সালেহ উদ্দিন আহমেদ
আপডেট: ১৬:৫৬, ১০ আগস্ট ২০২২
পুলিশ কর্মকর্তার ডায়েরি-২
জাদরেল বাবার দুই মেয়ে অপহরণের নাটকীয় কাহিনী
গ্রাফিক্স- আইনিউজ
‘আমার আব্বু খুবই। রাগী সময়ে অসময়ে আমাদের মারতো পড়াশোনার জন্য। এতোটাই চাপ দিত আমি ক্লাসে প্রথম স্থান অর্জন করি, যে দ্বিতীয় হয় তার চেয়ে আমার মার্ক ছিল পঞ্চাশের বেশি। আব্বু বলে পার্থক্য কেন একশোর বেশি হলোনা। উনি চাইতো আমরা বাংলাদেশের সবাইকে যেন টপকে যাই। এক সময় আব্বুর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে আমি মিতাকে বলি চল আমরা পালিয়ে যাই।’
আমি দীর্ঘদিন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় কর্মরত ছিলাম। ১৯৯৯ থেকে ২০০২। আমি মুলতঃ চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা শাখায় জটিল কিছু মামলা তদন্ত করি এবং অর্জন করি বিচিত্র অভিজ্ঞতা।
২০০১ সালে দুটি মেয়ে অপহরণ মামলার নথি পাই। ঘটনা ১৮ মাস আগের। মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখলাম একজন প্রকৌশলী (বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার বুয়েট) উনার বাসা পাঁচলাইশ থানা এলাকায়। তিনি এজাহার দায়ের করেছেন, তাঁর মেয়ে রিতা (১৩) ও মিতা (৬) কে তিন চার জন শিশু অপহরণকারী ভারতে বিক্রয়ের উদ্দেশ্যে ইচ্ছার বিরুদ্ধে অপহরণ করে নিয়ে যায়। উনার লিখিত এজাহারের উপর ভিত্তি করে পাঁচলাইশ থানায় মামলা রুজু করা হয়।
এই অপহরণ মামলাটি আমার পূর্বে আরও দুই জন জাদরেল পুলিশ অফিসার দেড়বছর তদন্ত করেছেন। কয়েকজনকে শিশু অপহরণ সংক্রান্তে গ্রেফতার করে রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। কোন কুল কিনারা করতে পারেননি। আমি মামলার নথি পর্যালোচনা করলাম। মামলার নথি পর্যালোচনা করে পূর্ববর্তী তদন্তকারী কর্মকর্তা বৃন্দের কর্মকাণ্ড নথিতে পড়ে হতাশ হলাম। মামলার নথি পর্যালোচনা করে বুঝতে পারলাম মামলার বাদী প্রকৌশলী তদন্তকারী কর্মকর্তা কে কোন সাহায্য সহযোগিতা করেননি।
রিতা ক্লাস সেভেনে এবং মিতা ক্লাস ওয়ানে পড়তো। দুই জনের রোল নাম্বার-১। আমি রিতা মিতার বাবাকে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম দীর্ঘদিনেও উনার আদরের মেয়ে দুটি উদ্ধার না করায় উনি ডিবি পুলিশের উপর প্রচন্ড ক্ষুব্ধ। পুলিশ কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তা উনাকে জানালাম।
প্রকৌশলীকে উনার স্ত্রীর উপস্থিতিতে জিজ্ঞাসাবাদ করলাম। দীর্ঘদিন উনি নিজে মেয়েদের উদ্ধারের জন্য কিকি করেছেন, এর উত্তরে তিনি জানান এলাকার মসজিদে মাইকিং করেছেন। চারবার প্রেস কনফারেন্স করেছেন। আজমীর গিয়ে খাজা মঈনুদ্দিন চিশতির মাজার, হযরত শাহজালাল শাহপরান মাজার সহ বিভিন্ন মাজারে মানত করেছেন। জিয়ারত করেছেন দোয়া করেছেন।
আমি উনাকে বললাম আপনি মেয়েদের উদ্ধারের জন্য কয়টি শিশু সদনে গিয়েছেন? কয়টি মেয়েদের স্কুলে গিয়েছেন? কত জায়গায় মেয়েদের ছবি বিতরণ করছেন। সীমান্তের কয়টি চেকপোস্ট ও কয়টি ইমিগ্রেশনে যোগাযোগ করেছেন। তিনি জানান তিনি এমন কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।
