মুহম্মদ আব্দুস সামাদ
শিক্ষা, বিপ্লব, বিড়ম্বনা, আমজনতা
শিক্ষা, বিপ্লব, বিড়ম্বনা, আমজনতা।
আমার বড় দুঃখ হয় সদ্য উচ্চমাধ্যমিক শ্রেণী পাস করা তরুণ তরুণীদের জন্য। চলতি বছরের মে মাসে প্রকাশিত ফলাফল অনুযায়ী প্রায় ১২ লক্ষ শিক্ষার্থী এবছর উচ্চমাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষার পাস করেছে। এই শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে বেশিরভাগেরই বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ এবং কারিগরি মহাবিদ্যালয়গুলোতে ভর্তি হওয়ার কথা। টারশিয়ারি লেভেলে ট্রান্সিশনের এই মাহেন্দ্রক্ষণে এই বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থী পড়েছে এক সীমাহীন বিড়ম্বনায় আর পর্যবসিত হয়েছে গভীর হতাশায়।
দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতির কারণে এই শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ শিক্ষাজীবন একটা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়ে আছে। তারা এক ভয়ানক মানসিক পিড়ার মধ্য দিয়ে দিন যাপন করছে বলে আমার মনে হয়। এই গ্রুপটির শিক্ষাজীবন বরাবরই বেশ বিড়ম্বিত। বিশ্বব্যাপী করোনা মহামারীর সময়টাতে তাদের মাধ্যমিক মূল্যায়ন পরীক্ষার সময়কাল এসে উপস্থিত হয়। নজিরবিহীন এই মহামারীর ভয়াবহতায় তাদের শিক্ষাজীবন ব্যাপকভাবে বিপর্যস্ত হয়। এক গভীর লার্নিং লসের মুখোমুখি হয় এই গ্রুপটি। উচ্চমাধ্যমিক স্তরে ভর্তি প্রক্রিয়ার সময়টাতেও তারা করোনার ক্ষতিকারক প্রভাবের শিকার হয়। আর এখন এসে তারা আবার আরেকটা বিপর্যয়ের মুখে পড়লো বিশ্ববিদ্যালয়ের এন্ট্রির সময়টাতে।
দূর্ভাগ্য আমাদের বিপ্লবীরা জোর করে পদত্যাগ করানোতে ব্যস্ত। অটোপাশের দাবি দাওয়া নিয়ে ব্যস্ত। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দেয়ার ক্ষেত্রে কোন অগ্রাধিকার উদ্যোগ নজরে পড়েনা। ভয়ানক লার্নিং লস পূরণের আলাপ কোথাও দেখিনা। শিক্ষার্থীরা একটা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে দৃশ্যমানভাবে কিন্তু এখন তো তাদের কাজ না অফিসে অফিসে গিয়ে মাতব্বরি করা। তাদেরকে শ্রেণিকক্ষে ফিরিয়ে নেয়াটাই তো এই মুহুর্তে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হওয়া উচিত।
এদিকে বর্তমানে ষষ্ঠ শ্রেণীতে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীরা আরেক বিড়ম্বিত দল বলে মনে করি আমি। হঠাৎ করে একটা সম্পূর্ণ ভিন্নধর্মী আর নতুন কারিকুলামের পরীক্ষা নিরীক্ষার গিনিপিগ হয়ে ওঠে তারা। প্রচলিত মূল্যায়ন পদ্ধতি ওঠিয়ে দেয়া হয়। একটা নতুন মূল্যায়ন ব্যবস্থা চালু করা হয় যেটা নিয়ে বেশিরভাগ শ্রেনিশিক্ষকেরাই অনেকক্ষেত্রে স্পষ্ট ধারণা রাখেন না বলে প্রতীয়মান।
এই কারিকুলামটি প্রণয়ন করা হয়েছে বিশাল এক উচ্চাশা নিয়ে। প্রচলিত ধারার পঠন-পাঠন পদ্ধতি এবং মূল্যায়ন ব্যবস্থাকে পরিপূর্ণ ঢেলে সাজানো হয়েছিল নতুন শিক্ষাক্রমে। আমি ব্যক্তিগতভাবে খুবই এনজয় করছিলাম নতুন এই কারিকুলামটি। বিশেষত এর মূল্যায়ন প্রক্রিয়াটা ছিল অংশগ্রহণমূলক, যেটা আমাকে মুগ্ধ করেছিল। দুর্ভাগ্য হলো এই নতুন প্রক্রিয়াটি এবং ব্যবস্থাটি যারা বাস্তবায়ন করবেন তাদেরকে পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ এবং তাদের চিন্তাধারার মধ্যে পরিবর্তন আনার জন্য যে উদ্যোগ নেয়ার প্রয়োজন ছিল সেটা পর্যাপ্তভাবে নেয়া হয়নি।
