শ্যামলাল গোসাঁই
আপডেট: ১৬:৪৩, ৬ জুন ২০২৪
চূড়ান্ত সত্য সন্ধানে | দার্শনিক আলাপ
আমি ইদানিং একটা সমস্যায় পড়েছি। অনেকের কাছে বিষয়টি হাস্যকর এবং পাগলাটে ঠেকতে পারে। কিন্তু, আমার ক্ষেত্রে এটা সত্যি সত্যিই একটা সমস্যা হিসেবে দেখা দিয়েছে। সমস্যাটি হচ্ছে চিরায়ত সত্য হিসেবে মেনে আসা প্রতিটি ব্যাপারে সন্দেহ জাগা। সহজ কথায় বলা যেতে পারে, সত্যের প্রতি সন্দেহ জাগা। বিশেষ করে, যে বিষয়গুলো সাধারণত যাপিত জীবনে আমরা সত্য বলে মানি, স্বীকার করি, ঘোষণা দেই এবং স্বীকৃতি দেই বা প্রতিষ্ঠিত করতে চাই তা কি চূড়ান্ত সত্য? যদি না হয় তাহলে কি আমরা কিছু ভ্রমের মধ্যে বাস করছি না? অথবা সত্য ব্যাপারটাই বা আসলে কী— এ নিয়ে এক প্রকার ধোঁয়াশার জন্ম নিয়েছে আমার মনে।
সাধারণত সত্য কী জিজ্ঞেস করলে সকলেই বলবে— আমরা দৃষ্টি দিয়ে যা দেখতে পাই, নাক দিয়ে যা শুঁকতে পাই, চামড়ায় যে স্পর্শ লাভ করি বা ইন্দ্রিয় দিয়ে যেসব জিনিস প্রত্যক্ষ করি তাই সত্য। এমনটা আমরা সকলেই জানি। এমনকি, আমি আমার কয়েকজন বন্ধুকে সত্য কী জিজ্ঞেস করার পর তারাও একই বিষয় বলেছে। তাদের কাছে যা দৃষ্টিগ্রাহ্য, যা এক্সিস্ট করে তাই সত্য। যা দেখা যায়নি, যা শোনা হয়নি কখনো তা সত্য নয়। পাখি আমরা সকলেই দেখেছি, সকলেই চিনি। তাই পাখির অস্তিত্ব সত্য। কিন্তু, পাখাওয়ালা সাপ কেউই দেখেনি আজ অব্দি। তাই এটাকে সবাই মিথ্যা হিসেবে মানে। আমাদের কাছে যা ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, প্রত্যক্ষযোগ্য কিংবা উপলব্ধি করা যায় তাই সত্য। যা কেউ কখনো দেখেনি, শোনেনি কিংবা এর অস্তিত্ব কেউই প্রত্যক্ষ করেনি তা সত্য নয়। এখানেই সমস্যার শুরু। আমার মনে প্রশ্ন জেগেছে, আমরা যা দেখি, শুনি কিংবা উপলব্ধি করি আপাতদৃষ্টিতে সত্য মনে হলেও সেটাই কি চূড়ান্ত সত্য? নাকি আমাদের প্রত্যক্ষ করা মুহূর্তের ঘটনা মাত্র! ন্যায় কি সত্যিই এক্সিস্ট করে নাকি এটি একটি সাইকোলজিকাল ভাওতা মাত্র। ন্যায় যদি সত্য কোনো ধারণা হয়ে থাকেব তাহলে সব জায়গায় একইভাবে কেন কার্যকর হয় না? নাকি ন্যায় সত্য হিসেবে মেনে আসা মানবসমাজের প্রতিষ্ঠিত ত্রুটিযুক্ত একটি চর্চা মাত্র।
সত্য সম্পর্কে আমাদের ধোঁয়াশা রয়েছে। আমরা যা সত্য বলে মানছি তা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল-ভ্রান্তি মাত্র। সূর্য পূবদিকে ওঠে বলে যে সত্যটি প্রচলিত এটি বিজ্ঞান এবং যুক্তির দিক থেকে একটি মিথ্যা তথ্য। সূর্য কখনোই পূবদিকে ওঠে না। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূবদিকে ঘুরছে। আর এর ফলে পৃথিবীর দিক পরিবর্তন হচ্ছে। লেখার শুরুতে বলা কথাটা এখানে প্রমাণস্বরূপ হাজির করা যায়।
