সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন
আপডেট: ২১:৩৩, ২১ আগস্ট ২০২২
ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত বানাতে চা শ্রমিক মায়ের অদম্য যুদ্ধের গল্প
সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন ও তাঁর মা
২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে উপজেলায় মাকে সম্মাননা দেওয়া হবে বলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জানানো হয়। পরে মায়ের নামটা কেটে দেওয়া হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মা আমার চা শ্রমিক। স্টেজে উঠে নাকি কিছু বলতে পারবেন না। তাই নাম কেটে দিয়েছে!
মৌলভীবাজারের শমসেরনগরে ফাঁড়ি কানিহাটি চা-বাগানের এক চা শ্রমিক পরিবারের ছেলে আমি। জন্মের ছয় মাসের মাথায় বাবাকে হারিয়েছি। মা চা-বাগানের শ্রমিক। তখন মজুরি পেতেন দৈনিক ১৮ টাকা।
সেই সময় আমাকে পটের দুধ খাইয়ে, অন্যের বাসায় রেখে মা যেতেন বাগানে কাজ করতে। ২০০৭ সালে আমি ক্লাস ফাইভে পড়ি। মায়ের মজুরি তখন ৮৮ টাকা। একদিন বললেন, ‘বাজারে গিয়ে পাঁচ কেজি চাল নিয়ে আয়।’ সেই চাল দিয়ে এক মাস চলেছে আমাদের। পরদিন সকালে স্কুলে যাওয়ার আগে দেখি মা চাল ভাজলেন। পলিথিনে সেই ভাজা চাল, আটার রুটি আর লাল চা একটা বোতলে ভরে গামছায় প্যাঁচালেন। আর আমাকে আটার রুটি ও লাল চা দিলেন।
দুপুরে খেতে গিয়ে দেখি শুধু পেঁয়াজ, শুকনা ভাত, তেল আর লবণ আছে। তা দিয়ে মেখে খেলাম। রাতেও কোনো তরকারি ছিল না। তখন পাশের বাসার কাকু আমাকে ডেকে কুমড়া আর আলু দিয়েছিলেন, যা দিয়ে আমরা দুইটা দিন পার করেছিলাম।
তখন কুপি বাতির আলোয় পড়তাম। মা আগেই প্রস্তুত করে দিতেন কুপিবাতি। তেল শেষ হয়ে গেলে আর পড়া হতো না। ওদিকে দোকানদার বাকিতে তেল দিতেন না। পঞ্চম শ্রেণির পর ভর্তি পরীক্ষায় পাস করে ক্যামেলিয়া ডানকান ফাউন্ডেশন স্কুলে পাঁচ বছরের জন্য ফ্রি পড়ালেখার সুযোগ পাই। মা অনেক খুশি হয়েছিলেন। তখন তাঁর সামান্য আয়ের একটা অংশ থেকে আমাকে টিফিন খাওয়ার জন্য প্রতি সপ্তাহে ৭০-৮০ টাকা দিতেন।
২০১৩ সালে বিএএফ শাহীন কলেজে ভর্তি হই। তখন মা ১০২ টাকা করে মজুরি পেতেন। এই সময়ে তিনি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে কিস্তি তুলে আমার ভর্তির টাকা, ইউনিফর্ম আর বই-খাতা কিনে দিয়েছিলেন। ২০১৪ ডিসেম্বর। মায়ের হাতে টাকা নেই। তখন এইচএসসির রেজিস্ট্রেশন চলছিল। মা ৫০ টাকার একটা নোট দিয়ে চোখের জল ফেলতে ফেলতে বলেছিলেন, ‘কেউ ধার দেয়নি রে বাপ।’ কলেজের এক শিক্ষকের কাছ থেকে ধার নিয়ে সেবার রেজিস্ট্রেশন ফি দিয়েছিলাম।
এইচএসসির পর এলো ভর্তি পরীক্ষার কোচিং। মা তখন আবার লোন নিলেন গ্রামীণ ব্যাংক থেকে। লোনের কিস্তির জন্য এই সময় মা বাড়ি থেকে অনেক দূরে গিয়ে বালু শ্রমিক হিসেবে কাজ করতেন। বিনিময়ে পেতেন ৩০০ টাকা। আমি জানতাম ঘরে চাল নেই। শুধু আলু খেয়েই অনেক বেলা কাটিয়েছিলেন মা।
