শ্যামলাল গোসাঁই
বাঙালীর লালন সাঁই বিভ্রান্তি
বাঙালীর লালন সাঁই বিভ্রান্তি
বাঙালীর মধ্যে লালন সাঁই নিয়ে এখনো নানা বিভ্রান্তি টিকে আছে। কিছু বিভ্রান্তি লালন সাঁই'র মতবাদে পরিণত হবার পথে! লালনকে কেউ বানিয়েছেন ধর্মবিরোধি এক সমাজ সংস্কারক। কেউ গুরু পদে আসীন করে লালনকে বানিয়েছেন নিজেদের নবী। কেউ লালনকে মুর্তাদ বলছেন তো কেউ মানবতাবাদী বলছেন। এতে লালন নিয়ে বিভ্রান্তি বাড়ছে কিন্তু, প্রকৃত অর্থে লালন সাঁইকে বুঝবার পথ দুর্গম হয়ে যাচ্ছে।
লালনকে নিয়ে লেখক-গবেষকদের মনগড়া লেখা লালনকে সময়ের সাথে সাথে করে তোলছে আরও সাংঘ-র্ষিক। আর এর ফলে লালনের দর্শন, চর্চা দিনকে দিন হুমকির মুখে পড়ছে। আজকে সাধুসঙ্গ বন্ধ হয়েছে, এরপরে দোল উৎসব। সামনে কোনোদিন যে বাবড়ি মসজিদের মিনারের মতো লালনের আশ্রমে হানা পড়ে সে ভাবনায় আছি। কিন্তু, এসবের দায় শুধু কট্টর ধার্মিক বা আনপড় সুযোগ-সন্ধানী মেকি বাউলদের নয়। দায় আছে সেইসব লেখক-গবেষকদেরও যারা লালনকে ভুল ভাবে উপস্থাপন করছেন পাঠক-শ্রোতার সামনে। আজকের লেখাটি লালন সাঁই সম্পর্কে বাঙালীর এই বিভ্রান্তি নিয়ে।
লালন এক হাতে যেমন হিন্দুর বর্ণপ্রথা, সতীদাহ প্রথা ইত্যাদির সমালোচনা করেছেন আরেক হাতে কৃষ্ণ, গীতার প্রশংসাও করেছেন। তিনি এক বেলা ধর্মের নামে ব্যবসা করা মুসলমান মোল্লাদের, ফতোয়াবাজদের যেমন সমালোচনা করেছেন। তেমনি আরেক বেলা আল্লাহর প্রেমে মনসুর হল্লাজের পাগলামির কথা ভক্তদের শুনিয়ে তুষ্ট হয়েছেন। ফলে, লালন ধর্ম জাতি গোত্রের বিলোপ চাইতেন এটা বলা ঠিক না।
মাঝেমাঝে দেখি কিছু লেখক লিখেন— লালন সাঁই হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান জাতি গোত্রের বিলোপ চেয়েছিলেন। কথাটি ঠিক নয়। লালন সম্পর্কে কিছু লেখক-গবেষকের এমন দাবী লালন সাঁইকে আরো বেশি ধর্ম ও ধার্মিকদের সঙ্গে সাং-ঘ-র্ষিক করে তোলে। যা হচ্ছেও। এদেশে বিশ্বাসী ধার্মিক সমাজ যে লালনকে সহ্য করতে পারেন না, বাউল দেখলে তেড়ে আসেন, সাধুসঙ্গ বসতে বাধা দেন না এর অনেকটা দায় লালন সম্পর্কে লেখক-গবেষকদের ভুল গবেষণা, প্রচারণা। তারা লিখেছেন— লালন সাঁই হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান জাতি গোত্রের বিলোপ চেয়েছিলেন। ফলে এসব ধর্মের ধার্মিকদের কাছে লালন হয়ে দাঁড়ালেন খারিজকারি। অথচ, লালন ধর্মকে খারিজ করে দিতে চাননি। যেমনটা আজকাল গবেষক-লেখকরা লিখেন, বলেন। লালনের গানের মধ্যেই এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ আছে। সাঁইর বহুলশ্রুত গানগুলোর একটি "এমন মানব সমাজ কবে গো সৃজন হবে..." এ গানে তিনি ভূমিকাতেই বলেছেন— যেদিন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-বৌদ্ধ খ্রিস্টান জাতি গোত্রের ভেদ নাহি রবে/এমন মানব সমাজ কবে সৃজন হবে... লালন চাইতেন ধর্মে ধর্মে বিভেদহীন সমাজ। ধর্মহীন বা ধার্মিকহীন সমাজ নয়। গানেও সে কথারই উল্লেখ পাই। তিনি 'জাতি গোত্রের ভেদ' কামনা করতেন না। অথচ, কিছু লেখক-গবেষক লিখে যাচ্ছেন "লালন ধর্ম, জাতি গোত্র চাইতেন না।"