মুখস্তবিদ্যানির্ভর মূল্যায়ন প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করে যারা আজকে শিক্ষকতা করছিলেন তাদের জন্য এই অংশগ্রহণমূলক মূল্যায়ন প্রক্রিয়া ছিল একটা ফালতু ব্যবস্থা। একই প্রক্রিয়ার ভেতর থেকে উঠে আসা অভিভাবকের মধ্যেও ছিল এটা নিয়ে বিরুপ প্রতিক্রিয়া। সারাদেশে একটা ব্যাপক হায় হায় রব পড়ে গিয়েছিল।
এধরনের নতুন মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ভুক্তভোগী আমি নিজেও। আমরা সনাতন পদ্ধতিতে 'বিভাগ' বা 'শ্রেণি' মূল্যায়ন ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলাম। আমরা যাদেরকে অধ্যাপক হিসেবে পেলাম তারাও একই পদ্ধতিতে অংশগ্রহণ করে এসেছেন তাদের ছাত্রজীবনে। দেখা গেল, গ্রেডিং সিস্টেমে তাদের দেওয়া মূল্যায়ন আমাদের ফলাফলের উপর ব্যাপক নেতিবাচক প্রভাব ফেলল। বিভাগ বা শ্রেনীতে শতকরা ৬০ ভাগ মার্কস পেলে প্রথম বিভাগ বা প্রথম শ্রেণীতে পাশ করা যায়। তো আমাদের শিক্ষকেরা দশ মার্কসের উত্তরে সর্বোচ্চ ছয় মার্কস দিলে মনে করতেন যে প্রথম বিভাগের মার্কস দিয়েছেন। এর ফলশ্রুতিতে গ্রেডিং সিস্টেমে আমরা পেতাম 'বি' গ্রেড। সেটা বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন এর সংজ্ঞা অনুযায়ী প্রথম বিভাগ/শ্রেণি হলেও শতকরা ৭৫ ভাগ মার্কস না পেলে উচ্চতর শিক্ষা, গবেষণা বা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতার জন্য বিবেচনায় নেয়া হয়না। 'বি' গ্রেড প্রাপ্ত অনেক মেধাবীরা শুধুমাত্র এই মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ভুলবোঝাবুঝির জন্য কর্মক্ষেত্রে বা উচ্চতর শিক্ষায় বৃত্তি/স্কলারশিপ প্রাপ্তিতে বিড়ম্বনায় পড়েছিলেন বলে জানি।
পরিবর্তনের জন্য সময় লাগে। আর সেটার জন্য গিনিপিগ কাউকে না কাউকে হতেই হয়। এটা প্রকৃতির নিয়ম। আমরা গিনিপিগ হয়েছি কারণ নতুন সিস্টেমে বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা ছিলাম শুরুর দিককার শিক্ষার্থী। যাদেরকে শিক্ষক হিসেবে পেয়েছিলাম তাদের অনেকের সাথে এই গ্রেডিং সিস্টেম এবং মূল্যায়ন নিয়ে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছে পরবর্তীতে। তারা অনেকেই বলেছেন এখন তারা আগের মত আর এভাবে কম মার্কস দেননা। সিস্টেম পরিবর্তন করার জন্য সময় লেগেছে। এটাই স্বাভাবিক।
দেশের একটা জনপ্রিয় আলোচনা হল নতুন পাঠ্যক্রমে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এটা এক গভীর নীলনকশা এবং ষড়যন্ত্রের অংশ। আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দেয়ার এক অশুভ তৎপরতা। অবশ্য এই কথাগুলো যারা বলেছেন তাদের বেশিরভাগই শিক্ষাক্রম বা শিক্ষা বিশেষজ্ঞ নন। তাদের বেশিরভাগই আমজনতা অথবা গুগল শিক্ষা বিশেষজ্ঞ। আমাদের নবনিযুক্ত শিক্ষা উপদেষ্টাও দেখলাম বলেছেন, ধাপে ধাপে তারা পুরনো শিক্ষাক্রমে ফিরে যাবেন। আমার প্রশ্ন, তাহলে কি পুরনো শিক্ষাক্রমটা সকল বিবেচনায় সকল মানদন্ডে অত্যন্ত উত্তম ব্যবস্থা ছিল? আর ফিরে যেহেতু যেতেই হবে তাহলে পুরনোটায় কেন? বর্তমান শিক্ষাক্রমের যে সমস্যাগুলো রয়েছে অথবা যে সমালোচনাগুলো রয়েছে সেগুলো শোধরে দিয়ে একটা উন্নত ব্যবস্থার দিকে গেলে সমস্যাটি কোথায়? পরিবর্তন যেহেতু করতেই হবে তাহলে উর্ধ্বমুখী পরিবর্তন নয় কেন? আমরা কেন পশ্চাৎমুখী হব?
