Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বুধবার   ৩০ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ১৭ ১৪৩২

আই নিউজ ডেস্ক

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ২ মে ২০২৩

শুভ জন্মদিন: দ্য প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ

ইতিহাস কখনো নিজ থেকে ধরা দেয় না, সেটি তৈরিতে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়। এই পৃথিবীতে যারাই ইতিহাসের অংশ হয়েছেন, তাদের সবাইকেই কঠিন বাস্তবতা ও অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হয়েছে। অপ্রতিরোধ্য মনোভাব ও হেরে না যাওয়ার মানসিকতা মানুষকে একদিন সাফল্যের চূড়ায় পৌঁছে দেয়। বিশ্ব ক্রিকেটেও এমন কিছু উদাহরণ তৈরি হয়েছে যা অন্যদের জন্য পথপ্রদর্শক হিসেবে লিপিবদ্ধ হয়ে থাকবে চিরকাল।

শুরুতে অবসর কাটানোর জন্য হলেও সময়ের পরিক্রমায় ক্রিকেট খেলা মানুষের পছন্দের তালিকায় দিব্বি ঠাঁই পেয়েছে। এমনকি আধুনিক সময়ের ক্রিকেট যেন মানবজীবনে অপরিহার্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে এর সূচনাটা যাদের হাত ধরে হয়েছিল মূলত তারাই ক্রিকেটের প্রাণভোমরা হয়ে আছেন।

ক্রিকেটের ইতিহাসে যে ক’জন ক্রিকেটার কিংবদন্তি তকমা পেয়েছেন তাদেরই একজন ব্রায়ান চার্লস লারা। বাইশ গজে ব্যাটিং ঝলকে কখনো পেয়েছেন ‘দ্য প্রিন্স অব পোর্ট-অব-স্পেন’ তকমা, আবার কখনো ‘দ্য প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ’, ‘দ্য প্রিন্স’, আবার কখনো বা ‘বিশ্ব ক্রিকেটের বরপুত্র’। নামের পাশে এত উপমা এমনি এমনিই আসেনি। এর জন্য ক্যারবীয় ক্রিকেটে লারার অসামান্য অবদান অনস্বীকার্য।

১৯৬৯ সালে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর সান্তাক্রুজের ছোট্ট প্রদেশ কান্তারোতে আজকের এই দিনে (২ মে) পৃথিবীতে জন্ম নেন ব্রায়ান চার্লস লারা। বিশ্ব ক্রিকেটের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কিংবদন্তির ৫৪তম জন্মদিনে তার ক্যারিয়ার ও অর্জন নিয়ে ডেইলি বাংলাদেশের পাঠকদের জন্য লিখেছেন আশরাফুল ইসলাম আকাশ।

ব্রায়ান লারার ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুটা মোটেও সহজ ছিল না। এগারো ভাই-বোনের সংসারে দশম ছিলেন তিনি। এরপর সংসারের টানাপোড়েনের মধ্যে বেড়ে উঠতে থাকেন। কিন্তু যে বয়সে কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে স্কুলের গন্ডিতে পা রাখার কথা, ঠিক তখনই ক্রিকেট কোচিংয়ে ভর্তি হন সবার আদরের ‘প্রিন্সি’।

মাত্র ছয় বছর বয়সেই বাবা ও বড় বোনের হাত ধরে স্থানীয় হার্ভার্ড কোচিং ক্লিনিকে হাজির হন লারা। পরে অবশ্য সেন্ট জোসেফ রোমান ক্যাথলিক প্রাইমারি স্কুলে যাওয়া আসা শুরু হয় লারার। এরপর সান-জুয়ান সেকেন্ডারি স্কুলে ভর্তি করা হয় উঠতি বয়সী লারাকে।

তবে লারার পেশাদারি ক্রিকেটে নায়ক হয়ে ওঠার গল্পটা শুরুটা হয়েছিল পোর্ট অব স্পেনের ফাতিমা কলেজের গন্ডি থেকে। মূলত সেখানে কোচ হ্যারি রামদাসের হাত ধরে মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে ইন্টার স্কুল কম্পিটিশনে ১২৬.১৬ গড়ে ৭২৪ রান করেন তিনি। এরপরই ত্রিনিদারের অনূর্ধ্ব-১৬ দলে ডাক পান। পরের বছরই ক্যারিবীয়দের জার্সিতে অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পান। এরপর আর পিছনে ফিরে তাকাতে হয়নি এ বাঁহাতি ব্যাটারকে।

১৯৮৭ সালে উইন্ডিজ ইয়ুথ চ্যাম্পিয়নশিপে ৪৯৮ রান করেন লারা। যার মধ্য দিয়ে কার্ল হুপারের ৪৮০ রানের রেকর্ড ভাঙেন তিনি। এ টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত ব্যাট করে ১৯৮৮ সালে ত্রিনিদাদ অ্যান্ড টোবাগোর হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। সেবার প্রতিপক্ষ ছিল লিওয়ার্ড আইল্যান্ড। 

