আই নিউজ ডেস্ক
শ্রীমঙ্গল উপজেলায় বোরো ধানে ‘ব্লাস্ট’, কৃষকরা দিশেহারা
মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার হাইল হাওরে চলতি বছরের বোরো আবাদের ব্রি-২৮ ধানে ‘ব্লাস্ট’ রোগ ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে চিটা হয়ে গেছে মাঠের ধান। ধানের এ বিপর্যয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছেন কৃষকরা। যখন ধান কাটা ও মাড়াইয়ের মহোৎসবে মাতোয়ারা হবার কথা, তখন অনেকটা সুনসান নিরব হাওর এলাকা। মাঠের ধান খাচ্ছে গবাদিপশু। কোন কোন এলাকায় ধান কেটে কৃষকরা ফেলে দিচ্ছেন ছড়া-খাল-বিলের পানিতে।
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এ বছর উপজেলায় ১১ হাজার ৪৫১ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ করা হয়েছিল। এরমধ্যে ব্রি-২৮ জাতের ধান আবাদ হয়েছে ২ হাজার ৬৫১ হেক্টর জমিতে। উপজেলার হাওরা লের ৩নং শ্রীমঙ্গল ইউনিয়নের উত্তর ভাড়াউড়া, নোয়াগাঁও, ইছবপুর, ৫নং কালাপুর ইউনিয়নের রাজাপুর, সিরাজনগর, লামুয়া, উত্তর লামুয়া ও কালাপুর গ্রামে আবাদকৃত ব্রি-২৮ ধানে ব্লাস্ট রোগে আক্রমণ করেছে বেশি। আর ১নং মির্জাপুর ইউনিয়ন ও ২নং ভুনবীর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামে স্বল্প পরিমান জমিতে এ রোগের বিস্তার ঘটে। উল্লেখিত গ্রামগুলোতে মাঠের ধান চিটা হয়ে গেছে। উপজেলা কৃষি বিভাগ দাবি করেছেন কৃষি বিভাগ ব্রি-২৮ জাতের ধান আবাদ না করতে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। কিন্তু কিছু কিছু কৃষক দোকান থেকে নিজেদের ইচ্ছেয় বীজ কিনে নিয়ে এই ধান রোপন করেছেন। কৃষকরা বলছেন, ধানের বীজ কিনতে বাজারে গেলে বীজ ব্যবসায়ীরা ব্রি-২৮ ধান উচ্চ ফলনশীল বলায় অধিক লাভের আশায় তারা এ ধানের বীজ কিনে রোপন করেন।
সরজমিনে হাইল হাওরে গিয়ে দেখা যায়, মাঠের পর মাঠ পাকা ধানের শীষ বাতাসে দোল খাচ্ছে। এসব ধান কাটার কোন আগ্রহ নেই অধিকাংশ কৃষকের। কেউ কেউ গবাদিপশুর খাবারে জন্য কিছু ধান কাটছেন আবার কেউ জমি খালি করার জন্য ধান কেটে ছড়া-খাল-বিলে ভাসিয়ে দিচ্ছেন।
উত্তর লামুয়া গ্রামের কৃষক ওমর ফারুক জানান, তিনি এ বছর ১২০ বিঘা জমিতে ব্রি-২৮ ধানের চাষ করেছিলেন। যখন ধানের শীষ দেখা যায় তখন তার মনটা ভরে ওঠেছিল। কিন্তু গত কয়েকদিন পূর্বে আকস্মিক তার জমিতে ব্লাস্ট রোগ দেখা দেয়। মুহুর্তেই স্বপ্ন ফিকে হয়ে যায় তার। পুরো জমির ধান এখন চিটা। কিছু ধান তিনি কেটে এনেছেন গরুর খাদ্যের জন্য। বাকি ধান জমিতেই পড়ে রয়েছে।
রাজাপুর গ্রামের কৃষক কাওসার মিয়া বলেন, ‘প্রায় ৩০ বিঘা ক্ষেতে আমি ব্রি-২৮ ধান লাগাইছিলাম। এ বছর ফলন ভালা অইছিল। প্রত্যেক বিঘা ক্ষেতে কমে ১৫ থেকে ১৮ মন ধান পাইমু আশা আছিল। যখন ধানটা আসার কথা তখন ধানের গুড়িতে বেমার লাগি গেছে। প্রত্যেক ধানের গাছ ভালা আছে, পাতা ভালা আছে, কিন্তু ধান জ্বইল্লা একবারেই শেষ। হয়তো চিকিৎসা করলে ভালা অইতো। কিন্তু কৃষি বিভাগের লোক আইছে না। তারার অবহেলায় আমরা শেষ অই গেছি। গেলো বছরও এই অবস্থা আছিল।’