যখন কেউ লিখেন "লালন ধর্ম, জাতি গোত্রের বিলোপ চাইতেন" তখন এটি বোঝায় যে, লালন ধর্মের অস্তিত্বকেই নিষ্প্রয়োজন মনে করছেন। ধর্মকে বাতিল করে দিচ্ছেন। আদতে তা নয়। কেন নয়, সেটিও লালনের গানেই আছে। লালন ধর্মের মূল নীতি সম্পর্কে অবগত ছিলেন। পুঁথিগতভাবে না হলেও নিজ পর্যবেক্ষণ দ্বারা তিনি ধর্মের ন্যায়, সুন্দর, কল্যানের দিকগুলোও দেখেছিলেন। ফলে, তিনি মানুষকে ধর্মের নামে অধর্মের কর্ম না করে যার যার স্বীয় ধর্ম প্রকৃতভাবে পালনের আহ্বান জানিয়েছেন। লালন মুসলমানদের জন্য গান লিখেছেন কোরানের আয়াত, রাসুলের হাদিস, ইসলামের ইতিহাস ইত্যাদি অবলম্বন করে। তিনি যখন গাইছেন— 'তুমি আপনি আল্লাহ, ডাকো আল্লাহ বলে/আল্লাহ কে বুঝে তোমার অপার লীলে...' তখন এটা বলা যায় না লালন ধর্মের বিলোপ চাইতেন। একই কাজ লালন করেছেন হিন্দুদের জন্যও। তিনি গোষ্ঠের গান লিখেছেন। যেগুলো মূলত হিন্দু পুরাণের বলাই, গোপাল, চরিত্রকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা। লালন হিন্দু-মুসলিম উভয়ের জন্য তাদের নিজেদের ধর্মের মতো করে লিখেছেন। ধর্মযুদ্ধে জর্জরিত রুগ্ন অন্ধকারাচ্ছন্ন বাঙালী ধার্মিকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চেয়েছেন তাদের চর্চিত ধর্মের মূল বাণী। যেখানে সামষ্টিকের কল্যানই সারকথা, হক দাবী। লালন ধার্মিকদের কাছে ধর্মকে দেখিয়েছেন মানুষের দাবী হিসেবে। তাই তিনি সরাসরি ধর্মকে বাতিল করে দেন নি। যতটুকু জানা যায়, পূর্ণবয়সে লালন নিজে হিন্দুও ছিলেন না, মুসলিমও ছিলেন না। কিন্তু, তিনি সকল ধর্মকেই মান্য করতেন। তিনি সব ধর্মেরই সুন্দর দিকগুলো ধার্মিকদের ধরিয়ে দিতেন। খারাপ দিকটিও তোলে ধরতেন।
যারা লিখেন বা বলেন লালন হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্ম জাতি গোত্র বিলোপ চাইতেন; তাদের বেশিরভাগই লালনের কয়েকটি মাত্র গান শোনেছেন আমার বিশ্বাস। তারা লালনের নবীতত্ত্বের গান হয়তো শুনেননি। যেখানে লালন গাইছেন— "যেই মুর্শিদ সেই রাসুল, তাহাতে নাই কোনো ভুল কোরানে কয়.../পাড়ে কে যাবি নবীর নৌকাতে আয়..."" কিংবা "যাও হে শ্যাম রাই কুঞ্জে আর এসো না..." এগুলো ধর্ম বাতিল করে দেওয়ার গান নয়। ধর্ম দিয়েই ধার্মিকদের কাছে টানার গান। আমরা যেটাকে বলি 'কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা' লালন সেটাই করতে চেয়েছেন বলে মনে হয়। তিনি নিশ্চয়ই জানতেন হাজার হাজার বছর ধরে মানুষের বিশ্বাস আর চর্চায় নির্মিত ধর্মের সৌধ হঠাৎ একদিন এসে কেউ ভেঙে দিতে পারবে না। কালে কালে ধর্ম যে সমাজের মজ্জায় মজ্জায় পৌঁছে গেছে লালন সেটা জানতেন। জানতেন বলে, নিজে প্রশ্নানুসন্ধানী যুক্তিবাদী দার্শনিক হয়েও ধার্মিকদের কাছে গেলে শুনিয়েছেন ধর্মীয় ঘটনা দিয়ে তৈরি গান। কোরানে, প্রাচীন বেদে, গীতায়ও যে মানুষের কল্যান, মানুষকে ভালোবাসার কথার উল্লেখ আছে লালন তা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন গানে গানে। লালন এক হাতে যেমন হিন্দুর বর্ণপ্রথা, সতীদাহ প্রথা ইত্যাদির সমালোচনা করেছেন আরেক হাতে কৃষ্ণ, গীতার প্রশংসাও করেছেন। তিনি এক বেলা ধর্মের নামে ব্যবসা করা মুসলমান মোল্লাদের, ফতোয়াবাজদের যেমন সমালোচনা করেছেন। তেমনি