প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ম্যাচে আহামরি পারফরম্যান্স করতে না পারলেও দ্বিতীয় ম্যাচেই নিজের জাত চেনান লারা। বার্বাডোজের বিপক্ষে ৩০০ মিনিট ক্রিজে থেকে খেলেন ৯২ রানের এক ম্যারাথন ইনিংস। প্রতিপক্ষের দুই বিধ্বংসী বোলার ম্যালকম মার্শাল আর জোয়েল গার্নারের পেসকে চোখ রাঙিয়ে একের পর এক বাউন্ডারি হাঁকান তিনি।

একই বছরে ভারত অনূর্ধ্ব-২৩ দলের বিপক্ষে ডাবল সেঞ্চুরির ১৮ রান দূরে থেকে আউট হয়ে যান লারা। সাজঘরে ফেরার আগে ১৮২ রানের ঝলমলে ইনিংস খেলেন। পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতায় উইন্ডিজ জাতীয় দলে প্রথমবারের মতো ডাক পান।

এমন সময় হার্ট অ্যাটাকে বাবার মৃত্যুতে মানসিকভাবে অনেকটাই ভেঙে পড়েন লারা। এজন্য বেশ কিছুদিন ক্রিকেট থেকেও দূরে ছিলেন তিনি। অবশ্য বাইশ গজের ভালোবাসায় আবারো ক্রিকেটের ময়দানে ফিরে আসেন এ ক্রিকেটার।

১৯৯০ সালে মাত্র ২০ বছর বয়সে করাচি ন্যাশনাল স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের বিপক্ষে লারার অভিষেক হয়। অভিষেকটা অবশ্য রাঙাতে পারেননি তিনি। পাকিস্তানের পেস সেনসেশন ওয়াকার ইউনিসের বলে মাত্র ১১ রানেই আউট হয়ে যান।

উইন্ডিজ জাতীয় দলে অভিষেকের এক মাস পর একই প্রতিপক্ষের বিপক্ষে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে পরম আকাঙ্ক্ষিত টেস্ট ক্রিকেটে পথচলা শুরু হয় ব্রায়ান লারার। এরপরের গল্প শুধু দ্য প্রিন্সের।

৪৪ ও ৫। এই দুই সংখ্যা দিয়ে সাদা পোশাকের ক্যারিয়ারের শুরু করেছিলেন লারা। আর টেস্টে তিন অংকের ম্যাজিক ফিগার ছুঁতে তিন বছর সময় নেন এ ব্যাটার।

১৯৯৩ সালের জানুয়ারিতে সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার মুখোমুখি হয় উইন্ডিজ। এ সিরিজটি হয়তো ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা একটি ঘটনা হয়ে থাকবে। কেননা পাঁচ ম্যাচের এ টেস্ট সিরিজটি হারতে হারতে ঘুরে দাঁড়িয়েছিল ক্যারিবীয়রা। এমনকি শেষ টেস্ট জিতে ট্রফি নিজেদের করে নিয়েছিল টিম উইন্ডিজ।

পাঁচ ম্যাচের টেস্ট সিরিজের প্রথম ম্যাচটি ড্র হলেও দ্বিতীয়টিতে ১৩৯ রানে জয় তুলে নেয় স্বাগতিক অস্ট্রেলিয়া। পরের ম্যাচে আগে ব্যাট করে প্রথম ইনিংসে ৫০৩ রান সংগ্রহ করে অজিরা। জবাবে ব্যাট করে নেমে শুরুতেই দুই উইকেট হারিয়ে বিপাকে পড়ে ক্যারিবীয়রা।

এ ম্যাচে চতুর্থ নম্বরে ব্যাট হাতে ক্রিজে আসেন লারা। দলের অবস্থা যখন নিভুনিভু, ঠিক তখনই ত্রাতা হয়ে ২৭৭ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস খেলেন এ ব্যাটার। মূলত তার ইনিংসে ভর দিয়েই ওই টেস্টও ড্র হয়।

সিডনি টেস্টের পরের বছর আরো বিস্ফোরক হয়ে ওঠেন লারা। ১৯৯৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৩৭৫ রানের ইনিংস খেলে স্যার গ্যারফিল্ড সোবার্সের ২৬ বছরের রেকর্ড ভেঙে দেন দ্য প্রিন্স।

লারা যে লম্বা রেসের ঘোড়া, সেটি ক্যারিয়ারে শুরুতেই জানিয়ে দিয়েছিলেন তিনি। জাতীয় দলের জার্সিতে একের পর এক ইনিংসে নতুন নতুন রেকর্ড নিজের দখলে নিতে থাকেন। সেই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৪ সালে ইংলিশ কাউন্টি দল উস্টারশায়ারের হয়ে ডারহামের বিপক্ষে অ্যাজবাস্টনে ৫০১ রানের অতিমানবীয় এক ইনিংস খেলেন তিনি। যেটি এখনো প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে কোনো ব্যাটসম্যানের সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত ইনিংস। 

