সাইফুর রহমান তুহিন
সিলেট বিভাগে ধারাবাহিক বন্যার পেছনের কারণসমূহ
সিলেট বিভাগে ধারাবাহিক বন্যার পেছনের কারণসমূহ
সুনামগঞ্জ জেলার সুলতানপুর গ্রামের রিকশাচালক সুমন মিয়ার টিনশেড ঘরখানা বন্যার পানিতে ভেসে যাওয়ায় তাকে সন্তানসহ সুনামগঞ্জ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছিলো। তার আয়ের একমাত্র মাধ্যম রিকশাটিও পুরোপুরি নষ্ট হয়ে যায়। আশ্রয় কেন্দ্রে পরিবারের সাতজন সদস্যসহ দুঃসহ এক সময় কেটেছে তার।
সুমন মিয়া একা নন। ব্যাপক বন্যার কারণে চলতি বছরে উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশের আনুমানিক বিশ লক্ষ লোকের জীবন ওলটপালট হয়ে গেছে। আর এটি হয়েছে একটানা কয়েক সপ্তাহ ভারী বৃষ্টিপাতের কারণে ঘরবাড়ি ও কৃষিজমি তলিয়ে
যাওয়ায়। এ ধরনের ঘটনা ঘটার প্রধান কারণ হলো একটানা প্রবল বৃষ্টিপাতের সাথে ভারত সীমান্তের উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢল। বিভিন্ন নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে এজন্যই।
২০২২ সাল থেকেই আকস্মিক বন্যার দুঃস্বপ্ন তাড়া করছে সিলেট বিভাগের লক্ষ লক্ষ মানুষকে। ভারতের মেঘালয় রাজ্যের চেরাপুঞ্জিতে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাত এবং এর থেকে সৃষ্ট পাহাড়ি ঢল থেকে সৃষ্ট ধ্বংসাত্মক বন্যা প্রত্যক্ষ করেছে উত্তর-পূর্ব বাংলাদেশ। ১৯৮৮ সালের পর এটিই ছিলো সবচেয়ে মারাত্মক বন্যা। এই দুটির মধ্যবর্তী বন্যাগুলো এতোটা ধ্বংসাত্মক ছিলো না। গত গ্রীষ্ম- বর্ষা মৌসুমে এমন বিপর্যয় কেউ দেখতে চায়নি।
গ্রানথাম রিসার্চ ইনস্টিাটউট অব ক্লাইমেট চেঞ্জ অ্যান্ড এনভাইরনমেন্ট এবং লন্ডন স্কুল অব ইকোনোমিক্স অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের এক সমীক্ষায় দেখা গেছে যে, সিলেট বিভাগের জনসংখ্যার আনুমানিক ৪৫ শতাংশ নদী থেকে সৃষ্ট বন্যার ঝুঁকিতে রয়েছে যা বৈশ্বিকভাবে সর্বোচ্চ হার। তাহলে কি একথা বলা যায় যে, উত্তর-পূর্র্ব বাংলাদেশে প্রবল বন্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে ? এর পেছনের কারণ কী ? এ অবস্থা হয়েছে মূলত:
জলবায়ু পরিবর্তনজনিত অসময়ে অস্বাভাবিক বৃষ্টিপাত, দূষণজনিত কারণে নদীগর্ভে পলিমাটির স্তর জমা হওয়া, অবৈধভাবে নদী দখল এবং অপর্যাপ্ত ড্রেনেজ সামর্থ্য।
একটি নিম্ন সমভূমির দেশ হিসেবে বন্যা বাংলাদেশে একরকম স্বাভাবিক ঘটনা। এদেশের আনুমানিক ৮০ শতাংশ ভূমিই বন্যাপ্রবণ এলাকার মধ্যে পড়ে এবং ছোট-বড় মিলিয়ে প্রায় ৭০০ নদী একেবারে জালের মতো ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে এদেশে। তদুপরি বাংলাদেশের দুই-তৃতীয়াংশ জায়গাই সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে মাত্র ৫ মিটার (১৬.৪ ফুট) উচ্চতায় অবস্থিত। আর এ কারণেই বন্যা এদেশে স্বাভাবিক বিষয়। কিন্তু গত প্রায় দেড় দশকের জলবায়ু পরিবর্তন বন্যাকে আরও তীব্র করে তুলছে এবং প্রায়ই এটি হচ্ছে অসময়ে। সাম্প্রতিক একটি সমীক্ষা থেকে জানা গেছে যে, কোনো একটি নির্দিষ্ট দিনে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বৃষ্টিপাত সিলেট অঞ্চলের প্রবল বন্যা ও জলাবদ্ধতার মূল কারণ।
উপরোক্ত সমীক্ষা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দেয় যে, জলবায়ু পরিবর্তন একই সাথে সিলেট বিভাগ এবং উত্তর-পূর্ব ভারতে বৃষ্টিপাতের স্বাভাবিক গতি-প্রকৃতি পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে। বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্র সর্বশেষ জুন মাসে সিলেট ও সুনামগঞ্জ জেলায় ১৯০০ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছে যা ইতিহাসে সর্বোচ্চ। আগের রের্ডটি ছিলো ১,৭৩৭ মিলিমিটার যা ২০২২ সালের জুন মাসে রেকর্ড করা হয়েছিলো।
তবে জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ গওহর নাঈম ওয়াহরা জোরালোভাবে দাবি করেন যে, বন্যার জন্য আমরা নিজেরা বহুলাংশে দায়ী হলেও দোষ চাপাচ্ছি জলবায়ু পরিবর্তনের ওপর। সংবাদমাধ্যমকে ওয়াহরা বলেন যে, “আমরাই তো বন্যা ডেকে নিয়ে আসছি। অপরিকল্পিত অবকাঠামো এবং অবৈধ স্থাপনার মাধ্যমে পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। ‘দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকায় ২০২২ সালের এক রিপোর্টে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন
