সাইফুর রহমান তুহিন
সিলেটের পর্যটন শিল্পকে গতিশীল করতে হলে
ছবি- আই নিউজ
বাংলাদেশের পর্যটন মানচিত্রে চট্টগ্রাম বিভাগের পরেই অবস্থান সিলেট বিভাগের। সৃষ্টিকর্তা শুধু সমুদ্র সৈকত ছাড়া প্রায় সবকিছুই দিয়েছেন এখানে। এ কারণেই ছুটির দিনে বাংলাদেশের অন্য বিভাগগুলো এমনকি দেশের বাইরে থেকেও পর্যটকরা ভিড় জমান সিলেট, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ জেলায়। আর এর ফলে বাড়তি আয় করে এখানকার হোটেল মোটেল, গেস্ট হাউস, রিসোর্ট ও রেস্তোরাঁগুলো।
তবে বর্তমানে সিলেটের বেশ গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয় নিয়ে কিন্তু আমরা তুলনামূলক কম ভাবছি। সিলেট মহানগরীর আশপাশে একটু কম দূরত্বের বিনোদন কেন্দ্রের অভাব বর্তমানে প্রকট আকার ধারণ করেছে। অথচ নগরীর কর্মব্যস্ত লোকজন কিন্তু ছুটির দিনে এবং বিশেষ উপলক্ষে পরিবার নিয়ে ঘুরতে যেতে চান নগরীর কাছাকাছি কোনো বিনোদন স্পটে।
এক যুগ আগেও ছুটির দিনগুলোতে কর্মজীবী মানুষের খুব বড় ভরসা ছিলো এক্সেলসিয়র সিলেট (সাবেক জাকারিয়া সিটি) এবং এবং পর্যটন মোটেল সিলেট-এর ওয়াচ টাওয়ারগুলোর সাথে সংলগ্ন বিনোদন পার্কটি। পর্যটন মোটেলে পাহাড়ের চূড়ায় ওয়াচ টাওয়ারে বসে ওসমানী বিমানবন্দরের প্লেনের ওঠানামা দেখার পাশাপাশি চারপাশের নয়নাভিরাম পাহাড়ি দৃশ্য আর ভারতের মেঘালয় পাহাড়ের সৌন্দর্য দেখা ছিলো দুই চোখের জন্য দারুণ প্রশান্তির। আর এক্সেলসিয়র সিলেটে পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগের পাশাপাশি বালক- বালিকা ও কিশোর-কিশোরীদের উপযোগী চমৎকার সব রাইডে চড়েছি আমাদের মতো প্রাপ্তবয়স্ক অনেকেই। এর সাথে ছিলো মিনি চিড়িয়াখানায় চমৎকার সব বন্যপ্রাণী দর্শন। অথচ এখন দুটি জায়গায়ই অবশিষ্ট নেই নির্মল বিনোদনের তেমন কোনো মাধ্যম। বিষয়টি খুবই হতাশাব্যঞ্জক এবং এটি নিয়ে গুরুত্বসহকারে ভাবার সময় এসেছে। নগর জীবনের একঘেয়েমি কাটাতে কম দূরত্বের মধ্যে কমপক্ষে ৪/৫টি আকর্ষণীয় বিনোদন স্পট গড়ে তোলার জন্য বেসরকারি ও সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। বেসরকারি উদ্যোক্তাদেরকে সহজ শর্তে ব্যাংক ঋণ দিলে তারা উৎসাহিত হবেন।
এবার দৃষ্টিপাত করা যাক সিলেট বিভাগের দারুণ জনপ্রিয় পর্যটন কেন্দ্র টাঙ্গুয়ার হাওরের প্রতি। সুনামগঞ্জ জেলার সীমান্তবর্তী তাহিরপুর উপজেলায় অবস্থিত নয়নাভিরাম এই হাওরের বিস্তীর্ণ জলরাশি, আকাশছোঁয়া ভারতের মেঘালয় পাহাড় আর শীতকালে হাজার হাজার মাইল দূর থেকে আসা অতিথি পাখির কলকাকলি দেশের ও বিদেশের যেকোনো পর্যটককেই হাতছানি দিয়ে ডাকে। ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা গৌতম ঘোষের আলোচিত ‘মনের মানুষ’ চলচ্চিত্রের বড় একটি অংশের শুটিং হয়েছিলো টাঙ্গুয়ার হাওরেই। এটি এমন এক জায়গা যেখানে বেড়ানোর কোনো নির্দিষ্ট মৌসুম নেই আর এ কারণে বছরজুড়ে পর্যটকে বোঝাই হয়ে থাকে জায়গাটি। সিলেট বিভাগের অনেক পর্যটক বিশেষ করে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা খুব সকালে হাওরের পথে রওনা হয়ে ভ্রমণ শেষে সূর্যাস্তের আগে আবার নিজ ঠিকানায় রওনা হয়ে যান। তবে দূর-দূরান্ত থেকে বেড়াতে আসা অনেক পর্যটক সেখানে রাত্রিযাপন করতে চান এবং এক্ষেত্রে তাদের প্রধান ভরসা হলো হাওরে ভাসমান নজরকাড়া সব হাউসবোট। ভ্রমণের পাশাপাশি থাকা ও খাওয়ার প্রয়োজন মেটায় হাউসবোটগুলো।
তবে দুঃখজনক হলেও সত্য যে, এসব হাউসবোটের যাবতীয় বর্জ্য সরাসরি হাওরে ফেলে দেওয়া হয় যা রীতিমতো উদ্বেগজনক। এমনিতেই হাওরটি একটি সংবেদনশীল ইউনেসকো হেরিটেজ সাইট তার ওপর সাঁতার জানা অনেক পর্যটক সেখানে গোসল করেন এবং সাঁতার কাটেন। এ কারণেই হাওরে একটি সমন্বিত বর্জ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি। যদি আমরা এ বিষয়ে উদাসীন হই তাহলে ভবিষ্যতে হাওরের বিশাল জলরাশি এবং এর মধ্যে থাকা জলজ প্রাণি ও উদ্ভিদের অস্তিত্ব নিঃসন্দেহে হুমকির কবলে পড়বে। সিলেট বিভাগীয় প্রশাসন এবং সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসন এই ইস্যুতে যৌথভাবে কাজ করলে সমস্যাটির সমাধান খুব কঠিন হওয়ার কথা নয়। আর হাওরে অপচনশীল দ্রব্যাদি যেমন- প্লাস্টিকের বোতল, পলিথিনের প্যাকেট প্রভৃতি যত্রতত্র ফেলে দেওয়ার জন্য শাস্তির ব্যবস্থা অবশ্যই থাকা উচিত। আমরা খেয়াল করেছি যে, কিছু কিছু পরিবেশ সচেতন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র হাওরে যাওয়ার সময় অপচনশীল দ্রব্য রাখার জন্য একটি প্লাস্টিকের বস্তা সাথে নিয়ে যান এবং ফেরার সময় ভরা বস্তাটি সাথে নিয়েই ফেরেন। এটিকে সবার জন্য নিয়মে পরিণত করে দিলেই তো সমস্যার সমাধান হয়ে যায়।
আবার ফিরে আসি সিলেটের পর্যটনে। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের পর থেকেই ভারতের দুই উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য আসাম ও মেঘালয়ের সাথে স্থল সীমান্ত রয়েছে সিলেটের। মেঘালয়ের সাথে অতোটা না হলেও আসামের সাথে সিলেটের রয়েছে ধর্মগত, ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক সাদৃশ্য। আসামের সরকারি ভাষা অসমীয়ার সাথে ভালোই মিল আছে সিলেটের আঞ্চলিক ভাষার। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার যেসব জায়গার সাথে আসামের স্থল সীমান্ত আছে সেসব এলাকার বাংলাদেশিদের সাথে আত্মীয়তার সম্পর্ক রয়েছে আসামের অনেক মুসলিম পরিবারের। আসামের নাগরিকদের অনেকেই সিলেট তথা বাংলাদেশে বেড়নোর আগ্রহ দেখান। কেউ কেউ তো সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে যেতে চান এদেশের সেরা ট্যুরিস্ট স্পটগুলোতেও।
২০২২ সালের নভেম্বর মাসে এমন কিছু মানুষকে দিয়ে বড় একটি সারপ্রাইজ দেয় সিলেটের একটি সুপরিচিত ট্যুর অপারেটর প্রতিষ্ঠান। আসাম রাজ্যের ২৪ জন অবসরপ্রাপ্ত স্কুলশিক্ষককে ১০ দিনের সফরে বাংলাদেশে নিয়ে আসে প্রতিষ্ঠানটি। এই ১০ দিনে ২৪ জন পর্যটক ঘুরে দেখেন বিশ্বের দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার, রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা, চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ড উপজেলার পাহাড়ি এলাকা এবং রাজধানী ঢাকা নগরীর উল্লেখযোগ্য কিছু জায়গা।
সফর শেষে তারা নিজেদের শতভাগ সন্তুষ্টির কথা জানিয়ে দেশে ফিরে যান। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, উত্তর-পূর্ব ভারতে বাংলাদেশ ভ্রমণে আগ্রহী পর্যটক আছেন। থাকারই কথা। উত্তর-পূর্ব ভারতের সাতটি রাজ্যই স্থলবেষ্টিত এবং সমুদ্র দেখতে হলে তাদেরকে সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে পশ্চিমবঙ্গের কোনো সৈকতে যেতে হবে যা একই সাথে অনেক কষ্টকর ও ব্যয়বহুল। আর এই সুযোগটি মোটেই হাতছাড়া করা উচিত নয় আমাদের। সিলেটের ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সাথে আসামের বৃহত্তম নগরী গুয়াহাটির লোকপ্রিয় গোপীনাথ বর্দোলোই বিমানবন্দরের সরাসরি বিমান যোগাযোগ খুলে দিতে পারে পর্যটন সম্ভাবনার এক নতুন দিগন্ত। এর ফলে বাংলাদেশ ও উত্তর-পূর্ব ভারতের মধ্যে পর্যটক বিনিময়ের পাশাপাশি কিছুটা আমদানি-রফতানির মাধ্যমে লাভবান হতে পারেন দু’দেশের ব্যবসায়ীরাও। উত্তর-পূর্ব ভারতে যেমন বাংলাদেশের শাকসবজি, মাছ, সী-ফুড, আচার সামগ্রী প্রভৃতির বাজার রয়েছে তেমনি সেই এলাকা থেকে আমরা আনতে পারি আসামের বিশ্ববিখ্যাত চা, মসলা, ওষুধি উদ্ভিদ প্রভৃতি দরকারি জিনিস। অন্যদিকে সিলেটের যেসব চক্ষু রোগী চিকিৎসার জন্য গুয়াহাটির বিখ্যাত শংকর নেত্রালয়ে যান তারাও সিলেট-গুয়াহাটি-সিলেট ফ্লাইট থেকে বেশ উপকৃত হবেন। আশাকরি আমাদের বেসামরিক বিমান চলাচল ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সিলেট-গুয়াহাটি-সিলেট রুটে ফ্লাইট পরিচালনার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করে দেশের অর্থনীতিতে নতুন মাত্রা যোগ করবে।
লেখক: সাইফুর রহমান তুহিন, সাংবাদিক ও ভ্রমণ লেখক এবং উপদেষ্টা, সিলেট ট্যুরিস্ট ক্লাব।
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