মিহিরকান্তি চৌধুরী
শ্রদ্ধা ও স্মরণ : অধ্যক্ষ প্রফেসর গোলাম রসুল
সিলেট সরকারি কলেজের (মুরারিচাঁদ কলেজ) প্রাক্তন অধ্যক্ষ প্রফেসর গোলাম রসুল শুধু একজন শিক্ষক, শিক্ষা প্রশাসক বা শিক্ষাবিদই ছিলেন না, সিলেটের শিক্ষাঙ্গনে বহুমাত্রিক অবদান রাখা দুচারজন ব্যক্তিত্বের একজন। উদ্ভিদবিজ্ঞানে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করা এককালের মেধাবী ছাত্র পরবর্তীকালের মনস্বী শিক্ষক ও শিক্ষাবিদ, দক্ষ প্রশাসক। একটা প্রশ্ন হল, উদ্ভিদবিজ্ঞানের জ্ঞান দিয়ে শিক্ষকতা করা যায়, প্রশাসন কীভাবে চালানো যেতে পারে। একথাটা বিভিন্ন পেশার প্রশাসকদের বেলায়ও প্রযোজ্য।
পদার্থবিজ্ঞান, রসায়নবিজ্ঞান, ভূগোল, গণিত ইত্যাদি বিষয়ের ডিগ্রিধারীরা কীভাবে প্রশাসন চালান, সংশ্লিষ্ট বিষয়জ্ঞান তো কোনও কাজে লাগার কথা নয়। আসলে সেই জ্ঞান কাজে লাগে। কীভাবে? সংশ্লিষ্ট বিষয়ের স্নাতক, স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিতে গিয়ে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে যে কয়টি বছর কাটান সেই সময়কালে যে মূল্যবোধের চর্চা হয় সেটা দিয়েই একজন ব্যক্তি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, বীমা প্রতিষ্ঠান, শিল্প প্রতিষ্ঠান চালান। প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারও তা দিয়ে দক্ষতার সাথে কলেজ চালিয়েছেন। তাঁর মূল্যবোধ এতই বিশ্বজনীন ছিল যে জাতি, ধর্ম, বর্ণ, দল, গোত্র নির্বিশেষে শিক্ষক বা শিক্ষা প্রশাসক হিসেবে অধ্যক্ষের ভূমিকায় সকলের সাথে সমান আচরণ করতেন। রাজনৈতিক, আদর্শিক বা ধর্মীয় কোনও মানদণ্ডে প্রভাবিত হতেন না। আগামীকাল ১১ মে এই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিত্বের ২০তম মৃত্যুবার্ষিকী। তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি এবং এই সমাজেরই একজন হিসেবে তাঁর অবদানের কথা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি। পরম করুণাময় স্রষ্টা তাঁর পারলৌকিক মঙ্গল করুন।
প্রফেসর গোলাম রসুল সিলেট রেফারেন্ডামের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার নিকট সাক্ষী ছিলেন। ১৯৪৭ সালে সুনামগ্জ মহকুমার তাহিরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া, দেশভাগের পরপরই বেশ কিছু শিক্ষকের দেশত্যাগের ফলে সৃষ্ট শিক্ষক শূণ্যতাজনিত কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি এমসি কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর পদে থেকেও ব্যবহারিক ক্লাসের অতিরিক্ত নিজ যোগ্যতা বলে নিয়মিত ক্লাস গ্রহণ করে শিক্ষক শূণ্যতার মতো জটিলতার নিরসন করেন।
মেধাবী ছাত্র যে ছিলেন তা তো স্পষ্ট ছিল। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৫০ সালে উদ্ভিদবিদ্যায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি এমএসসি অর্জন করেন। প্রথম শ্রেণিতে দ্বিতীয়। অসাধারণ রেজাল্ট। এরপর ১৯৫১ সালে সিলেট সরকারি এম,সি কলেজে ১৯৫১ সালে প্রভাষক হিসেবে শিক্ষকতা জীবন শুরু করেন। পরবর্তীকালে তিনি সিলেট সরকারি কলেজে (১৯৬৪ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত মুরারিচাঁদ কলেজ ‘সিলেট সরকারি কলেজ’ নামে চালু ছিল) অধ্যক্ষের পদ অলংকৃত করেন ১৯৮০ সালে। এই কলেজে তিন বছর অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন শেষে ১৯৮৩ সালে সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণ করেন। সরকারি চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর তিনি থেমে যাননি। নতুন কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায়। শক্ত হাতে ভিত্তি গড়ে দেবেন এমন লোকের অভাব। প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার মইনউদ্দিন আদর্শ মহিলা কলেজ ও ব্রিটিশ বাংলাদেশ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দুটি প্রতিষ্টানের প্রতিষ্টালগ্ন থেকে এগুলোর শক্ত ভিত্তি গড়ে দিয়ে পরবর্তী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের পথ সুগম করে দেন। এর পর শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম কোষাধ্যক্ষ হিসেবে এই বিশ্ববিদ্যায়ের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প পরিচালক ও প্রথম উপাচার্য প্রফেসর সদরউদ্দীন আহমেদ চৌধুরীর সিলেকশনের প্রশংসা করতে হয়। তিনি এত বিচক্ষণ ছিলেন যে জানতেন কাকে আনতে হবে, কাকে দিয়ে কী হবে। প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার কোষাধ্যক্ষ হিসেবে যোগ দিলেন। বিভিন্ন বিভাগে শিক্ষক হিসেবে আনলেন প্রফেসর এম.এ. রকিব, প্রফেসর অরুণকুমার বসাক, প্রফেসর ইসমাইল হোসেন, প্রফেসর খলিলুর রহমান, প্রফেসর মোহাম্মদ হাবিবুর রহমান, প্রফেসর মুহাম্মদ জাফর ইকবালসহ আরও অনেক কৃতবিদ্য পণ্ডিতজনকে। প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারসহ এ্সকল পণ্ডিতদের পুরো টিমওয়ার্ক এই বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যায়তনিক ভিত্তি দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান সুনামের আঁতুড়ঘর বা সূতিকাগার হচ্ছে এই গোল্ডেন গ্রুপের জ্ঞান ও প্রজ্ঞার প্রয়োগ ও নিরন্তর আন্তরিক প্রচেষ্টা। এসকল কৃতবিদ্য ব্যক্তিত্বকে বিশ্ববিদ্যালয়টি কতটুকু মনে রেখেছে বা রাখছে তা ন্যায়নিষ্ঠ ও সংগতিপূর্ণ জিজ্ঞাস্য হতে পারে। অবসরের পর তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার বারো বছর সেবা দেন, অবদান রাখেন সিলেটের শিক্ষাঙ্গনে এবং অবশ্যই তার গুণগত মান বৃদ্ধিতে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী ও সিলেট-১ সংসদীয় আসনের সাংসদ আবুল মাল আব্দুল মুহিতকে আলোকিত সিলেটের স্বপ্নদ্রষ্টা বলা হয়। এ চিন্তাধারায় কতটুকু আলোকিত করতে পেরেছেন তিনি সিলেটকে জানি না। তবে বিশ্বাসের একটা কথা বলি। অধ্যক্ষ প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারের মতো প্রসারিত হৃদয় ও মস্তিষ্কসম্পন্ন কয়েকজন ব্যক্তিকে পেলেও তাঁর এই প্রকল্প সার্থকতা লাভ করত। মুহিত সাহেব নিজেও স্যার সম্বন্ধে এক জায়গায় বলেছেন, “আলোকিত ব্যক্তিত্ব শুধু শিক্ষিত বা পন্ডিত ব্যক্তি নন। আলোকিত ব্যক্তিত্বের অধিকারীকে সমাজসচেতন, নানা বিদ্যায় পারদর্শিতা, নৈতিক নিষ্ঠা, পরোপকারে নিবেদিত এই ধরনের নানা গুণে গুণান্বিত হতে হয়। আলোকিত ব্যক্তি আসলেই একজন পরিপূর্ণ মানুষ। ধর্মের চেয়ে উর্ধ্বে যে মনুষ্যত্ব সেটা উপলব্ধি করার ক্ষমতা রাখেন আলোকিত ব্যক্তি। তাঁরা সমাজ থেকে সব জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নির্বিচারে আহরণ করেন কিন্তু দিয়ে যান তার চেয়ে বেশি।” এই বয়ানের প্রতিটি অক্ষরের সাথে, প্রতিটি শব্দের সাথে মিলে যায় প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারের ব্যক্তিত্বের সার্বিক বৈশিষ্ট্য। এক সময়ে সিলেট সরকারি কলেজে (মুরারিচাঁদ কলেজ) তারকা অধ্যক্ষ বা স্টার প্রিন্সিপাল ছিলেন অধ্যক্ষ প্রফেসর সলমান চৌধুরী এর পর দুচার পাঁচজন স্টার প্রিন্সিপাল এসেছেন যাঁর মধ্যে প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার অন্যতম। বেশিরভাগই ছিলেন রুটিন প্রিন্সিপাল অথবা বাংলা ইংরেজি মিশিয়ে বলতে গেলে অধ্যক্ষ পদে প্রিন্সিপাল। অধ্যক্ষ প্রফেসর সলমান চৌধুরী স্যারের মতো অধ্যক্ষ প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার ছিলেন প্রিন্সিপাল পদের ব্রান্ড।
১৯৬৪ থেকে ১৯৮৯ পর্যন্ত মুরারিচাঁদ কলেজ ‘সিলেট সরকারি কলেজ’ নামে চালু থাকার বিষয়ে দুচারটি কথা নতুন প্রজন্মের জ্ঞাতার্থে বলা প্রাসঙ্গিক বলে মনে করি। বিষয়টি ছিল, সিলেটের খ্যাতিমান এমসি কলেজ খ্যাত মুরারিচাঁদ কলেজ প্রেসিডেন্ট আয়ূব খানের আমলে ১৯৬৪ সালে সিলেট সরকারি কলেজ হয়ে যায় এবং এক ধরনের সান্তনা হিসেবে সিলেটবাসীর জন্য প্রতিষ্ঠিত হয় এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজ সিলেট সরকারি কলেজের পাশেই । ১৯৮৯ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব হেদায়েত আহমেদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ও বদান্যতায় সিলেট সরকারি কলেজ তার পূর্বের নাম মুরারিচাঁদ কলেজ ফিরে পায় এবং এমসি ইন্টারমিডিয়েট কলেজকে ডিগ্রি বা স্নাতক পর্যায়ে উন্নীত করে নতুন নামকরণ করা হয় সিলেট সরকারি কলেজ । মোট কথা প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারের অধ্যক্ষ পদে দায়িত্বপালনের আমলে মুরারিচাঁদ কলেজ সিলেট সরকারি কলেজ হিসেবেই পরিচিত ছিল।
প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার সিলেট সরকারি কলেজের (মুরারিচাঁদ কলেজ) বাইরে চট্টগ্রামে ইসলামিক ইন্টারমিডিয়েট কলেজ ও ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পালন করেন। উপাধ্যক্ষ ছিলেন বগুড়া সরকারি কলেজে। সিলেট সরকারি কলেজেরও তিনি উপাধ্যক্ষ ছিলেন (১৯৬৬-৬৯), ছিলেন কলেজের প্রথম মুসলিম ছাত্রাবাসের তত্ত্বাবধায়ক (১৯৬২, তখনও মুরারিচাঁদ কলেজ সিলেট সরকারি কলেজ হয়নি । সব জায়গাতেই তিনি গুণগত মান ও বিদ্যায়তনিক সুযোগসুবিধা বৃদ্ধির চেষ্ঠা করেছেন। সিলেট সরকারি কলেজে নতুন বিভাগে, অনার্স, মাস্টার্স পর্ব চালুকরণ থেকে শুরু করে বহুবিধ বিষয়ে তাঁর আন্তরিক প্রচেষ্টা ছিল, কৃতকার্যও হয়েছিলেন। এর বাইরে শিক্ষাধারার আরও কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিল ও সিন্ডিকেটের সদস্য ছিলেন। অধিকন্তু, তিনি ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি কমিটি ও এফিলিয়েশন কমিটির সদস্য। সব কিছুর মূলে ছিল ছাত্র হিসেবে তাঁর মেধা। তিনি মুরারিচাঁদ কলেজেরই মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তারপর হলেন মনস্বী শিক্ষক, অধ্যাপক এবং দক্ষ শিক্ষা প্রশাসক। একনিষ্ঠ এক কীর্তিমানের বহুমাত্রিক এক শিক্ষাযাত্রা!!!
