আবদুল হামিদ মাহবুব
অনন্য স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তায় আলাদা আইনের কথা ভাবুন
অনন্য স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তায় আলাদা আইনের কথা ভাবুন।
হায়! দেশের এতো ক্ষতি? এটা সহ্য করতে পারছি না। স্থাপনাগুলো কি দোষ করেছে? এগুলোতে অগ্নিসংযোগ ভাংচুর কেনো? কোটা সংস্কার আন্দোলনের আমাদের সন্তানরা এমন করেছে, আমি এটা কখনো বিশ্বাস করবো না। এই সন্তানরা দেশের কোনো সাফল্যে আনন্দিত হয়। দেশের কোনো বিপর্যয়ে দেশকে উদ্ধার করতে ঝাঁপিয়ে পরে। বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাসে আমরা সেটা দেখেছি। দেখেছি করোনাকালে। সেই তারা কি দেশের জন্য ক্ষতিকর কিছু করতে পারে? না, পারে না।
আমাদের ক্রিকেট টিম কিংবা ফুটবল দল বিদেশের মাটিতে যখন কোনো জয় পেয়েছে, এই সন্তানদের উচ্ছ্বাস আমরা দেখেছি। আবার যখন আমারা হেরে গেছি দেখেছি তাদের বুকফাটা কান্না। দেশপ্রেম না থাকলে কি আমাদের এই সন্তানরা এমন করে? আমাদের এই সন্তানদের এই নাশকতার জন্য দায়ী করবেন না। তাদের নির্দোষ আন্দোলনের ভিতরে যারা ঢুকে এই নাশকতা করেছে, তাদের খুঁজে খুঁজে বের করুন। চরম শাস্তি দিন। প্রয়োজনে আইন করে নাশকতার জন্য মৃত্যুদ-ের সাজা করুন।
ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় এই কয়দিন দেশ- বিদেশের সকল কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম। ছটফট করছিলাম দেশের অবস্থা জানতে। কারণ বছরদিন আগেই বাসায় পত্রিকা রাখা বাদ দিয়েছি। আমি অনলাইনেই সকল ই-পেপার দেখে নিতাম। যেগুলো পড়ার প্রয়োজন মনে করতাম, পড়তাম। আর সারাদিন অনলাইন পোর্টালগুলোর নিউজতো পেতামই। টেলিভিশনও দেখতাম বিটিসিএল-এর ইন্টারনেট ওয়াইফাই সংযোগের মাধ্যমে। কিন্তু ইন্টারনেট বন্ধ হয়ে যাওয়ায় সকল কিছু থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম। রিপোর্টিং বাদ দিয়েছি দুই বছরের উপরে হয়েছে। প্রয়োজন ছাড়া স্থানীয় সাংবাদিকদের সাথেও যোগাযোগ হয় না। বুড়ো বয়সে নিরিবিলি থাকার জন্য গত কয়েক মাস ধরে আমি শহরের বাইরে বসবাস করছি। একারণেও আমি অনেক কিছু জানতে পারি না।
শুক্রবার (১৯ জুলাই) রাতে ঢাকা থেকে এক আত্মীয় ফোন করে জানালেন সারাদেশে কারফিউ জারী করা হয়েছে। দেশের পরিস্থিতি খুবই খারাপ। ওইদিন ঢাকাতে অনেক স্থানেই গুলি হয়েছে, হতাহত হয়েছে অনেক, এসব লোকমুখে জেনেছেন। রাত এগারোটায় ফোন দিলাম প্রথম আলো সাংবাদিক আকমল হোসেন নিপুকে। জানতে চাইলাম টেলিভিশন দেখছে নাকি? সে বললো, ‘আমি বিছানায়।’ বললাম, ‘উঠে গিয়ে টেলিভিশন ছেড়ে দেখো কিছু বলে নাকি?’ অপেক্ষায় থাকি। নিপু আর কিছু জানায় না। প্রায় দশ মিনিট পর আবার কল করলাম। বললো, ‘বিটিভি দেখছি। কিছু তো দেখাচ্ছে না।’ আমি বলি, ‘অন্য চ্যানেল দেখো।’ সে বলে, ‘রিমোট কাজ করছে না।’ শুনতে পাই তার ছেলে পলাশের নাম ধরে ডাকছে। আমি মোবাইল সংযোগ রেখে অপেক্ষায় থাকি। একটু পরে নিপু বলে ‘হ্যাঁ, দেশটিভির স্ক্রলে দেখাচ্ছে, সেনাবাহিনী মোতায়েনের সিদ্ধান্ত, রাত বারোটা থেকে সারাদেশে কারফিউ জারী।’ আমি জিজ্ঞেস করি ‘আমাদের এখানে কি সেনাবাহিনী এসে গেছে।’ নিপু বলে, ‘এতো রাতে এ আর জেনে কি হবে? ঘুমাও। কাল সকালে খবর নিয়ে দেখবো নে।’
আমার তো আর ঘুম আসে না। ঢাকাতেও চেনাজানা সাংবাদিক কয়েজনকে ফোন করলাম, কেউই ফোন ধরলেন না। ইন্টারনেট না থাকায় সবাই বিচ্ছিন্ন, এজন্য হয়ত হতভম্ব হয়ে মোবাইল দূরে সরিয়ে রেখে ঘুমুচ্ছে অথবা আমার মতো বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে।
হয়ত ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। উঠলাম এগারোটায়। মোবাইল হাতে নিয়ে আমেরিকায় থাকা ছেলের সাথে সরাসরি কল করে কথা বলতে চেষ্ঠা করি। বেলা একটার পর লন্ডন থেকে আমার ভাই বোনরা মোবাইলে কল করতে থাকেন। কিন্তু লাইন পরিস্কার না, কারো কোনো কথাই বুঝতে পারি না। তারা আমার খথা বুঝে কি না সেটা জানি না। ওখানে আমার দুই ভাই, পাঁচ বোন থাকেন। নিশ্চয় তারা কারফিউ জারীর খবর পেয়ে গেছেন। আমাদের জন্য, দেশের জন্য উদ্গীব হয়ে ফোন করছেন। এভাবে বেলা পাঁচটা পর্যন্তই চললো। কারো কথা বুঝলাম না। তারপরও সবাইকে চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললাম, ‘আমরা ভালো আছি। আমেরিকায় ইফাত-আদিবা’র (আমার ছেলে ও তার বউ) সাথে যোগাযোগ করে বলো আমরা ঠিক আছি। চিন্তা যেনো না করে।’
সন্ধ্যায় আমার স্ত্রীর মোবাইলে অস্ট্রেলিয়া থেকে উনার বোন কল করলো। ওর সাথে তিনি কথা বলতে পারলেন। আমার ছেলেটি তার খালার কাছে কল করে আমাদের খবর জানতে চাচ্ছে। ওকে সব বলা হলো, ও যেনো আমাদের সাথে আবার ইফাতের সাথে যোগাযোগ রেখে খবর আদানপ্রদান করে। আমাদের খবর দিলেই হবে না। আমাদের বিয়াইয়ের বাসার খবরও দিতে হবে। না হলে আমার ছেলের বউ চিন্তা করবে। প্রবাসে যাদের স্বজন আছেন এমন সকল পরিবারেই অস্থিরতা হয়েছে।
ঢাকাতে থাকেন বিয়াই। তাকে ফোন করলাম। তিনিও জানালেন ইফাতদের সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না। অষ্ট্রেলিয়া থেকে আমার শালির যোগাযোগ হয়েছে জানিয়ে বললাম, ‘আপনাদের খবর কি?’ বিয়াই জানালেন আমারা নয়তলার উপরে আছি। আমাদের কোনো সমস্যা নাই। বাইরেও বের হচ্ছি না। তবে আমাদের বাসার সামনের রাস্তায় একটি ছেলের কোমরে গুলি লেগেছে দেখেছি। বিয়াই জানান, শনিবারের প্রথম আলো খবর দিয়েছে ‘তিন দিনে নিহত ৮৩’।