আমার ছেলে ষষ্ঠ শ্রেণিতে অধ্যয়ন করে। এই পেতে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থার ব্যাপারে তার কাছে দেয়ার মত কোন জবাব আমার নেই! আমাকে সে নিয়মিতই প্রশ্নবানে জর্জরিত করে। আমরা বরাবরই পরীক্ষা-নিরীক্ষার গিনিপিগ হই। হয়ত এটাই আমাদের নিয়তি। আমার ছেলের বাবা হয়েছে আর এখন ছেলে নিজেও হবে এটাই যেন একটা বেদনার দুষ্টচক্র আমাদের জন্য। কিন্তু প্রতিরোধ করার জন্য আমাদের সেই শক্তি বা সামর্থ্য কোনটাই নেই। বংশপরম্পরায় আমরা গিনিপিগ।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কের অবনতি হয়েছে ভয়ংকররকমভাবে। শিক্ষকদের দলীয় লেজুড়বৃত্তি, কর্ম সম্পাদনে অবহেলা, শ্রেণীতে পাঠদানের বাইরে নিজেদের আখের গোছানোর কাজে সদা ব্যস্ত থাকা, আর প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকা শিক্ষকদের সীমাহীন দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি আর দলীয়করণ বিষিয়ে তুলেছিল মানুষকে। ক্ষমতার পালাবদলে মানুষ এটার শোধ নিচ্ছে। অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে দলকানা শিক্ষকদের ব্যাপারে ছাত্রছাত্রীরা সোচ্চার হয়ে উঠেছে। শিক্ষকদের লিখে দেওয়া সাদা কাগজের পদত্যাগপত্র গ্রহণ না করে ধমকের সুরে বলছে এটাতে হবে না, আমরা লিখে নিয়ে আসব টাইপ করে সেটাতে আপনি স্বাক্ষর করবেন। আর কোথাও কোথাও অন্য শিক্ষক নারী শিক্ষককে হাত ধরে টেনে হিচড়ে চেয়ার থেকে উঠিয়ে ফেলে দিচ্ছেন। হয়তো নিজেরা চেয়ার দখল করবেন বলে। নারী-পুরুষ নির্বিশেষে একদল আরেকদলকে হটিয়ে দিচ্ছেন জোরপূর্বক। এ যেন এক পাল্টাপাল্টি দখলদারিত্বের খেলা।
শিক্ষার্থী এবং শিক্ষকদের মুখোমুখি দাঁড় করানোর পেছনে কেউ না কেউ কলকাটি নাড়ছে বলে আমার মনে হয় আমার। এরকম ষড়যন্ত্র এবং প্রতারণা আগে ছিল, এখনো আছে, ভবিষ্যতেও থাকবে। এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতেই পঠন-পাঠন কার্যক্রম পরিচালিত হবে। এই শিক্ষার্থীরাই থাকবে এইসব প্রতিষ্ঠান। তারা হয়তো গ্রেজুয়েশন নিয়ে অন্যত্র চলে যাবে। এই শিক্ষকরাও থাকবে। তারা এদেরকেও পড়াবে ভবিষ্যতে যারা আসবে তাদেরকেও পাঠদান করবেন। যাদের বিরুদ্ধে আজকে অবস্থান তাদের কেউ কেউ হয়তো থাকবেন না। কিন্তু তাদেরকে টেনে নামানোর পেছনে অন্য যেসব শিক্ষকরা ইন্ধন দিচ্ছেন তারা থাকবেন। তারা শ্রেণীকক্ষে গিয়ে কিভাবে মুখ দেখাবেন? আর যদি আরেকবার পালাবদল হয় তাহলে তাদের অবস্থা কি হবে?
