Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, রোববার   ২০ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৭ ১৪৩২

মাহমুদুল হক

প্রকাশিত: ১৪:২৫, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
আপডেট: ১৪:৫৬, ২৭ এপ্রিল ২০২৪

গৃহহারা ফুটবলার বীথির সুখের ঠিকানা

আছিয়া খাতুন বীথিদের ২ শতক জমিসহ একটি ঘর বুঝিয়ে দিচ্ছেন জেলা প্রশাসক।

আছিয়া খাতুন বীথিদের ২ শতক জমিসহ একটি ঘর বুঝিয়ে দিচ্ছেন জেলা প্রশাসক।

কিছুদিন আগের কথা। অফিসের ডাক ফাইল দেখছিলাম। একটি দরখাস্তের শেষে চোখ আটকে গেল । দরখাস্তটি আবার পড়লাম, নামটি পড়লাম কয়েকবার। পরিচিত মনে হচ্ছে। স্মরণ করার চেষ্টা করলাম দরখাস্তকারীকে চিনি কিনা। আমি নয় শুধু, খেলাধুলার খবর যারা রাখেন তাদের অনেকেই  তাকে চিনতে পারেন। তিনি বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের অন্যতম একজন সদস্য আছিয়া খাতুন বীথি। ২০০৪ সাল হতে ২০১৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলে খেলেছেন।

একটি ঘর তাদের দেখানো হলো। ঘর দেখে তারা ফিরে আসলো অফিসে। জানতে চাইলো এই ঘর এই জমি তাদের দেয়া হবেতো? আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ানোর পর দুইবোন আবারো অঝোরে অশ্রু ঝরাতে  লাগলো। এ যেন নিমিষেই বুক থেকে জগদ্দল পাথর নেমে যাওয়ার অশ্রু...

দরখাস্তের বিষয়বস্তু দেখে মনে হলো তার সাথে কথা বলা দরকার। তাকে খবর দেয়া হলো।  তিনি সহসাই একদিন এলেন তার বড় বোন সাথীকে নিয়ে। সাথীও ফুটবলার ছিলেন। জেলা পর্যায়ে খেলতেন। কখনো বীথি কখনো সাথী কথা বলছে, আমি নীরবে শুনে যাচ্ছি। কথা শুনতে শুনতে লক্ষ্য করলাম তাদের দুজনেই কাঁদছে। তাদের বেড়ে উঠা, ফুটবলের প্রতি অদম্য ইচ্ছা , সামাজিক বাঁধা বিপত্তি, জীবনের বাঁকে বাঁকে নানা সংগ্রাম , মায়ের ক্যান্সারের সাথে লড়াই, মেয়েদের নিয়ে পিতার স্বপ্নবুনন,  দারিদ্র্যের পথে ক্লান্তিকর  যাত্রা, সবকিছুর নীরব শ্রোতা আমি। 

বীথিদের ফুটবলার হয়ে উঠার গল্পটাও মসৃণ ছিলোনা। নিকটাত্মীয়দের কটুক্তি সহ্য করেও তাদের পিতা-মাতা ফুটবল খেলায় উৎসাহ যুগিয়েছেন। জাতীয়  দলের হয়ে দেশে-বিদেশে কত কত ফুটবল ম্যাচ খেলেছে মেয়েটি। জীবনের খেলায় ম্রিয়মাণ বীথির সামনে শুধুই হতাশা আর ঘোর অমানিশা। এখনকার জাতীয় দলের ফুটবলাররা অনেক পরিচিত । নারী ফুটবলও এখন অনেক জনপ্রিয়। কিন্তু নারী ফুটবল জনপ্রিয় করার পেছনে অনেক ত্যাগ আর কষ্ট  রয়েছে আছিয়া খাতুন বীথিদের। তার পিতা-পিতামহ নারায়ণগঞ্জ সদরের কাশীপুর ইউনিয়নের বাসিন্দা হলেও কবে যে ভিটেমাটি বিক্রি করে ভাড়া বাড়িতে বসবাস শুরু করেছে সেটা এখন তার পিতাও মনে করতে পারেন না। 

