খছরু চৌধুরী
আপডেট: ১৭:৪২, ১ এপ্রিল ২০২৪
রাজনগরের সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র: শঙ্কিত কাওয়াদীঘি হাওরাঞ্চলের মানুষ
সিলেট বিভাগের চারটি জেলায়, বিশেষ করে সিলেট ও সুনামগঞ্জে ২০২২ সালে স্মরণকালের ভ য়া ব হ বন্যা পরিস্থিতিতে মানুষ, গবাদিপশু ও অন্যান্য প্রাণীর প্রাণহানি এবং একই সাথে রাস্তা ঘাট, কাঁচা-পাকা ঘর-বাড়ির ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ মনে পড়লে আজও আমার গা শিউরে ওঠে! ঐ সময়ে দুর্যোগ কবলিত ৪৫ লাখ পানি বন্দী মানুষের পাশে দেশ ও প্রবাসের মানবিক মানুষগুলো যথাসময়ে না-দাঁড়ালে আরও বেশকিছু মানুষ না-খেয়েই মরে যেতো।
বিকল্প স্থান হলো— রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ, মুন্সিবাজার ও টেংরা ইউনিয়নের প্রচুর পরিমাণের খাস ভূমি। এসকল খাস ভূমির সাথে অনেক আগে থেকেই কাঁচা-পাকা পাহাড়ি রাস্তার সংযোগ বিদ্যমান। এই খাস ভূমিতে প্রস্তাবিত সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন করলে— লিংক রোডের কয়েকশ কোটি টাকা সাশ্রয়-সহ হাওরের ভূ-প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, মনু সেচ প্রকল্পের উদ্দেশ্য বিনষ্ট হবে না।
দেশের দীর্ঘতম নদী (২৪৯ কি.মি.) সুরমার আশেপাশের ৮০-৯০ শতাংশ স্থলভূমি জুন মাসের কয়েকদিন পানির নিচে তলিয়েছিল। শুধু সিলেট অঞ্চলেই নয়— ভারতের আসাম, অরুণাচল প্রদেশসহ পুরো বরাক উপত্যকায় বিগত শত বছরের মধ্যে রেকর্ড পরিমাণ বৃষ্টিপাতে এমন বন্যা পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। ইংরেজ বেনিয়া লিন্ডের আত্মজীবনীর ভাষ্যমতে ১৮৭১ সালে সিলেট অঞ্চলে যে প্রলয়ঙ্কারী বন্যা হয়েছিল— এরপর এবারের বন্যা তার কাছাকাছি ছিল।
যেকোনো দেশ তার নিজের দেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু তদসম্পর্কিত ভবিষ্যৎ প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক মোকাবিলার বিষয়গুলো মাথায় রেখেই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এক্ষেত্রে আমাদের দেশই ব্যতিক্রম। এদেশের উন্নয়ন পরিকল্পনা অপরিনামদর্শী। যতদূর মনে পড়ছে, ২০২২ সালে সিলেট অঞ্চলের বন্যার ক্ষয়ক্ষতি দেখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, হাওরাঞ্চলের রাস্তা-ঘাট নির্মাণে বর্ষা মৌসুমের স্বাভাবিক পানি প্রবাহে যেভাবে বাঁধার সৃষ্টি না হয় সে বিষয়টি মাথায় রাখতে হবে, প্রয়োজনে হাওরে ফ্লাইওভার করে রাস্তা নির্মাণ করতে হবে।
২০০৪ সালের বন্যায় যখন রাজনগরের হাওর কাওয়াদিঘী হাওরের ওপর দিয়ে যাওয়া রাজনগর-বালাগঞ্জ পাকা সড়ক কয়েক ফুট পানির নীচে তলিয়ে যায়, তখন প্রয়াত অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রী এম. সাইফুর রহমান বলেছিলেন, এখনকার প্রকৌশলীরা কেমন পরিকল্পনা দেয়? বৃটিশরা শতবর্ষ আগে যে রেললাইনগুলো করেছে এগুলো তো বন্যার পানিতে ডুবে না। সিলেটের ঐ বন্যার সময়ে বিজ্ঞজনের অনেকেই বৃষ্টির পানিপ্রবাহ বাঁধাগ্রস্ত করার জন্য কিশোরগঞ্জের হাওরে নির্মিত মিঠামইনের পাকা সড়ক নির্মাণকে দায়ি করেছেন।