আমি ২/৩ দিন চিন্তা করে করনীয় নির্ধারণ করলাম। সকল ইমিগ্রেশন-সহ সকল চেকপোস্টে ছবি সহ বার্তা প্রেরণ করলাম। টংগীস্হ শিশু শোধনাগারসহ বাংলাদেশের সকল শিশু শোধনাগারে মেয়েদের ছবি সহ পত্র প্রেরণ করলাম। চট্টগ্রামের সকল প্রাইমারী স্কুল ও গার্লস স্কুলে ছবি সহ পত্র প্রেরণের জন্য জেলা শিক্ষা অফিসার চট্টগ্রাম কে ১০০ কপি ছবি প্রিন্ট করিয়ে পত্র দিয়ে বিশেষ অনুরোধ করলাম। জেলা পাসপোর্ট অফিসে মেয়েদের ছবি দিয়ে তাদের নামে বা ছবি দিয়ে কোন পাসপোর্ট ইস্যু হয়েছে কি না জানতে পত্র দিলাম। পারিপার্শ্বিক স্বাক্ষ্য প্রমান নিলাম। জানা গেল প্রকৌশলী মহােদয় প্রচন্ড বদরাগী ও একরোখা প্রকৃতির লোক। তাঁর ভয়ে স্ত্রী সন্তান তটস্থ ভীত ও সন্ত্রস্ত হয়ে থাকতো। পাড়া প্রতিবেশী কারো সাথে কোন সুসম্পর্ক ছিল না। তিনি তাঁর ব্যাবসা প্রতিষ্ঠানের মালিক।
সাতদিন পর ডবলমুরিং থানাধীন কদমতলীর একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক ফোনে জানান ছোট মেয়েটি তাঁর স্কুল ২য় শ্রেণির ছাত্রী। তাঁর পিতার নাম নেই অভিভাবক শওকত আলী সাং কদমতলী। সাথে সাথে স্কুলে গিয়ে মেয়েকে উদ্ধার করলাম। প্রধান শিক্ষক জানান "মিতা তো ধনাঢ্য ব্যাবসায়ী শওকত আলী সাহেবের আশ্রিত হিসাবে আছে মর্মে আমরা সবাই জানি, গত বাৎসরিক পরীক্ষায় মিতা প্রথম স্হান অর্জন করলে শওকত আলী সাহেব একটি গরু জবাই করে বাসায় অনুষ্ঠান করেন"
আমি শওকত আলী সাহেবের বাসায় গিয়ে বড় মেয়ে রিতাকেও পেলাম। দুই মেয়েকে উদ্ধার করে শওকত আলী সাহেব সহ অফিসে আসলাম। ইতিমধ্যে প্রকৌশলী সাহেব দুনিয়ায় সব সাংবাদিক নিয়ে হাজির হলেন। সকল সাংবাদিক বৃন্দের সাথে প্রকৌশলী উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করে শিশু পাচারকারী শওকত আলী সাহেবের বিচার দাবী করছিলেন।
পরদিন শওকত আলী সাহেবকে এবং মেয়েদের কোর্টে উপস্থাপন করা হলো। নারী ও শিশু নির্যাতন আইনের মামলার আসামি শওকত আলী সাহেবকে জেলখানায় পাঠানো হলো। একজন ম্যাজিস্ট্রেট মেয়েদের জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদের জবানবন্দি লিপিবদ্ধ করলেন। মেয়েদের জবানবন্দি দেখে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের জজ সাহেব ভিকটিমদের ও তদন্তকারী কর্মকর্তার উপস্থিতিতে আসামীর জামিন শুনানির দিন ধার্য করলেন।
রিতা ও মিতাকে জজ সাহেবের সামনে উপস্হাপন করা হলো চট্টগ্রাম কোর্টে পিন পতন নিরবতা। জজ সাহেব বিস্তারিত ঘটনা খুলে বলতে বললেন। রিতা বলতে থাকে, " আমার আব্বু খুবই রাগী সময়ে অসময়ে আমাদের মারতো পড়াশোনার জন্য এতোটাই চাপ দিত আমি ক্লাসে প্রথম স্হান অর্জন করি, যে ২য় হয় তার চেয়ে আমার মার্ক ছিল পঞ্চাশের বেশি। আব্বু বলে পার্থক্য কেন একশোর বেশি হলোনা। উনি চাইতো আমরা বাংলাদেশের সবাইকে যেন টপকে যাই। এক সময় আব্বুর অত্যাচারে অতিষ্ট হয়ে আমি মিতাকে বলি চল আমরা পালিয়ে যাই। মিতা রাজি হয়। আমরা পরদিন সকালে বাসা থেকে একসাথে বেরিয়ে পরি