May be an image of 11 people, people playing American football and people playing football


বীথির বাবা একসময় অটোরিকশা চালানো শুরু করেন। বয়সের কারণে এখন সেটাও সম্ভব হয়না। ক্যান্সার আক্রান্ত মা বিছানায়, অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেনা। মরার উপর খাড়ার ঘা হলো প্রতি মাসে ৬ হাজার টাকা বাসা ভাড়া গুণতে হয় তাদের। তাও অন্য পরিবারের সাথে শেয়ার করে ছোট্ট বাসায় থাকতে হয়। মায়ের চিকিৎসার খরচ যুগিয়ে  মাস শেষে বাসা ভাড়া যোগানো প্রায় অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা যাপিত জীবনের সীমাহীন কষ্টের বর্ণনা দিচ্ছিলো চোখের জলের অঝোর ধারায়। এখন বীথির চাওয়া একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই, একটু আশ্রয়।  

দীর্ঘ সময় তাদের সাথে কথা বললাম। বীথিদের আদিনিবাস নারায়ণগঞ্জ সদর উপজেলার কাশীপুর ইউনিয়ন। সেখানেই আমাদের একটি আশ্রয়ণ প্রজেক্ট রয়েছে। সদরের উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে কথা বলে তাৎক্ষণিকভাবে বীথিদের কাশীপুর পাঠালাম। একটি ঘর তাদের দেখানো হলো। ঘর দেখে তারা ফিরে আসলো অফিসে। জানতে চাইলো এই ঘর এই জমি তাদের দেয়া হবেতো? আমি সম্মতিসূচক মাথা নাড়ানোর পর দুইবোন আবারো অঝোরে অশ্রু ঝরাতে  লাগলো। এ যেন নিমিষেই বুক থেকে জগদ্দল পাথর নেমে যাওয়ার অশ্রু, এ অশ্রু যেন মহামূল্যবান কোন সম্পদ হারিয়ে যাওয়ার বহু যুগ পর ফিরে পাওয়ার আনন্দাশ্রু। ওরা দ্রুতই ঘরে উঠতে চাইলো।মনে হয় আর একদিনও তারা বাসা ভাড়া টানতে চায়না।

আমরাও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিজস্ব ভাবনার ফসল আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরহীন মানুষের  তালিকায় তাদের অন্তর্ভুক্ত করে নিলাম। অবৈধ দখলদারদের হাত থেকে খাসজমি উদ্ধার করে কাশীপুর আশ্রয়ণ প্রকল্পের ঘরগুলো নির্মাণ করা হয়েছে। এখানে প্রতি শতক জমির বাজারমূল্য প্রায় ২৫ লক্ষ টাকা। আমরা আছিয়া খাতুন বীথিদের ২ শতক জমিসহ একটি ঘর বুঝিয়ে দিলাম। তাদের স্থায়ীভাবে বন্দোবস্ত দেয়ার কাজটিও প্রক্রিয়াধীন। 

তারা স্বপ্নেও ভাবেনি এত দ্রুততম সময়ে ৫০ লক্ষ টাকা মূল্যের জমিসহ একটি পাকা ঘর পেয়ে যাবে। সে সময়ে বীথিসহ তার পরিবারের যে সুখানুভূতি ছিল সেটি পৃথিবীর কোন ভাষায় প্রকাশ করা অসম্ভব। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আশ্রয়ণের মাধ্যমে সারাদেশে লক্ষ লক্ষ নিরাশ্রয় গৃহহারা পরিবারকে এভাবেই সুখের ঠিকানা উপহার দিয়েছেন।


লেখক : মাহমুদুল হক, জেলা প্রশাসক, নারায়ণগঞ্জ

[ লেখাটি লেখকের ফেসবুক টাইমলাইন থেকে নেওয়া ]

Green Tea
সোশ্যাল মিডিয়া বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়