নোয়াগাঁও গ্রামের এরশাদ মিয়া বলেন, ‘প্রায় ২০ বিঘা জমিনে ব্রি-২৮ জাতের ধান করছিলাম। সমিতি থেকে ঋণ এনে চাষ করেছি। ভাবছিলাম ধানের ফলন অইলে সমিতিরে টাকা দিয়া দিমু। কিন্তুক কপাল খারাপ। ধান সব চিটা অই গেছে। অহন আমি মেশিনে মানষের ধান মাড়াই কইরা কোনরকম নিজে চলছি-পরিবার চালাইতেছি। চিন্তা অইল কেমনে সমিতির টাকা দিমু। কৃষি বিভাগ একবারও আমরার খোঁজ নিছে না। তারা পরামর্শ দিলে আমরার উপকার অইলো নে।’
উত্তর লামুয়া গ্রামের তাহির মিয়া বলেন, ‘আমার সব জায়গা শেষ। একদম পুকে খাইয়া লাইছে। কিতা থাকি এ অবস্থা অইছে আমরা বুঝতে পারছি না। আমি গ্রামীণ ব্যাংক থাকি ঋণ লইছি। হাওলাতও আনছি। এখন এই ঋণ শোধ করমু কেমনে, আর ভাত খাইমু কেমনে। কৃষি বিভাগও কোনদিন আমরারে দেখতে আইছে না।’
একই গ্রামের সুন্দর মিয়ার স্ত্রী ছুবেতারা বেগম বলেন, ‘আমার ৩-৪ কেয়ার জাগার ধান করছি। আমার সুদি করি, ঋণ করি, হাওলাদ করি টাকা আনছি। বাচ্চা-কাচ্চা লইয়া চারটা ডাইল-ভাত খাইমু ভাবছিলাম। সরকারে অফিসার দিল তারা আইয়া আমরার খবর নিল না। আমরার ধান সব নষ্ট অই গেল। এখন আমরা ঋণ দিমু কেমনে আর খাইমু কেমনে। এখন তো অনাহারে থাকতে অইব।’
নোয়াগাঁও গ্রামের কৃষক অঞ্জু কর জানান, তার নিজের কোন জমি নেই। অন্যের ৭ বিঘা জমি তিনি মানুষের কাছ থেকে ঋণ করে এনে বর্গা চাষ করেছেন। এখন তার পথে বসার উপক্রম।
একই গ্রামের কৃষক জোবায়ের মিয়া বলেন, ‘ব্রি-২৮ জাতের ধান আমাদের সাথে বেইমানী করছে। পুরো ক্ষেতকে ক্ষেত ছিটায় ভরে গেছে। নিজের ১২ বিঘা জমি রোজ কামলা দিয়ে ৭৫ হাজার টাকা খরচ করে করেছিলাম। এখন সবই শেষ।’ তিনি বলেন, ‘কৃষি কর্মকর্তার কথায় আমরা বাজার থাইক্কা কীটনাশক নিয়া ছিটাইতাছি, তা-ও কাম হইতাছে না।’ একইভাবে অভিযোগ করেছেন ইছবপুর গ্রামের মজনু মিয়া, লামা লামুয়া গ্রামের ফয়সল আহমেদ, লামুয়া গ্রামের আব্দুর রহমান, জাগছড়া চা বাগানের কাজল কালিন্দীরা।
এদিকে গত ৮ এপ্রিল বিকেলে শ্রীমঙ্গলে সংবাদ সম্মেলন করেছেন হাইল হাওরা লের সাধারণ কৃষকরা। সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, ‘হাইল হাওর এলাকায় বোরো ফসলই অধিকাংশ মানুষের জীবিকা নির্বাহের প্রধান মাধ্যম। কেউ কেউ আউশ ও আমন ধান চাষ করলেও পরিমাণে তা খুবই কম। প্রতি বছরের বোরো ধানই পরবর্তী বছরে পরিবার-পরিজনের অন্নের সংস্থানের একমাত্র অবলম্বন। কিন্তু কপালের ফেরে ব্লাস্ট রোগে পুরো হাওরা লের প্রায় সব ধানই চিটা হয়ে গেছে। নষ্ট হওয়া ধান কেউ গরুর জন্য কেটে নিচ্ছেন, কেউ কেটে পানিতে ভাসিয়ে দিচ্ছেন, আবার কেউ জমিতেই ফেলে রেখেছেন।
কৃষকরা বলেন, আগামী আউশ, আমন ও বোরো মৌসুমে বীজ, সার ও অন্যান্য ক্ষেত্রে সরকার সহায়তা না করলে তাদের পক্ষে আর চাষ করা সম্ভব হবে না। একই সাথে ক্ষুদ্র, প্রান্তিক ও বর্গা চাষিদের আর্থিক সহায়তা না করলে তারা পরিবার পরিজন নিয়ে না খেয়ে থাকতে হবে।’
