ডা. মো. আশফাক উল আলম
আপডেট: ১৬:১৪, ৩০ এপ্রিল ২০২২
মৃত্যু থেকে ফিরে আসা এক মায়ের গল্প
বুধবার (২৭ এপ্রিল) সকালে অপারেশনের উদ্দেশ্যে একজন রোগী আমাদের অটি সহকারীর সাথে অপারেশন থিয়েটারে হেঁটে আসছিলেন। এটি নিত্যদিনের একটি নৈমত্তিক দৃশ্য হয়ে থাকলেও এই বিশেষ রোগিকে এরকম স্বাভাবিকভাবে হেঁটে আসতে দেখাটা ছিলো বিস্ময়কর আনন্দের।
উনার সাথে কথা বললাম, কথায় কোন জড়তা নাই, দৃষ্টিতে কোন সমস্যা নাই, নাই কোন নব্যসৃষ্ট দুর্বলতা। অপারেশন পূর্ব পরীক্ষায় Pulse, Blood pressure, Breathing, Oxygen saturation সবকিছু স্বাভাবিকই পেলাম।
অথচ মঙ্গলবার (২৬ এপ্রিল) ঠিক এই সময়টাতেই সাক্ষাৎ যমদূতের সাথে লড়াই চলছিলো এই রোগীর। গাইনী কনসালটেন্ট ডা. ইসমাত জাহান ম্যাডামের কল পেয়ে ৩য় তলায় গাইনী লেবার রুমে এই রোগীকে যখন দেখতে গেলাম, তখন গাইনীর আরেক কনসালটেন্ট ডা. ফারজানা পর্ণা ম্যাডাম CPR (Cardiopulmonary resuscitation - হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে গেলে বুকে চাপ দিয়ে এবং কৃত্রিম শ্বাস প্রদানের মাধ্যমে শরীরে রক্তসঞ্চালন পুনঃস্থাপনের প্রক্রিয়া) দিচ্ছিলেন। কেননা রোগী Gasping করতে করতে ততক্ষণে Cardiac arrest-এ (হার্ট পাম্প করা বন্ধ করে দেয়া) চলে গিয়েছিলো।
রোগীর বাড়িতেই normal delivery হয়েছিলো ঘন্টা দুয়েক আগে, সাথে third degree perineal tear and retained placenta নামক জটিলতা দেখা দেয়ায় তখন থেকেই রোগীর অবিরত রক্তক্ষরণ হচ্ছিলো।
বরাবরের মতো হাসপাতালে নেয়া নিয়ে দুই পরিবারের ঝগড়া জনিত সময়ক্ষেপণ শেষে রোগী যখন হাসপাতালে এসে পৌঁছুলো তখন সে একদম paper white anaemic। মুখ একদম pale, হাত পা cyanosed, পালস less feeble, প্রেশার non recordable, পিউপিল dilated and only slightly responsive to light। তাঁর সাথে চিকিৎসা সংক্রান্ত কোন কাগজ এমনকি রক্তের গ্রুপটা পর্যন্ত করানো নাই।
রোগী আসার পরপরই placenta (জরায়ু ফুল) টি বের করে ফেলতে পারলেও তার আগেই শরীরে রক্তের পরিমাণ এতোই কমে গিয়েছিলো যে রক্তের নমুনা সংগ্রহ এবং ক্যানুলা করতে অনেক বেশি বেগ পেতে হয়েছিলো। Venepuncture (সার্জারীর মাধ্যমে রক্তনালীতে পথসৃষ্টির প্রক্রিয়া)-এর জন্য সার্জারীর সিনিয়র কনসালটেন্ট ডা. আবু বকর মোস্তফা স্যারকে ইনফর্ম করা হয়েছিলো।
আমি CPR দেওয়ার সময় এনেসথেসিয়ার কনসাল্টেন্ট ডা. আবু রায়হান স্যারও অতিদ্রুত সেখানে উপস্থিত হোন এবং resuscitation-এ দিক নির্দেশনা দেওয়ার পাশাপাশি তাতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। Volume expander, hartman solution, inotrope, oxygenation চলছিলো সমানতালে। নার্সরা ছিলেন পর্যাপ্ত এবং তাদের অবদান ছিলো দারুণ। অটি টেকনিসিয়ান ও আয়ারাও ছিলেন সক্রিয়ভাবে উপস্থিত । ধীরে ধীরে রোগীটার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া এবং শ্বাস-প্রশ্বাস নেয়ার প্রবণতা ফিরে আসে। capillary refill time কমতে থাকে আর skin texture পাল্টাতে থাকে যা রোগীর রক্ত সঞ্চালনের পুনরারম্ভ কে নির্দেশ করে । ধীরে ধীরে পালস, প্রেশার এর ও অস্তিত্ব জানান দিতে শুরু করে।
