেসব ইমামরা কোরানকে নিজেদের প্রজ্ঞা দিয়ে উপলব্ধি করতেন, ব্যাখ্যা করতেন সত্য তারা কোনসময়ই শাসকদের প্রিয়ভাজন হয়ে উঠতে পারেন নি৷ উপরন্তু, ভুল ব্যাখ্যাকারী ইমামরা হয়ে ওঠেন বেশি ক্ষমতাধর। তারা ক্ষমতাকে মদদ দিতে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে গেছেন সবসময়। এই ধারার চর্চা থেকেই মুসলিম ইতিহাসে জন্ম নেয় আয়াতুল্লাহ খামেনি, মওদুদী, ওসামা বিন লাদেন এই শ্রেণীর কিছু ইসলামিক ক্যারেক্টার। যাদের সাথে ইসলাম জড়িয়ে আছে, কিন্তু ইসলামের প্রকৃত তথ্যের সাথে তারা নিজেরাই সাংঘর্ষিক। এ চর্চার কিছু উত্তরসূরী বিগত পাকিস্তান হয়ে বাংলাদেশেও প্রবেশ করেছে৷ পাকিস্তানে এই ইমামগিরি এসেছে সম্ভবত ইরান থেকে। বাংলাদেশে এসেছে পাকিস্তান থেকে। মওদুদীদের হাত ধরে। হেফাজতে ইসলামের কথা বলে এ অঞ্চলের ইসলামকে ব্যাপক ভাবে রাজনৈতিক ফায়দার জন্য ব্যবহার করা হয় সেসময়। এখনও দেশে তারা মাঝেমাঝে মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।
মুসলমান সমাজের এই ইমাম, আলিম, উলামারা যে সবসময় ইসলাম ধর্মের স্বার্থের পক্ষে কাজ করেন নি এর একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে নেপোলিয়নের এই সত্য গল্প দিয়ে। নেপোলিয়ন যখন মামলুক শাসনাধীন মিশরের কায়রোতে হামলা চালান, তখন কায়রোর বিখ্যাত আল আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উলামারা নেপোলিয়নের আক্রমণের পক্ষে ফতোয়া জারি করেছিলেন। মামলুক শাসকরাও ধর্মে মুসলমান ছিলেন। আজহার বিশ্ববিদ্যালয়ের উলামারা মুসলমান হয়েও সেদিন নেপোলিয়নের পক্ষে ফতোয়া দিয়েছিলেন নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থে। মামলুকরা ছিলো অনারব। এরা আরবের বাইরে থেকে আসা লোক। অন্যদিকে কায়রোর উলামারা ছিলেন আরব। তাই তারা মিশরে আরব হয়ে অনারব কোনো মুসলমানের শাসন মেনে নিতে পারছিলেন না। ফলে, নেপোলিয়নের পক্ষ নিয়ে মুসলমানেরই বিরুদ্ধে ফতোয়া জারি করেছিলেন কিছু মুসলমান উলামা। তারা সেসময়কার মুসলমানদের ফতোয়া দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিলেন অনারব মুসলমানদের শাসনে থাকার চাইতে বিধর্মী শাসকের হাতে এই বহিরাগত মুসলমানদের গুঁড়িয়ে দেওয়া জায়েজ। এতে করে ইসলাম আবার তার নিজস্ব লোকেদের হাতে আসবে! অথচ, ইসলামে মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই। কায়রোর আজহারী উলামারা সেদিন ভাই হয়ে আরেক ভাইকে হত্যার জন্য ফতোয়া জারি করেছিল এক বিধর্মীর পক্ষে। বোঝা যায়, ইসলামের স্বার্থে নিজেদের গোষ্ঠী স্বার্থের জন্য সেদিন ইসলামের নামে ফতোয়া দিয়েছিলেন আজহারী উলামারা।
এরকম অনেক ইতিহাস আছে৷ যেখানে ধর্ম স্বার্থ অপেক্ষা নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ধর্মকে ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশ-পাকিস্তান এহেন কাজের সবচেয়ে খ্যাতিমান জায়গা। বাংলাদেশে ইসলামকে রাজনৈতিক ফায়দা লাভের জন্য ব্যবহার করা হয়েছে সবসময়। এদেশে ইসলাম ব্যবহার করে ফায়দা লোটা যায়। কারণ, বাঙালী মুসলমান যতোটা না ইসলাম মানে, তারচেয়ে বেশি মানে তাদের মোর্শেদ পীর ছাহেবদের নির্দেশনা। তাই, এদেশের ধর্মগুরুরাও একটি মেকি ইসলাম তৈরি করে নিয়েছে। যা দিয়ে সাধারণ মুসলমানদের আকৃষ্ট করা যায়, পরিচালিত করা যায়।
কিছুদিন আগেও বলা হতো৷ মুসলমানদের পিছিয়ে থাকার কারণ আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত না হওয়া। এ কথা বর্তমান সময়ে খাটে না। মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালী এখন শিক্ষিত জাতি হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। কিন্তু, শিক্ষিত হবার পরও বাঙালী মুসলমান অগ্রসর হচ্ছে না। কারণ, তারা লাখ টাকা খরচা করে শিক্ষিত হবার পরেও মুরিদ হয় অশিক্ষিত, কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধ পীর, আলিম-উলামা, হুজুরদের। একজন শিক্ষিত বাঙালী মুসলমান শিক্ষকও যখন পীরমুখী থাকেন তখন তাকে আর অগ্রসরতা বলা যায় না।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