আধুনিক বিজ্ঞান আজকে আমাদের এ কথা জানায় যে, আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য কোনো তথ্যই চূড়ান্ত সত্য নয়। মানুষের জৈবিক গঠনপ্রণালী এমন যে, তা দিয়ে আমরা জগৎ সম্পর্কে নির্ভুলভাবে জানতে অক্ষম। আমাদের এই আকার দিয়ে জগত সম্পর্কে চূড়ান্ত জ্ঞান, চূড়ান্ত সত্য বলে দাবি করে এরকম কোনোকিছু হাসিল করা সম্ভব নয়। আমরা সবসময় পরিবর্তিত তথ্য প্রত্যক্ষ করতে পারি, উপলব্ধি করতে পারি মাত্র; কিন্তু, এটিই চূড়ান্ত সত্য এ কথা বলতে পারি না। কারণ, আমাদের সীমাবদ্ধতা। যেহেতু মানুষ ইনফলাবল নয় সেহেতু মানুষের সেনসেশন ও পার্সেপশনও শতভাগ বিশ্বাসযোগ্য বা নির্ভরযোগ্য নয়। [পড়তে পারেন কর্ণফুলীর গান অধ্যায়, বই মূর্তিভাঙা প্রকল্প, মহিউদ্দিন মোহাম্মদ।) অর্থাৎ, মানুষের প্রত্যক্ষ করা বা উপলব্ধ কোনো জ্ঞানই ত্রুটিমুক্ত, নির্ভুল নয়। যা মানুষ দেখে বা শোনে তাই সত্য নয়। এর বাইরেও অনেক কিছু থেকে যায় যা মানুষ জানতে পারে না। একজন সুস্থ সবল স্বাভাবিক মানুষ ২০ হার্জ থেকে ২০,০০০ হার্জ কম্পাংক পর্যন্ত শুনতে পান বলে আমরা জানি। এই মাত্রার মধ্যে যতোকিছু ঘটে মানুষ শুনতে পায়। কিন্তু, তারমানে এই নয় ২০ হার্জের নিচে এবং ২০ হাজার হার্জ কম্পাংকের ওপরে আর কিছু নেই বা হয় না বা হলেও তা সত্য নয়। বাদুড়, বিড়াল, কুকুর, ইঁদুর ২০ হাজার হার্জ কম্পাংকের ওপরের শব্দগুলো সনাক্ত করতে পারে। আমরা পারি না। ওই মাত্রায় কিছু ঘটলে আমাদের থেকে নির্ভুলভাবে বাদুড় তথ্য সংগ্রহ করতে পারবে। তবু, আমাদের বিশ্বাস আমরা যতটুকু শুনি ততটুকুই সত্য, যা মানুষের দৃষ্টিগ্রাহ্য তাই চূড়ান্ত সত্য।
মানুষের প্রত্যক্ষ করা বা উপলব্ধ কোনো জ্ঞানই ত্রুটিমুক্ত, নির্ভুল নয়, তা আমি প্রথম সবিস্তারে পড়ি মহিউদ্দিন মোহাম্মদের মূর্তিভাঙা প্রকল্প বইয়ে। এবং এরপর থেকেই এ বিষয়টি নিয়ে আমার সমস্যার শুরু হয়েছে। আমি দেখলাম, মানুষ চূড়ান্ত সত্য হিসেবে যা মানে তা চূড়ান্ত নয়। এটির পরিবর্তন হচ্ছে। মানুষ চূড়ান্ত সত্য হিসেবে মানে এরকম অজস্র বিষয় আছে যা আসলে যৌক্তিকভাবে মিথ্যা বা ততোটাও সত্য নয়। এমনকি, চূড়ান্ত ন্যায়, চূড়ান্ত সত্য বলে আসলে কিছু আছে কি না সে প্রশ্নও ভাবাচ্ছে খুব। যেহেতু, মানুষ নির্ভুলভাবে কিছু জানতে বা উপলব্ধি করতে পারে না। মানুষের সকল উপলব্ধি, অভিজ্ঞা তার স্থান, কাল, পরিবেশ, গঠনের উপর নির্ভরশীল। সেহেতু তাদের আরোপিত ন্যায় বিধান বা দাবি করা সত্যও যে শতভাগ নির্ভুল হবে এবং চূড়ান্ত সত্য হবে তা মেনে নেওয়ার কোনো পোক্তা কারণ দেখি না। প্রাচীন মানুষরা দীর্ঘদিন বিশ্বাস করেছে পৃথিবী একটি কচ্ছপের পিঠের উপর স্থির। তারা এটিই সত্য হিসেবে জানতো। কিন্তু, জোতির্বিদ ও দার্শনিকরা যখন যুক্তি দিয়ে প্রমাণ করলেন