তাই আমি বলি এই পাল্টাপাল্টি অবস্থা থেকে নিজেদেরকে সরিয়ে রাখুন। একটা জাতীয় কমিশন গঠন করেন। সবাই মিলে কিছু ক্রাইটেরিয়ায় একমত হোন। কিছু আশু, স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদী এবং দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করুন। সেগুলো ধাপে ধাপে বাস্তবায়ন করুন। এমন একটা সিস্টেম দাঁড় করান যাতে আপনারা না থাকলেও অন্যরা সেটা চালিয়ে নেয়। ছাত্র শিক্ষককে মুখোমুখি দাঁড় করাবেন না প্লিজ। সংস্কারের ম্যানডেট নিয়ে এই নয়া সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে সেটার প্রতিফলন ঘটুক সর্বত্রই।
৯০ এর গণ আন্দোলনে দেশের প্রায় সকল মতের, সকল দলের ঐকমত্য ছিল স্বৈরাচারের পতনের ব্যাপারে। সর্বাত্মক গণআন্দোলনে স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল। ১৯৯১ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত আমরা গণতান্ত্রিক রূপান্তরের চর্চাগুলো দেখেছি। আমরা গভীর হতাশায় নিমজ্জিত হয়েছি। এক স্বৈরাচারের পতন হয়েছিল ঠিকই, কিন্তু বারবার স্বৈরাচারেরা ফিরে ফিরে এসেছে তাদের স্বৈরাচারী হিংস্র রুপ নিয়ে। এরশাদ সাহেব বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জামাত ইসলামের উপস্থিতিতে পার্লামেন্টে বলেছেন, আমাকে দয়া করে স্বৈরাচার বলবেন না। শুনলে বড় কষ্ট পাই। পরবর্তী সরকারগুলোকে স্বৈরাচারী অভিহিত করে বলেছেন, এইগুলো দেখার জন্য কি ক্ষমতা ছেড়েছিলাম? প্রয়াত জেনারেল এরশাদের এই কথার তাৎপর্য অনেক গভীর।
১৯৯০ সালের পরে প্রায় ৩৫ বছর মানুষ বিরক্ত হতাশ হয়ে আরেকটি গণঅভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারকে বিদায় করেছেন। আমরা "রিসেন্সি এরোর" এ ভুগি। উপস্থিত ঘটনার আলোকে আমরা পূর্বাপর সফলতা বা বিফলতাকে ভুলে গিয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে উপনীত হয়ে যাই খন্ডিত বিশ্লেষণে। দেশের শাসনক্ষমতায় অধিষ্ঠিত সর্বশেষ সরকারের সীমাহীন দুর্নীতি গোয়ার্তুমি এবং দলীয়করণ সহ্যের শেষ সীমায় পৌঁছেছিল। তাই বলে অতীতের অপরাপর সরকারগুলো যে আমাদের খুব আশার আলো দেখিয়েছিলেন তা কিন্তু নয়। সবাই মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। গত ৩৫ বছরে জমা হওয়া ক্ষোভের বিস্ফোরণ হয়েছে ২০২৪ সালের জুলাই মাসে। সুতরাং সর্বশেষ ক্ষমতাসীন দলকে বা সরকারকে কেবল অভিসম্পাত না করে গেল প্রায় ৩৫ বছরের জমানো আবর্জনা নিয়ে কথা বলতে হবে। না হলে ইতিহাস এবং বাস্তবতার খন্ডিত বিশ্লেষণ হবে। আরেকবার আমরা রিসেন্সি এররের ভুলে অবমূল্যায়ন করব বাস্তবতার।
৯০ এর স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল আমাদের ছাত্রসমাজ। ক্ষমতার পালাবদলে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের স্পিরিট ভলুণ্ঠিত হয়েছে বারবার। ছাত্র-জনতার আত্মত্যাগ মূল্যায়িত হয়নি। বরং তাদের রক্তের উপর ভর করে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষার বিপরীতে অবস্থান নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলো নব্য স্বৈরাচার হিসাবে আবির্ভূত হয়েছে।
১৯৫২ সালে ভাষার জন্য আন্দোলন করেছিল আমাদের দেশের ছাত্রসমাজ। স্বাধীনতার ভিত্তি রচনা করেছিল তারা। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের স্পিরিটের উপর ভিত্তি করে ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হয়। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকা রাজনৈতিক দল এবং সামরিক স্বৈরাচারীরা ভাষা আন্দোলন কিংবা মুক্তিযুদ্ধের স্পিরিট এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলেন।