আমার প্রিন্ট পত্রিকার কথা মনে পড়লো। আমিওতো প্রিন্ট পত্রিকা আনিয়ে নিলে অনেক খবর জানতে পারতাম। বিয়াইয়ের সাথে কথা শেষ করে মোটরসাইকেল আছে এমন কয়েকজনকে ফোন করলাম আমাকে একটি প্রিন্ট পত্রিকা সংগ্রহ করে এনে দেওয়ার জন্য। কিন্তু কেউই পত্রিকা সংগ্রহ করতে পারলো না। শনিবার কাটলো।
রবিবার ঘুম থেকে উঠেই এক সিএনজি (বেবিটেক্সি) চালককে ফোন করলাম একটি পত্রিকা সংগ্রহ করে এনে দিতে। প্রথমে সে বললো কারফিউর মধ্যে গাড়ি বের করবে না। আমি বললাম, ‘পত্রিকার দাম গাড়ি ভাড়া সব দিবো, যেভাবেই হোক একটা পত্রিকা সংগ্রহ করে এনে দাও।’ সে জানালো, ‘আচ্ছা দেখি।’ ঢাকার পত্রিকা অফিসের পরিচিত সাংবাদিকদের ফোন করি। সবাই বলে আপনারা যা জানচ্ছেন আমরাও সেটাই জানছি। রাতে পত্রিকায় দেওয়ার আগে বার্তা সম্পাদক সবার তথ্য একত্র করার পর ঠিক চিত্র বলা যাবে। একটি পত্রিকার এক রিপোর্টার কেবল বললেন আমাদের সম্পাদকের সাথে ‘ওই’ দপ্তরের অমুখ (সঙ্গত কারণে নাম বললাম না) বৈঠক করে গেছেন। বুঝেন তো, কতটুকু আর লেখা যায়!
বেলা তিনটায় সেই সিএনজি চালক এক কপি ‘দৈনিক কালের কণ্ঠ’ নিয়ে এলো। ৮ পৃষ্ঠার কালের কণ্ঠে মূল্য ছয়টাকা। কিন্তু হকারের কাছ থেকে বিশ টাকা দিয়ে পত্রিকা কিনতে হয়েছে। আমি সিএনজি চালককে পত্রিকার দাম বিশ টাকা, আর তার সিএনজি নিয়ে শহরে যাওয়া আসার ভাড়া দুইশ’টাকাসহ মোট দুইশ’ বিশ টাকা দিয়ে বিদায় করি।
কালের কণ্ঠের আট কলামের শিরোনাম ‘পাঁচ দিনে সংঘাতে শতাধিক নিহত’। এই এতো মৃত্যুর খবর তো হৃদয় বিদারক। একটি মৃত্যুও কোনো টাকার অঙ্কে পূরণ করা যাবে না। অসতর্ক একটি কথায় কত অঘটন ঘটে যায়। আর যেনো অসতর্ক কথা উচ্চারিত না হয়। আর যেনো একটি মৃত্যুও না ঘটে, খোদার কাছে এই প্রার্থনা রাখছি। পাঠকদের জন্য এখানে আমার চারলাইনের একটি ছড়া উদ্ধৃত করলাম; কথা বলুন লাগাম টেনে/কথারওতো সীমা থাকে/লাগাম ছাড়া কথা বলে/পড়তে পারেন দুর্বিপাকে।’
এই পত্রিকায়ই ক্ষয়ক্ষতির একটা নিউজ করেছে, তাতে বলা হয়েছে, ‘এই স্থবিরতায় গত তিন দিনে ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষতি ৩০ থেকে ৩৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে মনে করেন ব্যবসায়ীরা।’ ব্যবসায়ীদের ক্ষতি ছাড়াও রাষ্ট্্রীয় ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক। ‘সেতু ভবন, বাংলাদেশ টেলিভিশন ভবন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, মিরপুর ইনডোর ষ্টেডিয়াম, হানিফ ফ্লাইওভারের টোল প্লাজা, এক্সপ্রেসওয়ে টোল প্লাজা, মেট্টো রেল স্টেশন, বিভিন্ন থানা, পুলিশ বক্স ও যানবাহনে ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের কারণে বিপুল অঙ্কের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। মিরপুর বিআরটিএ ভবন পুড়ে ভস্মীভূত হয়েছে। রাষ্ট্রীয় সম্পদের বাইরেও দেশের মানুষের ব্যক্তিগত সম্পদেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।’