প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার ধার্মিক ছিলেন কিন্ত অসাম্প্রদায়িক ছিলেন। সস্ত্রীক হজ্জ পালনের সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর। মুক্তিযৃদ্ধের আদর্শের দেশে ও বিদেশের বিভিন্ন জায়গায় মুক্তিযুদ্দ নিয়ে তাঁর বেশ কিছু ভাষণ-বক্তৃতা রয়েছে। অত্যন্ত ধৈর্যশীল একজন মানুষ ছিলেন তিনি, ছিলেন মৃদুভাষী। সহজ, সরল জীবনের অধিকারী ছিলেন। বেশভূষা ছিল মার্জিত রূপের এক ব্রান্ড, পরিপাটী ছিলেন। বেশভূষায় যেন মেধার ছাপ ছিল। জেনেছি, মুত্তিযুদ্ধের সময় বিহারীরা আসবাবপত্রসহ তাঁদের বাসাটি সম্পূর্ণ পুড়িয়ে দিয়েছিল। আবার শূন্য থেকে শুরু করেছিলেন কিন্ত কখনও বিচলিত হননি।
প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারের সাথে আমার একবার দেখা হয়েছিল ১৯৮৩ সালের প্রথম দিকে। আমার বাল্যবন্ধু ও সহপাঠী পরবর্তীকালের বিশিষ্ট হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী আমাকে স্যারের অধ্যক্ষ বাংলোতে নিয়ে গিয়েছিলেন। যাওয়ার একটা হেতু ছিল। ১৯৮৩ সালে সিলেট জেলার মৌলভীবাজার মহকুমার বড়লেখা থানার (তখনও মহকুমাগুলো জেলা হয়নি, থানা হয়নি উপজেলা) শাহবাজপুর উচ্চবিদ্যালয়ে আমি শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলাম (১৯৮০-৮৩)। আমি নিজে উদ্যোগ নিয়ে বিশিষ্টজনের সহযোগিতায় ঘটা করে রবীন্দ্র-নজরুল জয়ন্তী উদযাপন করতে গিয়ে নানা আয়োজনের অংশবিশেষ ছিল একটি স্মরণিকা প্রকাশ। রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “আপনারে করিতে গৌরব দান” আমরা সিলেটের দুইতিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তির বাণী সংগ্রহ করা। প্রধান অতিথি, বিশেষ অতিথি, সভাপতি ও আহ্বায়কের বিধিবদ্ধ বাণীর বাইরে সিলেট মেডিক্যাল কলেজের সার্জারি বিভাগের খ্যাতিমান প্রফেসর ডা. ডি. ই. রাজা চৌধুরী বাণী দিয়েছিলেন। এটি জোগাড় করে দিয়েছিলেন ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন চৌধুরী। বন্ধু মোয়াজ্জেম আমাকে প্রফেসর ডা. ডি. ই. রাজা চৌধুরীর চেম্বারে নিয়ে গিয়ে পরিচয় করিয়ে আমাদের উদ্দেশ্য বলাতে তিনি রাজী হন। বলেন, তিনি রেডি করে রাখবেন, পরের দিন নিয়ে যেতে। পরের দিন গিয়ে দেখি খামে পুরে রেখেছেন। বাণীর জন্য দ্বিতীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে ডা. মোয়াজ্জেমের পছন্দ প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার। স্যারের পরিবারের সাথে ডা. মোয়াজ্জেম ও তাঁর পরিবারের সম্ভবত আত্মীয়তা আছে। স্যার নিবেদন শুনে বাণী দিতে রাজী হলেন না কারণ আমি তাঁর পরিচিত নই, আমার প্রতিষ্ঠানকেও তিনি চেনেন না। খুবই স্পষ্টবাদী। বাণী পেলাম না তবে স্পষ্টবাদিতার একটা পাঠ গ্রহণ করলাম। আত্মীয়ের বন্ধু হিসেবে সামাজিক আদর আপ্যায়ন করলেন আমাদের। এক পর্যায়ে বললেন, দুদিন পরে যেতে। মানে প্রথম দিন চিনলেন, দ্বিতীয় দিন চেনা ব্যক্তিকে কিছু দিলেন।