এ ব্যাপারে শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা কৃষিবিদ উজ্জ্বল সূত্রধর বলেন, ‘যেভাবে কৃষকরা দাবি করছেন তা সঠিক নয়। আমাদের মাঠ থেকে প্রাপ্ত তথ্যনুযায়ী কিছুটা জমিতে ব্লাস্ট রোগে আক্রমণ করেছে। এক মাস আগেই এই রোগের প্রাদুর্ভাব যখন দেখা দিয়েছিল তখন আমরা কৃষকদের এ থেকে উত্তোরণের পরামর্শ দিয়েছিলাম। কিন্তু কৃষকরা সঠিকভাবে তা পালন করেননি।’
শ্রীমঙ্গল উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ মো. মহিউদ্দিন বলেন, ‘ব্রি-২৮ জাতের ধান রোপনে কৃষকদেরকে নিরুৎসাহিত করা হয়েছিল। ব্রি-২৮ অনেক পুরাতন একটি জাত। এটির পরিবর্তে ব্রি-৮৮ বা ব্রি-৮৯ চাষের জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে। এরপরও কৃষকরা ২ হাজার ৬৫১ হেক্টর জমিতে ব্রি-২৮ ধান রোপন করেন। যার মধ্যে বেশ কিছু অংশ ব্লাস্ট রোগে আক্রান্ত হয়। যখন এটি প্রথম ধরা পড়ে তখন পাতা মরতে শুরু করে। সে সময়ে কৃষকদের পরামর্শ দিয়েছিলাম দুই রাউন্ড ছত্রাক নাশক স্প্রে করতে। অনেকেই স্প্রে করেছেন। যারা করেননি বা সঠিক নিয়মে করেননি তাদের ফসল কিছুটা নষ্ট হয়েছে। এছাড়া মার্চ মাসের ২৫/২৬ তারিখ থেকে প্রায় প্রতিদিনই শ্রীমঙ্গলে বৃষ্টি হয়েছে। যার ফলে যারা স্প্রে করেছিলেন তাদের ঔষধ বৃষ্টির পানিতে ভেসে গেছে।’ তিনি বলেন, ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। এ সপ্তাহেই উপজেলা পরিষদের সভা হবে। সেখানে সিদ্ধান্ত হবে ক্ষতিগ্রস্থদের কিভাবে সহায়তা বা প্রণোদনার আওতায় আনা যায়।’
মৌলভীবাজার জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক শামছুদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘জেলার হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর ও কাউয়াদিঘি হাওরে ব্লাস্ট রোগে কিছু ধানের জমি নষ্ট হয়েছে। কৃষি বিভাগ কৃষকদের পাশে আছে। ক্ষতিগ্রস্থ কৃষকদের তালিকা তৈরি করা শুরু হয়েছে। সরকারের কোনো বরাদ্দ বা প্রণোদনা এলে, ক্ষতিগ্রস্থদের সহায়তা করা হবে।’
আই নিউজ/এইউ
- মেয়ের বাড়িতে ইফতার: সিলেটি প্রথার বিলুপ্তি চায় নতুন প্রজন্ম
- অবশেষে ক্লাস করার অনুমতি পেল শ্রীমঙ্গলের শিশু শিক্ষার্থী নাঈম
- দেশের চতুর্থ ধনী বিভাগ সিলেট
- শ্রীমঙ্গল টু কাতারে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালি নেটওয়ার্ক
মৌলভীবাজারে অনলাইন জুয়ায় রাতারাতি কোটিপতি সাগর - এসএসসির ফলাফলে বিভাগে ৩য় স্থানে মৌলভীবাজার
- বিজ্ঞাপন
মৌলভীবাজারে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় লাইফ লাইন হাসপাতাল (ভিডিও) - মৌলভীবাজারে ট্যুরিস্ট বাসের উদ্বোধন বৃহস্পতিবার
- ১ ঘন্টার জন্য মৌলভীবাজারে শিশু কর্মকর্তা হলেন তুলনা ধর তুষ্টি
- মৌলভীবাজার শহরে একদিনে ৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত
- বন্ধ থাকবে মৌলভীবাজারের ‘এমবি’