অদম্য সংগ্রামী সেই মায়ের সঙ্গে ঢাবি শিক্ষার্থী সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ পেলাম। মা তখন কী যে খুশি হয়েছিলেন! কিন্তু ভর্তির সময় যত ঘনিয়ে আসছিল, মায়ের মুখটা তত মলিন দেখাচ্ছিল। কারণ চা-বাগানে কাজ করে যা পান তা দিয়ে তো সংসারই চলে না। ভর্তির টাকা দেবেন কোথা থেকে। পরে এলাকার লোকজন চাঁদা তুলে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে সহায়তা করল।
বিশ্ববিদ্যালয়ে টিউশনি করেই চলতাম। হলের ক্যান্টিনে ২০ টাকার সবজি-ভাত খেয়েই দিন পার করেছি। অনেক দিন সকালে টাকার অভাবে নাশতাও করতে পারিনি। দুর্গাপূজায় কখনো একটা নতুন জামা কিনতে পারিনি।
২০১৮ সালে শ্রেষ্ঠ মা হিসেবে উপজেলায় মাকে সম্মাননা দেওয়া হবে বলে ইউনিয়ন পরিষদ থেকে জানানো হয়। পরে মায়ের নামটা কেটে দেওয়া হয়েছিল। খোঁজ নিয়ে জেনেছি, মা আমার চা শ্রমিক। স্টেজে উঠে নাকি কিছু বলতে পারবেন না। তাই নাম কেটে দিয়েছে!
মা এখনো প্রতিদিন সকালে একটা বোতলে লবণ, চা-পাতা ভর্তা, আটার রুটি, সামান্য ভাত পলিথিনে ভরে নিজের পাতি তোলার গামছায় মুড়িয়ে নিয়ে দৌড়ান চা-বাগানে। আট ঘণ্টা পরিশ্রম করে মাত্র ১২০ টাকা মজুরি পান! এই মজুরিতে কিভাবে চলে একজন শ্রমিকের সংসার?
আজকাল মায়ের শরীর আর আগের মতো সায় দেয় না। বলেন, ‘তোর চাকরি হইলে বাগানের কাজ ছেড়ে দেব।’ আমি এখন সেই দিনের প্রতীক্ষায় আছি....
সন্তোষ রবিদাস অঞ্জন, চা শ্রমিক সন্তান
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী
আইনিউজে আরও পড়ুন-
- মৌলভীবাজারে বঙ্গবন্ধু : খুঁজে পাই পিতার পদচিহ্ন (ভিডিও)
- দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: ইতিহাসে ভিন্নরকম এক সঙ্গীতায়োজন
- এ পি জে আব্দুল কালাম: ‘দ্য মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- ঢাকার হানিফ, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন, সিলেটের ছিলেন কামরান
- নৌযান দুর্ঘটনায় পরিবারকে হারানো সেই মিমের দায়িত্ব নিলেন ব্যারিস্টার আহসান হাবীব
- পুলিশের চোখের জলে উন্মোচন হল জোড়া খুনের রহস্য
- ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত বানাতে চা শ্রমিক মায়ের অদম্য যুদ্ধের গল্প
- পুলিশ কর্মকর্তার ডায়েরি-২
জাদরেল বাবার দুই মেয়ে অপহরণের নাটকীয় কাহিনী - গ্রামের কবরে ঠাঁই দিতে এক করোনাযোদ্ধার আর্তি
- রোজাদার রিকশাওয়ালাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করলেন প্রভাবশালী পথচারী
- হাসি ভরা মুখ নিয়ে ভাইরাল কানাডার যুবক
- কষ্ট লাঘবকারি চিকিৎসার আকুতি চিকিৎসকের
- সেই রিকশাচালকের চোখের পানি আনন্দাশ্রুতে পরিণত করলেন এক তরুণ ব্যারিস্টার