এখানেও একটা শিক্ষণীয় বিষয় ছিল। একবার এক সাহাবি নিজ সন্তানকে নিয়ে নবীজীর কাছে এলেন। বললেন, আল্লাহর রাসুল! আমার ছেলে খুব বেশি মিষ্টি খায়, দয়া করে আপনি তাকে বারণ করুন। নবীজী বললেন, তিন দিন পরে আসেন। সাহাবী তিন দিন পরে এলে নবীজী তার ছেলেকে মিষ্টি খাওয়া থেকে বারণ করলেন। নবীজী কেন তিন দিন পরে আসতে বললেন, এর কারণ জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বললেন, এই তিন দিনে আগে আমি নিজে মিষ্টি খাওয়া ছেড়েছি তারপর তাকে নিষেধ করেছি। শেষ পর্যন্ত সময় জটিলতার কারণে যেতে পারিনি, বাণীও পাইনি। তবে বাণীর চেয়েও বড়ো কিছু পেয়েছি। আমাদের অনুষ্ঠান সুন্দর ও সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছিল। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বড়লেখা থানা নির্বাহী অফিসার জনাব আখতার আলম খান, বিশেষ অতিথি ছিলেন সিলেট এমসি কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. সফিউদ্দীন আহমেদ। কুলাউড়া উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করে। ঐক্যের চেতনা, সাংস্কৃতিক সমৃদ্ধি এবং সামগ্রিক সমাজের অংশগ্রহণের শক্তির একটি উল্লেখযোগ্য স্মারক হিসেবে এখনও টিকে আছে, দাঁড়িয়ে আছে অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে আলোর এক মশাল হিসেবে।
প্রফেসর গোলাম রসুল সিলেট রেফারেন্ডামের মতো ঐতিহাসিক ঘটনার নিকট সাক্ষী ছিলেন। ১৯৪৭ সালে সুনামগ্জ মহকুমার তাহিরপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী প্রিসাইডিং অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। তাছাড়া, দেশভাগের পরপরই বেশ কিছু শিক্ষকের দেশত্যাগের ফলে সৃষ্ট শিক্ষক শূণ্যতাজনিত কঠিন পরিস্থিতিতে তিনি এমসি কলেজে উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের ডেমনস্ট্রেটর পদে থেকেও ব্যবহারিক ক্লাসের অতিরিক্ত নিজ যোগ্যতা বলে নিয়মিত ক্লাস গ্রহণ করে শিক্ষক শূণ্যতার মতো জটিলতার নিরসন করেন। এমসি কলেজেই ডেমনস্ট্রেটর পদ থেকে প্রিন্সিপাল বা অধ্যক্ষ! অভূতপূর্ব এক অ্রাকাডেমিক যাত্রা !! এধরনের একাগ্রতা ও বিদ্যায়তনিক ঊজ্জ্বলতা ও উৎকর্ষের জুড়ি মেলা ভার!!!