ভূগোল জ্ঞানে আমরা জানি, অসংখ্য নদী-নালা, খাল-বিলের কারণে বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার প্রাকৃতিক ড্র্যানেজ সিষ্টেম বলা হয়। নদীমাতৃক বাংলাদেশে সড়ক ভিত্তিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে, শিল্প স্থাপনে নদী-হাওর, খাল-বিলের প্রাকৃতিক কাঠামো এবং ইকোলজিক্যাল বিষয়টি বিবেচনায় না নিয়ে যে উন্নয়ন হচ্ছে বা হবে এটি একসময়ে জনবসতির জন্য উন্নয়নের মরণফাঁদ হিসেবেই চিহ্নিত হবে।
সম্প্রতি সরকারের উন্নয়ন ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড কর্তৃক মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলায় ১০০ মেগাওয়াট (এসি) সৌর বিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপনের অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ২০ বছর মেয়াদে ১০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে নো ইলেক্টিসিটি, নো পেমেন্ট ভিত্তিতে কনসোর্টিয়াম অফ থিয়েন ভু ভিয়েতনাম নিউ এনার্জি জয়েন্ট স্টক কোং এবং ড্রিম ফাইন্ডার লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তির অনুমোদন দেয়া হয়েছে। ট্যারিফ ভিত্তিতে বিদ্যুৎ ক্রয় করা হলে ২০ বছর মেয়াদে উক্ত কোম্পানিকে প্রতি কিলোওয়াট ঘণ্টা ১০.৯২ টাকা হিসেবে আনুমানিক ৩ হাজার ৫৩৭ কোটি ৬০ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে (সময় টিভি নিউজ সূত্র)। লোকমুখে শোনা যাচ্ছে, উন্নয়নের এ সংবাদটি প্রচার হওয়ার সাথে সাথে রাজনগর উপজেলা তথা মৌলভীবাজার সদর উপজেলার মিঠাপানির মাছ ও মনু সেচ প্রকল্পের ধান ভাণ্ডার বলে খ্যাত "হাওর কাওয়াদিঘীতে" বাংলাদেশের বিশেষ কয়েকজন শিল্পপতি অধিক পরিমাণে জায়গাজমি ক্রয় করেছেন। এই জমিক্রয়ের উদ্দেশ্য যদি হয়— হাওরে উল্লেখিত সৌর বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন করা, তাহলে; এমন অপরিনামদর্শী উন্নয়ন নিয়ে আমাদের আশংকার বহু কারণ আছে।
আমরা জানি, হাওর কাওয়াদিঘী দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সর্ববৃহৎ সেচ প্রকল্প। যেখানে ধান সহ অন্যান্য কৃষিজাত উৎপাদনের জন্য ইতিপূর্বে সরকার কয়েক হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। হাওরকে ঘিরে মনু সেচ প্রকল্পের উদ্দেশ্যের সাথে সাং*ঘর্ষিক নিয়মে এ ধরনের সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্র স্থাপন অচিরেই এতদঞ্চলের জনবসতির জন্য মরণফাঁদ তৈরী করবে। হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদ, মাছ, কৃষি, গবাদি