টেস্টে ৩৭৫ রান করে শীর্ষেই ছিলেন লারা। তবে সে রেকর্ড ভেঙে দেন ম্যাথু হেইডেন। অবশ্য শ্রেষ্ঠেত্বের মুকুট পুনরুদ্ধারে বেশি সময় নেননি দ্য প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ। ২০০৪ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ৪০০ রানের ইনিংস খেলে হারানো রেকর্ড পুনরুদ্ধার করেন লারা। এ অমর ইনিংসটির মধ্য দিয়ে দুটি সাড়ে তিনশো রানের ইনিংস খেলা একমাত্র ব্যাটসম্যান বনে যান এ ক্যারিবীয় কিংবদন্তি।

উইন্ডিজের ইতিহাসে সবচেয়ে টেস্ট সেঞ্চুরিও লারারই। ক্যারিয়ারে মোট ৯টি টেস্ট ডাবল সেঞ্চুরি করেছেন। পাশাপাশি টেস্টে দুটি ট্রিপল সেঞ্চুরিও রয়েছে তার নামের পাশে। সব টেস্ট খেলুড়ে দেশের বিপক্ষে অন্তত একটি করে টেস্ট সেঞ্চুরি আছে ব্রায়ান লারার। ২০০৫ সালে কেনসিংটন ওভালে পাকিস্তানের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করে এ চক্র পূরণ করেন তিনি। এক সেশনে সেঞ্চুরি করা ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান ছিলেন লারা।

লারার ক্যারিয়ারের উজ্জ্বলতম অধ্যায়গুলোর একটি ২০০১-০২ মৌসুমে শ্রীলংকা সফর। ওই সিরিজে উইন্ডিজ হোয়াইটওয়াশ হলেও শ্রীলংকান বোলারদের বিপক্ষে বলতে গেলে একাই লড়ে গেছেন লারা। তিন ম্যাচের ৬ ইনিংসে ৩ সেঞ্চুরি ও এক ফিফটিসহ ৬৮৮ করেন তিনি। এর মধ্যে ২২১ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন এ ব্যাটার। যা তিন ম্যাচের টেস্ট সিরিজে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড।

একই টেস্টে সেঞ্চুরি ও ডাবল সেঞ্চুরির বিরল রেকর্ডেও নিজের দখলে রেখেছেন লারা। এমনকি টেস্টে পরাজিত দলের হয়ে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড তার। কলম্বো টেস্টে শ্রীলংকার বিপক্ষে ওই সিরিজের দুই ইনিংস মিলিয়ে ৩৫১ রান করেছিলেন লারা (২২১ ও ১৩০)। যদিও ম্যাচটা শ্রীলংকাই জিতেছিল। 

এদিকে ১৬৪ ক্যাচ নিয়ে উইকেটকিপার ছাড়া আউটফিল্ডারদের মধ্যে অষ্টম সর্বোচ্চ ক্যাচের রেকর্ডও লারার। ২১০ ক্যাচ নিয়ে সবার ওপরে আছেন রাহুল দ্রাবিড়। লারার নামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে, এমনই অসংখ্য রেকর্ডের ছড়াছড়ি।

২০০৭ সালে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে ওয়ানডে বিশ্বকাপের আসর বসে। ঘরের মাঠে বিশ্ব ক্রিকেটের শ্রেষ্ঠত্বের আসরে বিদায়ের ঘোষণা দেন তিনি। বিশ্বকাপের সেরা আটের লড়াইয়ে ব্রিজটাউনে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ম্যাচটাই ক্যারিবীয়ান কিংবদন্তি লারার শেষ ম্যাচ। অবশ্য ক্যারিয়ারের শেষ বেলাটা লারার ছিল না। 

গোধূলি লগ্নে ৩৯ মিনিট ক্রিজে ছিলেন লারা। ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে ১৮ রান করেন তিনি। এরপরই সাজঘরে ফিরতে হয়েছে তাকে। তবে শেষটা কোনো ইংলিশ বোলারের পেসে নয়, বরং কেভিন পিটারসনের দ্রুতগতির থ্রোতে পরাস্ত হয়েছিলেন সর্বকালের সর্বসেরা এ ক্রিকেটার।

ম্যাচ শেষে প্রেজেন্টেশনে দর্শকদের উদ্দেশ্য লারার বলেছিলেন, ‘ডিড আই এন্টারটেইন ইউ?’ ব্রিজটাউনের দর্শকে পরিপূর্ণ গ্যালারি থেকে মুহূর্মুহূ চিৎকারে হয়তো সেই উত্তরটা পেয়ে গিয়েছিলেন দ্য প্রিন্স অব ত্রিনিদাদ।

ক্রিকেট বিশ্বে ব্রায়ান লারা এমন এক চরিত্র যাকে কলমের কালি কিংবা কি-বোর্ডের বোতাম টিপে শেষ হওয়ার নয়। কেননা লারা ছিলেন, আছেন এবং থাকবেন। শুভ জন্মদিন ক্রিকেটের বরপুত্র ব্রায়ান চার্লস লারা।

আইনিউজ/ইউএ

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়