সারাদিন চট্টগ্রাম শহরে ঘুরতে ঘুরতে সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে আসি ঢাকায় যাওয়ার জন্য। এসময় কিছু বাজে লোক আমাদের পিছু নেয়। বিষয়টি দেখে ৩/৪ জন লোক আমাদের উদ্ধার করে শওকত আলী সাহেবের বাসায় নিয়ে আসে। শওকত আলী সাহেব ও উনার স্ত্রী জিজ্ঞাসা করলে আমরা বলি আমার আব্বু ২য় বিয়ে করেছে আমাদের অসুস্থ আম্মু কে ঔষধের সাথে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে মেরে ফেলেছে। আমাদেরও মেরে ফেলবে এই ভয়ে আমরা পালিয়ে এসেছি। আমাদের বানিয়ে বলা গল্প শওকত আলী সাহেবের বাসার সবাই বিশ্বাস করে আমাদের আশ্রয় দেয়। উনাকে আমরা আব্বু বলে ডাকতাম উনার স্ত্রী কে আম্মু বলে ডাকতাম। উনার পরিবারের ছেলেমেয়েদের সাথে উনি একই কাপড় চোপড় কিনে দিতেন। আমাদের জন্মদিন পালন করতেন। মিতার জন্য গরু জবাই করে অনুষ্ঠান করেছেন। আব্বু যদি আম্মু কে সম্মান করে উগ্র আচরণ না করে সুস্থ সুন্দর জীবনের প্রতিশ্রুতি দেন। আমাদের কে পড়াশোনার জন্য মারপিট না করার প্রতিশ্রুতি দেন তাহলে আমরা বাসায় যাব নইলে শওকত আলী সাহেবের বাসায় চলে যাব।"
আইনিউজে আরও পড়ুন-
- যাত্রাপালার শিল্পী ও দর্শক-শ্রোতা : অতীত থেকে বর্তমান
- বাবু ফকিরের আশ্রম, গান শিখলে ফাউ মিলে মুড়ি, শিঙারা
- এ পি জে আব্দুল কালাম: ‘দ্য মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’
কোর্টে একজন আর একজনের মুখের দিকে তাকাচ্ছিল। প্রকৌশলী কাঁদছিল আর মাথা ঠুকছিলো। রিতা মিতার আম্মু কাঁদছিল। নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের জজ আসামীর জামিন মঞ্জুর করলেন। প্রকৌশলীকে মুচলেকা সম্পাদন করতে নির্দেশ প্রদান করলেন। তদন্তকারী কর্মকর্তা কে "চৌকস তদন্ত কর্মকর্তা" আখ্যা দিয়ে আদেশনামা সম্পাদনা করলেন। পরবর্তীতে মামলায় চুড়ান্ত রিপোর্ট ঘটনার ভুল বোঝাবুঝি দাখিল করা হলো।
আমি জানি না মেয়ে দুটি এখন কতো বড় হয়েছে বা কি করছে। এ সত্য ঘটনা শুনে যার যা শিক্ষা নেয়া উচিৎ তা নিয়ে নিন। একটি ঘটনা মানুষকে অনেক কিছু শিক্ষা দেয়।
সালেহ উদ্দিন আহমেদ,অতিরিক্ত পুলিশ সুপার
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- ঢাকার হানিফ, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন, সিলেটের ছিলেন কামরান
- নৌযান দুর্ঘটনায় পরিবারকে হারানো সেই মিমের দায়িত্ব নিলেন ব্যারিস্টার আহসান হাবীব
- পুলিশের চোখের জলে উন্মোচন হল জোড়া খুনের রহস্য
- ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত বানাতে চা শ্রমিক মায়ের অদম্য যুদ্ধের গল্প
- পুলিশ কর্মকর্তার ডায়েরি-২
জাদরেল বাবার দুই মেয়ে অপহরণের নাটকীয় কাহিনী - গ্রামের কবরে ঠাঁই দিতে এক করোনাযোদ্ধার আর্তি
- রোজাদার রিকশাওয়ালাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করলেন প্রভাবশালী পথচারী
- হাসি ভরা মুখ নিয়ে ভাইরাল কানাডার যুবক
- কষ্ট লাঘবকারি চিকিৎসার আকুতি চিকিৎসকের
- সেই রিকশাচালকের চোখের পানি আনন্দাশ্রুতে পরিণত করলেন এক তরুণ ব্যারিস্টার