পৃথিবী কোনো কচ্ছপের পিঠের উপর স্থির নয়। সূর্যকে ঘিরে নিজ অক্ষে ঘুরছে তখন আগের সত্য বদলে গেল। যদিও শুরুতে, সকলের এ সত্য স্বীকার করতে অসুবিধা হচ্ছিল। তবু, আজ বিশ্বজুড়ে সবাই জানেন পৃথিবী যে কচ্ছপের পিঠে নেই এবং এটি সূর্যকে ঘিরে নিজ অক্ষে ঘুরপাক খাচ্ছে। আজকের দিনে এটিই বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। এই সত্য পৃথিবী ধ্বংসের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত অটল থাকবে। আজকাল তো আমরা এটাও জানি, শুধু পৃথিবীই নয়; পৃথিবীর মতো একাধিক গ্রহ, উপগ্রহ সূর্যকে ঘিরে প্রদক্ষিণ করছে নিজ নিজ অক্ষে।
সূর্য সবসময় পূবদিকে ওঠে, এটাকেও মানুষ সত্য হিসেবেই মানে। চিরায়ত সত্য বলে এটি শিক্ষিত সমাজেও প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু, বিজ্ঞানের কোনো বইয়েই বলা নেই সূর্য পৃথিবীর পূবদিকে ওঠে এবং চলতে চলতে পশ্চিমে হেলে পড়ে। বিজ্ঞান বলে, সূর্য পৃথিবীর পূবদিকে ওঠে না বা পশ্চিমে অস্তও যায় না। সূর্য তার জায়গাতেই আছে। পৃথিবীটা শুধু নিজ অক্ষে পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে ঘুরছে। পৃথিবীর ঘূর্ণনের সাথে সাথে দিক পরিবর্তিত হচ্ছে। সূর্য, থেকে যাচ্ছে তার নিজ জায়গায়। অথচ, আমরা চিরন্তন সত্য হিসেবে বলছি সূর্য সবসময় পূবদিকে ওঠে, পশ্চিমে ডুবে। কেননা, আমরা সকালে ঘুম থেকে ওঠে সূর্যকে পূবদিকে দেখি। আবার যখন সন্ধ্যা হয় পশ্চিম দিকে দেখি। এখানে সত্য কোনটি? সূর্য সবসময় পূবদিকে ওঠে এবং পশ্চিমে অস্ত যায় নাকি পৃথিবী সবসময় সূর্যকে ঘিরে নিজ অক্ষে পশ্চিম থেকে পূবদিকে ঘুরছে? বিজ্ঞান তো বলে পৃথিবী ঘুরছে। সূর্য ওঠছে না ডুবছেও না। তাহলে সূর্য সবসময় পশ্চিমে ওঠে এটিকে আমরা চূড়ান্ত সত্য বলছি কেন? বাচ্চাদেরকেএই মিথ্যা সত্যকে তথ্য হিসেবে শেখাচ্ছি কেন আমরা? শুধুমাত্র সকালে ঘুম থেকে ওঠে সূর্যকে পূবদিকে এবং সন্ধ্যায় পশ্চিমে দেখা যায় বলে? কিন্তু, এই দিক পরিবর্তন তো পৃথিবীর ঘূর্ণনের কারণে হয়।
দেখা যাচ্ছে চূড়ান্ত সত্য সম্পর্কে আমাদের ধোঁয়াশা রয়েছে। আমরা যা সত্য বলে মানছি তা অনেক ক্ষেত্রেই ভুল-ভ্রান্তি মাত্র। সূর্য পূবদিকে ওঠে বলে যে সত্যটি প্রচলিত এটি বিজ্ঞান এবং যুক্তির দিক থেকে একটি মিথ্যা তথ্য। সূর্য কখনোই পূবদিকে ওঠে না। সূর্যকে ঘিরে পৃথিবী পশ্চিম থেকে পূবদিকে ঘুরছে। আর এর ফলে পৃথিবীর দিক পরিবর্তন হচ্ছে। লেখার শুরুতে বলা কথাটা এখানে প্রমাণস্বরূপ হাজির করা যায়। বলেছিলাম যে, মানুষ জগৎ সম্পর্কে নির্ভুলভাবে জানতে অক্ষম। অর্থাৎ, তার কোনো জানাই চূড়ান্ত জানা নয়। তার দাবি করা কোনো সত্যই চূড়ান্ত সত্য নয়।
লেখক : শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