বোর্ড (পাউবো)-র এক বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, ১১১ জন অবৈধ দখলদার সুরমা নদীর তীরের ৩.৬ কিলেমিটার জায়গা জুড়ে ২০০টি অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করেছে। এর ফলে এই এলাকায় নদীর নব্যতা এবং প্রশস্ততা দুটিই হ্রাস
পেয়েছে এবং বন্যার পানি ধারণ ক্ষমতাও কমে গেছে।
সাবেক প্রেসিডেন্ট এডভোকেট আবদুল হামিদের উদ্যোগে কিশোরগঞ্জের ইটনা, অষ্টগ্রাম ও মিঠামাইন উপজেলাকে সংযুক্ত করার জন্য হাওরের ওপর নির্মিত সড়কটিকে নিয়েও আছে বিতর্ক। দেশের অনেকেই বিশ্বাস করেন যে, এই
সড়ক নির্মাণের মাধ্যমে হাওরের পানির স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে এবং আকস্মিক বন্যার ঝুঁকি বেড়েছে। তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার বিষয়টি বুঝতে পারলেও এ ধরনের স্থাপনা নির্মাণ বন্ধের জন্য দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তবে কিছু কিছু বিশেষজ্ঞ বলে থাকেন যে, হাওরের ওপর নির্মিত সড়কটির কিছুটা দায় থাকলেও এটিই বন্যার একমাত্র কারণ নয়।
বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট)-এর পানি ও বন্যা ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউট-এর অধ্যাপক ড. তারেকুল ইসলাম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “হাওর এলাকায় অনেক সড়ক, ব্রিজ ও কালভার্ট নির্মিত হয়েছে। খালসমূহ ভরাট করা
হয়েছে এবং নদীগুলোও ভরাট করা হয়নি। এসব ইস্যু এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে কারণ, এটি একটি নতুন বিষয়। তবে নিয়মিত বন্যা হওয়াটা ক্রমবর্ধমান কিছু কর্মকান্ডের একটি প্রভাব।”
বাংলাদেশের মানচিত্রের উত্তরাংশ হিমালয় এবং মেঘালয় মালভূমি দিয়ে ঘেরা। উজান থেকে আচমকাই পলিমাটি নিয়ে পাহাড়ি ঢল নেমে আসে এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহকে বাধাগ্রস্ত করে। আর এর ফলে নদী, খাল ও জলাভূমিগুলো
পলিমাটিতে ভরে যায়। এমতাবস্থায় নদীতে নিয়মিত ড্রেজিং না করলে সেগুলো বাড়তি পানি ধরে রাখতে পারবে না। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার আগে আওয়ামী লীগ সরকারের পানিসম্পদ মন্ত্রী জাহিদ ফারুক বলেছিলেন যে, বন্যা প্রতিরোধে
সুরমা ও কুশিয়ারা নদীতে ড্রেজিং করা হবে। তবে দেশে ক্ষমতার হাতবদল হওয়ায় এখন অন্তবর্তী সরকারই ভরসা।
অন্যদিকে সুনামগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনস্থ ‘হাওর ও জলাভূমি সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (প্রথম পর্যায়’ প্রস্তাব দিয়েছিলো সুনামগঞ্জ জেলায় নদীতে ৪৪৩ কিলোমিটার ড্রেজিং এবং ১৩৯.৫৩ কিলোমিটার খাল খননের যাতে নদী ও খালগুলোর নাব্যতা বাড়ানো যায়। কিন্তু দুটিই এখন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী দীপক রঞ্জন দাস সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “বন্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য শুধু সুরমা ও কুশিয়ারায় ড্রেজিং করাটাই যথেষ্ট নয়। আমাদের সকলের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন কিন্তু এখন পর্যন্ত কোনো সমন্বিত উদ্যোগ দেখা যায়নি।”
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিসবাহ উদ্দিন সংবাদমাধ্যমকে বলেন যে, “ আমাদের দেশের ড্রেজিং সিস্টেম পুরোপুরি আদর্শ পদ্ধতি নয়। নদী ড্রেজিংয়ের বিজ্ঞানসম্মত কিছু পদ্ধতি আছে। এসব পদ্ধতির মাধ্যমে গাণিতিক প্রক্রিয়ায় সঠিক পরিমাণ নির্ণয় করা যায়। আর নদীর একটি নির্দিষ্ট জায়গায় ড্রেজিং করা কাংখিত ফল দিতে পারবে না। পুরো নদীকেই সমীক্ষার আওতায় প্রয়োজন রয়েছে।”
লেখক : সাইফুর রহমান তুহিন, সাংবাদিক ও ফিচার লেখক
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