প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারের ছোটোভাই খ্যাতিমান চিকিৎসক ও এমএজি ওসমানি মেডিক্যাল কলেজের প্রিন্সিপাল প্রফেসর ডা. গোলাম কিবরিয়ার সাথে আমার বিশেষ সম্পর্ক ছিল। তিনি আমার ছাত্র-অভিভাবক ছিলেন। তাঁর মেয়ে ফাহিমা, ছেলে সাফকাত ও রিফাত আমার ছাত্র। ছেলেমেয়ের বিয়ের অনুষ্ঠানে প্রফেসর ডা. গোলাম কিবরিয়া স্যার নিজে এসে দাওয়াত দিয়ে যেতেন। এই পরিবারের মূল্যবোধ অনুকরণীয়, অনুসরণীয়। প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারের ছেলে গোলাম মাহমুদ রিজভী ভাইয়ের সাথে বিশেষ সম্পর্ক। আরও বিশেষ সম্পর্ক রিজভী ভাইয়ের সহধর্মিনী দিপা আপার সাথে। তিনি ব্লুবার্ড স্কুল অ্যান্ড কলেজে শিক্ষক ছিলেন। তাঁদের মেয়ে শাম্মা আমার ছাত্রী। দিপা আপার সাথে অন্য আরেক সম্পর্ক। তিনি আমার এক ভাগ্নী। মীরাবাজারের পোদ্দারবাড়িখ্যাত বাড়িটি তাঁর নানাবাড়ি। হারুণ ভাই, মনু ভাই, রুকন ভাই, মাসুম ভাই, বেবী আপা তাঁর আপন মামা ও খালা। আমরা দীর্ঘদিন পোদ্দারবাড়ির বাসিন্দা ছিলাম। যাঁদের কথা বললাম তাঁদের সাথে আমাদের ভাইবোনের সম্পর্ক ছিল। মনু ভাই আমার বিয়েতে বরযাত্রী গিয়েছিলেন ময়মনসিংহ শহরে ১৯৯৪ সালে। স্যারের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনের অনেকের সাথে আমার ও আমাদের পরিবারের যোগাযোগ আছে, রয়েছে সম্পর্ক। তাঁদেরও অনেক সহানুভূতি রয়েছে আমাদের প্রতি। আমরা তাঁদের প্রতি ধন্যবাদার্হ ও কৃতজ্ঞ।
আজকাল প্রফেসর গোলাম রসুল স্যারের মতো শিক্ষক, অধ্যক্ষ, শিক্ষা প্রশাসক, শিক্ষাবিদের অভাব রয়েছে। দুচারজন যে নেই তা নয় তবে বিশ কোটি জনসংখ্যার দেশে সেই সংখ্যা প্রায় শূণ্যের কোঠায়। স্যারের শত শত ছাত্র সারা দেশে ও বিশ্বে নানা মাত্রায় কৃতবিদ্য হয়ে পরের প্রজন্মের জন্য আদর্শ হয়ে উঠেছেন। স্যার ছিলেন আদর্শের আদর্শ। এ যেন মেশিন টুলস ফ্যাক্টরি!!!
প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার ভালো লিখতেন। তাঁর “আমার স্মৃতিকথা” শীর্ষক একটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে। গ্রন্থটি সুলিখিত। তাঁর শতাধিক প্রবন্ধ ও কথিকা বিভিন্ন সময় পত্রিকা, জার্নাল ও রেডিয়োর কথিকা হিসেবে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছিল। এগুলো গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হলে নতুন প্রজন্ম উপকৃত হবে।
প্রফেসর গোলাম রসুল স্যার ছিলেন একজন মহৎপ্রাণ ব্যক্তি। ২০০৪ সালের ১১ মে তিনি চিকিৎসাধীন অবস্থায় পরলোকগমন করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। স্যারের স্মৃতির প্রতি আবারও গভীর শ্রদ্ধা জানাই।
লেখক : মিহিরকান্তি চৌধুরী, লেখক, অনুবাদক ও নির্বাহী প্রধান, টেগোর সেন্টার, সিলেট এবং ডেপুটি রেজিস্ট্রার, মেট্রোপলিটন ইউনিভার্সিটি, সিলেট।
- ঢাকার হানিফ, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন, সিলেটের ছিলেন কামরান
- নৌযান দুর্ঘটনায় পরিবারকে হারানো সেই মিমের দায়িত্ব নিলেন ব্যারিস্টার আহসান হাবীব
- পুলিশের চোখের জলে উন্মোচন হল জোড়া খুনের রহস্য
- ছেলেকে উচ্চশিক্ষিত বানাতে চা শ্রমিক মায়ের অদম্য যুদ্ধের গল্প
- পুলিশ কর্মকর্তার ডায়েরি-২
জাদরেল বাবার দুই মেয়ে অপহরণের নাটকীয় কাহিনী - গ্রামের কবরে ঠাঁই দিতে এক করোনাযোদ্ধার আর্তি
- রোজাদার রিকশাওয়ালাকে মারতে মারতে অজ্ঞান করলেন প্রভাবশালী পথচারী
- হাসি ভরা মুখ নিয়ে ভাইরাল কানাডার যুবক
- কষ্ট লাঘবকারি চিকিৎসার আকুতি চিকিৎসকের
- ছবি আঁকা পাগল লোকটি