এমন সময় রোগীর রক্তের গ্রুপের রিপোর্ট আমরা জানতে পারি। নিরুপায় অভিভাবকদের কাছে না ছিলো কোন রক্ত দাতা, না ছিলো রক্ত কেনার পর্যাপ্ত টাকা। রক্তের গ্রুপ মিলে যাওয়ায় ডা. ইসমাত ম্যাম তখন রক্ত দিতে ইচ্ছা প্রকাশ করলেও ডা. রায়হান স্যারের তাৎক্ষণিক খেয়াল হলো শহরের রয়্যাল ক্লিনিকে ২ থেকে ৩ ব্যাগ একই গ্রুপের রক্ত মজুদ থাকার কথা এবং তাদের কে ফোন দেয়া মাত্রই দ্রুততম সময়ের মধ্যে তারা সেগুলো ব্যবস্থা করে ফেলে। একারণে তাদের প্রতিও আন্তরিক কৃতজ্ঞতা।
অবশেষে রোগী যখন রেসপন্স করা শুরু করে এবং হিমোডাইনামিক্যালি স্ট্যাবল হয় তখন আমরা সিস্টার দের পরবর্তী নির্দেশনা বুঝিয়ে দিয়ে দুই তলায় অপারেশন থিয়েটারে নেমে আসি।
আসলে চিকিৎসা পেশা যে কোথায় কত বিস্ময় নিয়ে অপেক্ষা করছে তা বোঝা কঠিন। এধরণের সিচুয়েশন থেকে রোগী বেঁচে ফিরে আসলে এবং তার চিকিৎসায় অবদান রাখতে পারলে চিকিৎসক হওয়ার আনন্দ তীব্রভাবে অনুভূত হয়। তবে ক্রিটিক্যাল সিচুয়েশন ডিল করতে টিম ওয়ার্কের কোন বিকল্প নাই। একারণেই যেকোন ইমার্জেন্সী ম্যানেজমেন্টের প্রথম কাজই হলো 'Call For Help' যেটা মেনে চলা যেমন জরুরী তেমনি তাতে রেসপন্স করাও কর্তব্য। সর্বোপরি রোগীর হায়াৎ ছিলো আর সৃষ্টিকর্তার কৃপা ছিলো বলেই রোগীটা আবার স্বাভাবিক জীবন ফিরে পেতে সক্ষম হয়েছে।
প্রতিটা চিকিৎসকের জীবনেই এরকম দিন প্রায়ই আসে, বিশেষ করে আইসিইউ আর অটিতে যারা কাজ করেন তারা প্রায়ই এই ধরনের সিচুয়েশন মোকাবেলা করে থাকেন।
তবু সীমিত সামর্থ্যের একটা জেলা সদর হাসপাতালে এরকম মরণাপন্ন রোগী সুস্থ হয়ে পরেরদিন অপারেশন থিয়েটারে হেঁটে হেঁটে আসার দৃশ্যটার আনন্দ অন্য মাত্রার।
একটি কথা দিয়ে শেষ করতে চাই, আমাদের এই হাসপাতালটিতে কিছুদিন আগেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন লাইন স্থাপন করা হয়। আর এই ব্যবস্থাটি ছিলো বলেই ওয়ার্ডের পাশের লেবার রুমে এরকম রোগীকে প্রয়োজনীয় উচ্চমাত্রার অক্সিজেন সাপ্লাই করা সম্ভব হয়েছে। একারণে স্থানীয় কর্তৃপক্ষ এবং সরকারের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই।
এর পাশাপাশি হাসপাতালের ব্লাড ব্যাংকের কার্যক্রম অতি শীঘ্র সচল করার আহবান জানাই।
ডা. মো. আশফাক উল আলম, অ্যানেসথেসিয়া চিকিৎসক, মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতাল
আইনিউজ ভিডিও
বৃদ্ধ বয়সে নামাজ পড়তাম, ঘরে বসে খাইতাম, কে খাওয়াবে! | বৃদ্ধের কষ্ট
শবে বরাত ভাগ্যরজনীর রাত, যে রাতে আল্লাহ মানুষের রিযেক-ধনদৌলত-আয়ু দান করেন
- ঢাকার হানিফ, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন, সিলেটের ছিলেন কামরান
- নৌযান দুর্ঘটনায় পরিবারকে হারানো সেই মিমের দায়িত্ব নিলেন ব্যারিস্টার আহসান হাবীব
- পুলিশের চোখের জলে উন্মোচন হল জোড়া খুনের রহস্য
- ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত বানাতে চা শ্রমিক মায়ের অদম্য যুদ্ধের গল্প
- পুলিশ কর্মকর্তার ডায়েরি-২
জাদরেল বাবার দুই মেয়ে অপহরণের নাটকীয় কাহিনী - গ্রামের কবরে ঠাঁই দিতে এক করোনাযোদ্ধার আর্তি
- রোজাদার রিকশাওয়ালাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করলেন প্রভাবশালী পথচারী
- হাসি ভরা মুখ নিয়ে ভাইরাল কানাডার যুবক
- কষ্ট লাঘবকারি চিকিৎসার আকুতি চিকিৎসকের
- সেই রিকশাচালকের চোখের পানি আনন্দাশ্রুতে পরিণত করলেন এক তরুণ ব্যারিস্টার