সমাজতন্ত্র এবং গণতন্ত্র এই দুই ধারার দুই বিষয় নিয়ে একটি জগাখিচুড়ি সংবিধান প্রণয়ন করা হলো। আর পরবর্তীতে ৭২ এর সংবিধানের ধোয়া তুলতে তুলতে বিষয়টাকে তেতো করে ফেলা হলো। যে দল যখন ক্ষমতায় আসলো অথবা সামরিক স্বৈরাচারীরা যারা ক্ষমতা দখল করলো তারা নিজেদের সুবিধামতো সংবিধানকে কাটাছেঁড়া করল। দেশের সংবিধান হয়ে গেল একটা দলীয় স্বার্থ সুরক্ষার ব্যাপার। অথবা ব্যক্তির স্বার্থসিদ্ধির একটা হাতিয়ার। রাষ্ট্র হয়ে গেল এখানে গৌণ।
২০২৪ সালের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের পরের সরকার আমরা দেখছি এখন। প্রধান উপদেষ্টা তার নিজস্ব পরিচিত, অধীনস্ত কর্মচারী, পরিবারের সদস্য, সাবেক সহকর্মী এবং ব্যক্তিগত অনুগত লোকদের নিয়ে পরিষদ সাজিয়েছেন। যুক্তির খাতিরে মানতে চাই, সরকার পরিচালনার জন্য বিশ্বস্ত এবং ভরসা করার মত মানুষ তার আশপাশে থাকা দরকার। এবং 'বিশ্বস্ততা' এবং 'আস্থা' অর্জনের সুযোগ হিসেবে পুরনো সহকর্মী, অধীনস্থ কর্মচারী, নিজ শ্রেণিকক্ষে পাওয়া সাবেক ছাত্র, অথবা একসাথে মাঠে লড়াই করা সহযোগী, অথবা আড়াল থেকে সাহায্য করা শুভাকাঙ্ক্ষী তাদের বিশ্বস্ততা এবং আস্থার পুরস্কার হিসেবে উপদেষ্টা পরিষদে এসেছেন। সেটা নিয়ে আপত্তি নেই। তবে ভাবার বিষয় আছে, যে সুযোগগুলো উনারা গ্রহণ করলেন অথবা যে সুবিধাটুকু উনাদেরকে দেয়া হলো এই সুযোগের বাইরে পরিষদ গঠনে আরো অন্তর্ভুক্তিমূলক এবং ন্যায়পরায়ণতার সূচক ব্যবহার করা যেত কিনা। এই ছাত্র আন্দোলন এবং সংস্কার দাবির পেছনে দুটো নীতি কাজ করেছে বলে আমার মনে হয়। একটা হল ইনক্লুসিভনেস আরেকটা হলো ইকুইটি। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের পথচলায় এই নীতিগুলো কথাটা প্রতিফলিত হচ্ছে সেটা বিশ্লেষণের বিষয়।
যে তারুণ্য এই বিপ্লব সফল করেছে তাদের মধ্য থেকে দুইজনকে উপদেষ্টা পরিষদে নিয়ে অন্যদেরকে সান্ত্বনা দেয়া হয়েছে আর আমার মনে হয় একটা বাহবাও পাওয়ার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদে বাদবাকী বেশিরভাগই বয়োবৃদ্ধ মানুষ। একাধিকজন তো মনে হয় আশি বছরের মাইলফলক ছুঁয়েছেন। দেশ পরিচালনায় যদি আপনারা অশিতিপর বৃদ্ধদের উপরেই নির্ভর করবেন তাহলে এই তরুণ তরুনীদের ক্লাসরুমে ফিরাচ্ছেন না কেন? ওদেরকে আর কত ব্যবহার করবেন? ওরা বিপ্লব সফল করেছে এখন সংস্কার উদ্যোগ নেন আপনারা। তাদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগের একটা রুপরেখা প্রকাশ করেন।
মানুষ নাকি ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয়। আমাদের ছাত্র-যুব-তরুণ সমাজ বারবার প্রতারিত হয়েছে। তাদের আন্দোলনের ফসল অন্যরা ঘরে তুলেছে। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই জাতি। ২০২৪ সালের ছাত্র গণঅভ্যুত্থানের ফসল যেন স্বার্থান্বেষীরা তাদের ঘরে না তুলতে পারে সেই ব্যাপারে সকলকে সজাগ থাকতে হবে।
একটা সুন্দর এবং শ্রেয়াতর অবস্থার স্বপ্ন দেখি। আমার দেশ কারো ক্রিড়ানকে পরিণত হবে না সেটা চাই। সকলের মঙ্গল হোক।
লেখক- মুহম্মদ আব্দুস সামাদ, সাবেক পরিচালক, আরডিআরএস বাংলাদেশ
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