লাবণ্য চৌধুরী
আপডেট: ১৭:৪৭, ১৬ নভেম্বর ২০২২
আজ তাঁর প্রয়াণ দিবস
দাস পার্টির সেই জগৎজ্যোতি, মাকে বলা শেষ কথা
![ছবি- আইনিউজ ছবি- আইনিউজ](https://www.eyenews.news/media/imgAll/2021April/জগৎজ্যোতদাস-দাস-পার্টি-eyenews-2211161744.jpg)
ছবি- আইনিউজ
রণাঙ্গণে পরিস্থিতির ভয়াবহতা কী হতে পারে চিন্তা করে এক পর্যায়ে জ্যোতি তার দলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়ে একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। যেই ভাবা সেই কাজ। গোটা দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন মাত্র দুইজন। জ্যোতি ও ইলিয়াছ। কে জানতো আর কখনো দলের কাছে ফিরে যাবে না বাইশ বছরের জ্যোতি!
ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধ তাকে স্মরণ রেখেছে একজন মুক্তিকামী নির্ভয় সাহসীকতার দৃষ্টান্ত হিসেবে। আবার কেউ কেউ বলেন দাসপার্টির জগৎজ্যোতি। মুক্তিযুদ্ধে দেশমাতৃকাকে স্বাধীন করার প্রয়াসে গড়ে তোলা এ দাস পার্টিই হয়ে গিয়েছিল তার পরিচয়। যুদ্ধের যাবার আগে মাকে বলে গিয়েছিলেন, ‘তোমার লগে দেখা ওইবো স্বাধীন দেশো। যুদ্ধ শেষ না হওয়া পর্যন্ত আর দেখা ওইতো না’। কিন্তু হলো না!
৭১ সালে দেশ স্বাধীন হবার মাত্র এক মাস আগে বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করা বাইশ বছর বয়সী জগতজ্যোতি শত্রুদের বুলেটের আঘাতে মারা যান। তার মৃত্যুর পর মৃতদেহটিকে নিয়ে নির্মম খেলায় মেতে ওঠেছিলো শত্রুবাহিনী। যা ভাবলে আজও ভয়ে শিউরে ওঠেন ভাটির মানুষ। যেমন জ্যোতির নাম শুনলে ভয়ে টলে যেন গোটা শত্রুদল।
জগৎজ্যোতি মানে পৃথিবীর আলো। তাই বোধ হয় সবার জন্য আলো জ্বেলে দেওয়ার দায় নিজের কাঁধেই তুলে নিয়েছিলেন জগৎজ্যোতি দাস। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশমাতৃকার জন্য আগুন হয়ে জ্বলেছিলেন হবিগঞ্জের জলসুখা গ্রামের এ খ্যাপা তরুণ। মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত জগৎজ্যোতি মুক্তিযুদ্ধের উত্তাল দিনগুলোতে ছিলেন উত্তর-পূর্ব রণাঙ্গণে ভরসার কেন্দ্রস্থল।
বহুভাষা রপ্ত ছিল জগৎজ্যোতির
জগৎজ্যোতি ইংরেজি, হিন্দি, গৌহাটির আঞ্চলিক ভাষায় পারদর্শী হওয়ার সুবাদে ভারতীয় মিত্র বাহিনীর সঙ্গে তার যোগাযোগ সহজতর হয়। এর ফলে দাস পার্টির জন্য ভারতীয় মিত্র বাহিনীর জগৎজ্যোতি আধুনিক অস্ত্র ও গোলাবারুদ সংগ্রহে সমর্থ হন।
দাস পার্টির উল্লেখযোগ্য একটি অপারেশন ছিল পাকবাহিনীর বার্জ আক্রমণ। ১৯৭১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকবাহিনীর সেই বার্জটিতে আক্রমণ চালিয়ে বার্জটি নিমজ্জিত করা হয়। দাস বাহিনীর গেরিলা অভিযানের মাধ্যমে পাকিস্তানী শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস শুরু হয়েছিল। পরবর্তীতে পাহাড়পুর অপারেশন, বানিয়াচংয়ে কার্গো বিধ্বস্ত করা, বানিয়াচং থানা অপারেশনসহ বেশ ক’টি ছোট বড় অপারেশন দাস পার্টির যোদ্ধারা সফল ভাবে সম্পন্ন করেন।
রাজাকারদের বিরুদ্ধে জগৎজ্যোতি ও দাস পার্টির অভিযান
দিরাই-শাল্লায় অভিযান চালিয়ে কোনরূপ গুলি ব্যয় না করেই কৌশলে আটক করেন ১০ জন রাজাকারের একটি দলকে। যারা এলাকায় বেপোরোয়াভাবে খুন, ধর্ষণ ও লুটপাট চালাচ্ছিলো। রানীগঞ্জ ও কাদিরীগঞ্জে অভিযান চালিয়েও জ্যোতি আটক করেন রাজাকারদের। জগৎজ্যোতি তখন মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এক কিংবদন্তির নাম। সাহস ও অনুপ্রেরণার উৎস।
মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানী ও রাজাকারদের কাছে দাস পার্টি ছিলো মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। আর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে সাফল্যের প্রতীক। মুক্তিযুদ্ধে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের অধীনে বিস্তৃর্ণ ভাটি অঞ্চল শত্রুমুক্ত রাখার দায়িত্ব পড়ে জগৎজ্যোতির উপর। দিরাই, শাল্লা, ছাতক, আজমিরিগঞ্জ, বানিয়াচং, জামালগঞ্জ, তাহিরপুর, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার নৌপথ পাক দখলমুক্ত রাখার যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় জ্যোতির দাসপার্টি।
পাকিস্তানী-রাজাকারদের জন্য ত্রাস ছিল দাস পার্টি
ভাটির জনপদে শত্রুদের ভীত কাঁপিয়ে দেন জগৎজ্যোতি। দাস পার্টির মূহুর্মূহ আক্রমণে দিশেহারা হয়ে পাকিস্তান সরকার রেডিওতে ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়, ‘এই রুট দিয়ে চলাচলকারী ব্যক্তিদের জানমালের দায়িত্ব সরকার নেবে না।’
হবিগঞ্জের বদলপুরে বদলপুর অপারেশনে জগৎজ্যোতির সঙ্গে ছিলেন বানিয়াচংয়ের মোহাম্মদ আলী মমিন, আমির হোসেন, খালেক মাস্টার, হায়দারুজ্জামান খান ধন মিয়া, আজমিরীগঞ্জের রাশিদুল হাসান চৌধুরী কাজল, মতিউর রহমান, নিত্যানন্দ দাস, ইলিয়াছ চৌধুরী, আ. রশীদ, নিপেন্দ্র দাশ, ছাতকের আয়ুুব আলী, আ।। মজিদ ও দিরাই উপজেলার আহবাব হোসেন এবং লীলু।
জগৎজ্যোতির দল আজিমিরীগঞ্জ, মারকুলি, গুঙ্গিয়ারগাঁও প্রভৃতি অঞ্চলে শত্রু ঘাঁটি ধ্বংস করে দেয়। বদলপুরে দাস পার্টির প্রতিরোধের মুখে পাকসেনারা শক্তি বৃদ্ধি করতে বাধ্য হয়। পাক ক্যাম্প থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে রাজাকার/পাক সেনাদের আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে দাস পার্টি।
জগৎজ্যোতির মৃত্যু
রণাঙ্গণে পরিস্থিতির ভয়াবহতা কী হতে পারে চিন্তা করে এক পর্যায়ে জ্যোতি তার দলকে ফিরে যাবার নির্দেশ দিয়ে একটি মাত্র এলএমজি নিয়ে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। দল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে থাকেন মাত্র দুইজন। জ্যোতি ও ইলিয়াছ।
হঠাৎ ইলিয়াছ পাঁজরে গুলিবিদ্ধ হন। জ্যোতি মাথার লাল পাগড়ি খুলে শক্ত করে বেঁধে দেন। ইলিয়াছ সেই অবস্থায় মেশিনগান নিয়ে ক্রমাগত গুলি ছুড়তে থাকে পাক হানাদারদের ওপর। যুদ্ধের এক পর্যায়ে জগৎজ্যোতি গুলি বিদ্ধ হন। মেশিনগান হাতে উপুড় হয়ে পাশের বিলের পানিতে নিশ্চল হয়ে ঢলে পড়েন জ্যোতি।
শেষ বারের মতো বলে উঠেন ‘আমি যাইগারে’।
জগৎজ্যোতির মৃতদেহের সাথে নির্মমতা
পাকবাহিনীর সহযোগী রাজাকারেরা রাতে জ্যোতির মৃতদেহ আজমিরীগঞ্জ বাজারে নিয়ে যায়। সাধারণ মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য জ্যোতির দেহ একটি খুঁটির সঙ্গে ঝুলিয়ে পেরেক মেরে জনসমক্ষে অমানুষিক নির্যাতন চালায়। এক সময় ভাসিয়ে দেয় ভেড়া মোহনা নদীর জলে।
জগৎজ্যোতির আত্মত্যাগের সংবাদটি সে সময় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, অলইন্ডিয়া রেডিওসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রচার ও প্রকাশ হয়। তাঁর অসীম সাহসিকতার প্রতি সম্মান জানিয়ে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে মরণোত্তর সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় খেতাব প্রদানের ঘোষণা দেয়।
এ ঘোষণা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও অল ইন্ডিয়া রেডিওতেও প্রচার হয়। কিন্তু প্রতিশ্রুত সে খেতাব আজও মেলেনি জগৎজ্যোতির। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে বীরবিক্রম খেতাব দেওয়া হয় জগৎজ্যোতিকে। ১৯৯৮ সালের ৭ মার্চ স্বাধীনতা যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বউদি ফনিবালা দাসের হাতে তাঁর বীরবিক্রম সম্মাননা ও ক্রেস্ট তুলে দেন।
জগৎজ্যোতির বীরপ্রতীক খেতাব পাবার কথা!