উপরে উল্লেখিত ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের মিরপুর-৪ অঞ্চলের সামনে পরিবহন কাজের ৪০টি কাভার্ড ভ্যান পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পুড়ানো হয়েছে সেতু ভবনের বাইরে পার্কিংয়ে থাকা ৫৫টি গাড়ি। সরকারী সম্পদের এতো ব্যাপক ক্ষতি সরকার বিরোধী অন্য কোনো আন্দোলনের সময়ও হয়েছে বলে আমার স্মরণে আসছে না।
নিউজে দেখলাম মেট্টো রেলের কাজীপাড়া ও মিরপুর স্টেশন এমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে, সেটা মেরামত করে চালু করতে একবছর সময়ও লাগতে পারে। নিউজটি পড়ে আমি এক্কেবারেই হতাশ হয়ে পড়েছি। গত জুন মাসে আমার ছেলের বউ আমেরিকা থেকে আসায় আমরা ঢাকাতে গিয়েছিলাম। মেট্টো রেলের সচিবালয় (জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনের) স্টেশন থেকে আমরা ট্রেনে উঠে ‘উত্তরা সেন্টাল’ পর্যন্ত মাত্র ২০ মিনিটে গিয়েছি। প্রথম মেট্টোতে চড়ায় আমার মনে যে আনন্দ হয়েছিলো সেটা ভাষায় বর্ণণা করতে পারবো না। প্রেসক্লাবের কাছ থেকে পূর্বে যতোবার গাড়িতে গিয়েছি দুই আড়াই ঘণ্টার আগে পৌঁছাতে পারিনি। সেখানে মাত্র ২০ মিনিট! ঢাকার বুকে এই যুগান্তকারী যোগাযোগ উন্নয়নের নায়ক জাতিরজনকের কন্যা শেখ হাসিনা।
পদ্মা সেতু, মেট্টো রেলে কাদের গা জ্বলছে? কারা এসব ধ্বংস করতে চায়? নিশ্চয় কোটা নিয়ে আন্দোলন করেছে আমাদের যেসব সন্তান, তারা না। তারা তো কখনো শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ হয়নি। যারা শেখ হাসিনার প্রতিপক্ষ, এই ধ্বংসযজ্ঞ তারাই চালিয়েছে। তারা কারা? পরিস্কার সেটা, বিএনপি ও জামাত-শিবির। এদের কোনো ছাড় দেওয়া যাবে না। আমি এই লেখার শুরুতেই বলেছি, প্রয়োজনে আইন করে এই ধ্বংসযজ্ঞের সাজা মৃত্যুদ- করুন। আমি পরামর্শ দিবো সকল নামতার জন্য যদি এমন আইন করা সম্ভব না হয়, তা হলে অন্তত: পদ্মা সেতু, মেট্টো রেল, বঙ্গবন্ধু ট্যানেল, হাতির ঝিল ও এক্সপ্রেসওয়ে; এইসব অনন্য স্থাপনাগুলোর নিরাপত্তার জন্য আলাদা একটি আইন করার কথা ভাবুন। দেশের সাধারণ মানুষ এমন কোনো আইন করলে অবশ্যই পক্ষে থাকবে।
২১ জুলাই’২০২৪-এর পত্রিকা দেখার পর ইন্টারনেট চালু হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি আর কোনো পত্রিকাও সংগ্রহ করতে পারিনি, টেলিভিশন দেখার সুযোগ হয়নি। সোস্যাল মিডিয়াও বন্ধ ছিলো। কেবল এক দু’জনের কাছ থেকে মোবাইলে টুকটাক জেনেছি। আমার এই লেখায় বিশ্লেষন বলুন আর প্রতিক্রিয়া বলুন, সেই পর্যন্তই।
লেখক: আবদুল হামিদ মাহবুব, সিনিয়র সাংবাদিক, ছড়াকার। Email- [email protected]
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