আরেক বেলা আল্লাহর প্রেমে মনসুর হল্লাজের পাগলামির কথা ভক্তদের শুনিয়ে তুষ্ট হয়েছেন। ফলে, লালন ধর্ম জাতি গোত্রের বিলোপ চাইতেন এটা বলা ঠিক না। লালন ধর্মের ভালো-খারাপ দুইটি দিকই অবলোকন করেছিলেন। তিনি বর্ণপ্রথা, সতীদাহ প্রথার বিলোপ চাইতেন। ধর্মের নামে মুসলমানরা মোল্লাদের ব্যবসা বিলোপ চাইছেন, দাঙ্গা, বিভেদের বিলোপ চাইতেন। যিনি মুসলমান লালন চাইতেন তিনি যেন মনসুর হাল্লাজের মতো আল্লাপ্রেমী হন, বকধার্মিক না। যিনি হিন্দু লালন চাইতেন তিনি যেন গীতা নির্দেশিত কল্যানকামী সনাতনী হোন। ব্রাহ্মন্য পুরোহিতদের আধিপত্যবিস্তারী প্রভুদের মতো নয়।
আমি আমার বিগত লেখায় বলেছি— লালন মূলত একজন ভাববাদী দার্শনিক ছিলেন। যার দর্শনের মূলে ছিল প্রয়োগবাদ, যৌক্তিক প্রশ্নানুসন্ধান এবং আত্মিক বিনিয়োগ। এসব নিয়ে আজকাল যারা লালন নিয়ে লেখছেন তারা কিছু বলছেন না। হয়তো জানেন না বলে। হয়তো তারা ধরেই নিয়েছেন— লালন মূলত একজন মানবতাবাদী বাউল। অথচ, ধর্ম জাতি গোত্রের সংঘাত এ অঞ্চলে তখন হরহামেশাই ঘটত। লালনের আগের গুণীরাও এ সমস্যাকে তাদের রচনায় তোলে ধরেছেন। যেহেতু, সমাজে তখন এটি একটি বড় সমস্যা ছিল তাই লালনকেও এ বিষয়েও অংশ নিতে হয়েছে। এক্ষেত্রে তিনি ধার্মিকদের সঙ্গে বাহাজ করেছেন ধর্মের তত্ত্ব, তথ্য দিয়েই। তিনি তাদেরকে দেখাতে চেয়েছেন সব ধর্মেরই মূল বাণী সত্য সুন্দর গ্রহণ করা, সর্বজনের কল্যানকামী এবং পরহিতৈষী হওয়া। এগুলো মানলে, চর্চা করলে যে যে ধর্মেরই হোক বিভেদ হবার কথা নয়। লালন নিজে প্রচলিত কোনো ধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন না। কিন্তু, তাঁর বিরুদ্ধ মতের বিশ্বাসীদের ক্ষেত্রে ছিলেন সহনশীল। তিনি শুধু, মতের পার্থক্যের জন্য বিভেদের দেয়ালটুকু চাইতেন না। এই সহজ কথাটি লেখতে গিয়ে কিছু লেখক-গবেষক লিখেই চলেছেন— লালন সাঁই হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ধর্ম জাতি গোত্র বিলোপ চাইতেন!
আরও পড়ুন- অন্যরকম লালন সাঁই | শ্যামলাল গোসাঁই
লালনের একটি আত্মতত্ত্বের গান আছে [ চিরদিন পুষলাম এক অচিন পাখি..] এ গানে তিনি গেয়েছেন— 'অচিন পাখি চিনলাম না, এ লজ্জা তো গেল না..." লালন নিজেই বাঙালীর কাছে এক অচিন পাখি। যে পাখিটিকে সবাই সবার মতো করে চিনে নিয়েছে। পাখির মতো করে কেউ বুঝেনি। ফলে, কারো কাছে লালন গুরু, কারো কাছে বিধর্মী মুর্তাদ, কারো কাছে মানবতাবাদী তো কারো কাছে সমাজ সংস্কারক। আদতে লালন যে একজন সুচিন্তক ছিলেন, বাঙালীর গর্ব করার মতো একজন দার্শনিক ছিলেন সেদিকে কারো নজর নেই। এটা লালনের জন্য যতোটা না দূর্ভাগ্যের তারচেয়ে বেশি দূর্ভাগ্যের বাঙালীর জন্য।
লালন বাঙালীর নিজস্ব এক দার্শনিক ছিলেন, যাকে নিয়ে গর্ব করা যেতো রবীন্দ্রনাথ থেকে বেশি। লালনের মতকে স্পিনোজার সাথে তুলনা করে তর্ক-বিতর্ক করা যেতো। কিন্তু, হায়! আমরা তো তাকে পীর বানিয়ে ফেলেছি। কবরকে মাজার তৈরি করে ধান্ধা শুরু করেছি। এটাই আমাদের প্রকৃত বাস্তবতা।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি, লেখক ও সংস্কৃতিকর্মী
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