বীরপ্রতীক খেতাব বর্জনকারী মুক্তিযুদ্ধে ৪ নম্বর সেক্টরের সাব কমান্ডার প্রয়াত মাহবুবুর রব সাদী এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘আমি নিজে অন্তত তিনজনকে জানি যাদের বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব পাওয়া উচিত ছিল। এদের একজন জগৎজ্যোতি। মুক্তিযুদ্ধে অসীম সাহসী বীরত্ব প্রদর্শন করেও যারা যথাযথ মূল্যায়ন ও খেতাব পাননি তাদের আত্মার প্রতি সম্মান দেখাতেই আমি খেতাব ও সম্মান বর্জন করেছি।’
জগৎজ্যোতির জন্ম ও বাল্যকাল
১৯৪৯ সালের ২৬ এপ্রিল জগৎজ্যোতি দাস জন্মগ্রহণ করেন। হবিগঞ্জ জেলার আজমিরীগঞ্জ উপজেলার জলসুখা গ্রামের জীতেন্দ্র চন্দ্র দাস ও হরিমতি দাস’র কনিষ্ঠ পুত্র জগৎজ্যোতি। দুই ভাই ও দুই বোনের মধ্যে জগৎজ্যোতি ছিলেন সবার ছোট। স্কুল জীবনেই জগৎজ্যোতি আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনে অংশ নেন।
আজমিরীগঞ্জ ‘এমালগেমেটেড বীরচরণ হাইস্কুল’ (এএবিসি) থেকে ১৯৬৮ সালে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে মেট্রিক পাশ করেন। এরপর সুনামগঞ্জ কলেজে ভর্তি হয়ে ছাত্র ইউনিয়নে যোগ দেন। এসময় তেজোদীপ্ত, বিপ্লবী ও স্পষ্টভাষী ছাত্র নেতা হিসেবে তিনি পরিচিত হয়ে ওঠেন।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হামলা ও হত্যাকা-ের বিরুদ্ধে রূখে দাঁড়ানোর জন্য সিদ্ধান্ত নেন জগৎজ্যোতি। যোগ দেন ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ইকো ১ ট্রেনিং ক্যাম্পে। বাংলার ভাটি অঞ্চলের সুনামগঞ্জ-কিশোরগঞ্জ-নেত্রকোনা এবং হবিগঞ্জের হাওরাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয় মুক্তিযুদ্ধের ৭ নম্বর সেক্টর। এ সেক্টরের কমান্ডারের দায়িত্ব পান তৎকালীন মেজর শওকত আলী।
৫ নম্বর সেক্টরকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। এর মধ্যে টেকেরঘাট সাব-সেক্টরের দায়িত্বপ্রাপ্ত সুরঞ্জিত সেনগুপ্তের অধীনে প্রথমত জগৎজ্যোতি বিভিন্ন আক্রমণে অংশগ্রহণ করেন। জগৎজ্যোতির নেতৃত্বে প্রশিক্ষিত চৌকস যোদ্ধাদের নিয়ে গঠিত হয় গেরিলা দল, যার নাম দেওয়া হয় ফায়ারিং স্কোয়াড ‘দাস পার্টি’।
আইনিউজ/এইচএ
আইনিউজে আরও পড়ুন-
- রেসকিউ সেন্টার থেকে ফের লাউয়াছড়ার বুকে গেলো লজ্জাবতি বানরগুলো
- লোকালয়ে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, আতঙ্কে গ্রামবাসী
- ঘুমন্ত মানুষের ঘামের গন্ধে আসে এই সাপ, দংশনে নিশ্চিত মৃত্যু
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- মেয়ের বাড়িতে ইফতার: সিলেটি প্রথার বিলুপ্তি চায় নতুন প্রজন্ম
- অবশেষে ক্লাস করার অনুমতি পেল শ্রীমঙ্গলের শিশু শিক্ষার্থী নাঈম
- দেশের চতুর্থ ধনী বিভাগ সিলেট
- শ্রীমঙ্গল টু কাতারে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালি নেটওয়ার্ক
মৌলভীবাজারে অনলাইন জুয়ায় রাতারাতি কোটিপতি সাগর - এসএসসির ফলাফলে বিভাগে ৩য় স্থানে মৌলভীবাজার
- বিজ্ঞাপন
মৌলভীবাজারে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় লাইফ লাইন হাসপাতাল (ভিডিও) - মৌলভীবাজারে ট্যুরিস্ট বাসের উদ্বোধন বৃহস্পতিবার
- ১ ঘন্টার জন্য মৌলভীবাজারে শিশু কর্মকর্তা হলেন তুলনা ধর তুষ্টি
- মৌলভীবাজার শহরে একদিনে ৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত
- বন্ধ থাকবে মৌলভীবাজারের ‘এমবি’