পশু-চারণ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে হাওরাঞ্চলের মানুষের জীবন-জীবিকা নির্বাহের ওপর প্রথম আঘাত আসবে। ধীরে ধীরে নষ্ট হবে ভূ-প্রকৃতির কাঠামো, নষ্ট হবে হাজারো ধরনের প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, অতিথি পাখির আগমন, রাজনগর- মৌলভীবাজারের ১০ লাখ মানুষের মিঠাপানির মাছের যোগান। দেখা দিবে পরিবেশ বিপর্যয়।
ধরেন, হাওরের মধ্যখানে সৌরবিদ্যুতের প্লান্ট স্থাপন করা হলো। সেখানে যাতায়াতের জন্য একটি লিংকরোড তৈরি করা হলো (লিংক রোডটি, মৌলভীবাজার-কুলাউরা সড়ক থেকে নিলে ১৩ থেকে ১৪ কিলোমিটার এবং রাজনগর-বালাগঞ্জ সড়ক থেকে নিলে ৬ থেকে ৭ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য হবে)। এমন উন্নয়নের ফাঁদে ধান ও কৃষিজাত উৎপাদনের কয়েক শত একর কৃষি জমি নষ্ট হবে। এমন লিংক রোড দ্বারা বর্ষা মৌসুমে হাওরের পানির স্বাভাবিক প্রবাহে বাঁধার কারণে ঘনঘন বন্যা পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। লিংক রোড নির্মানেও অপ্রয়োজনীয় বিনিয়োগ হবে কয়েক শত কোটি টাকা।
গরীব ও স্বল্প আয়ের মানুষেরা জনগণের কোষাগারের টাকা আত্মসাৎ করার সাম্যর্থ ও যোগ্যতা (?) না-রাখলেও এদেশের বিত্তবানরা ক্যামনে কি করে জনগণের টাকা আত্মসাৎ করার ধান্দা করেন— দেশের নাগরিক হিসেবে এর একটা আন্দাজ তো আমাদের হয়ে গেছে। অর্থাৎ অসচেতন কৃষকদের ফুসলিয়ে হাওর থেকে যে সকল শিল্পপতিরা স্বপ্লদামে জমি কিনছেন। উল্লিখিত বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের প্রয়োজনে স্থানীয় মূল্য নির্ধারণকারী সরকারি প্রকৌশলীর সাথে মিলেমিশে উক্ত স্বল্পমূল্যের জমিই ১০ থেকে ১০০ গুণ বেশী দামে বিক্রি করবেন। এভাবে লুঠেরা অর্থনীতিতে মধ্যস্বত্ত ভোগী হয়ে হাজার কোটি টাকার মালিক হবেন। থাক, প্রসঙ্গ লুঠেরাদের নিয়ে নয়। কথা হলো, কোনোরকমের শংকা সৃষ্টি না-করে সৌরবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি সরকার প্রস্তাবিত রাজনগর উপজেলাতেই বিকল্প স্থানে স্থাপন করা সম্ভব। তাহলে, বিকল্প স্থান কি?
বিকল্প স্থান হলো— রাজনগর উপজেলার উত্তরভাগ, মুন্সিবাজার ও টেংরা ইউনিয়নের প্রচুর পরিমাণের খাস ভূমি। এসকল খাস ভূমির সাথে অনেক আগে থেকেই কাঁচা-পাকা পাহাড়ি রাস্তার সংযোগ বিদ্যমান। এই খাস ভূমিতে প্রস্তাবিত সৌরবিদ্যুত কেন্দ্র স্থাপন করলে— লিংক রোডের কয়েকশ কোটি টাকা সাশ্রয়-সহ হাওরের ভূ-প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, মনু সেচ প্রকল্পের উদ্দেশ্য বিনষ্ট হবে না। অপরিনামদর্শী উন্নয়নের নামে রাজনগরের হাওরাঞ্চলের মানুষের জন্য নতুন কোনো মরণফাঁদ তৈরী হোক— সচেতন দেশপ্রেমিক কোনো নাগরিকই এমনটি চাইবেন না। নীতি নির্ধারকরা এ অধমের প্রস্তাবটি বিবেচনায় নিবেন বলে প্রত্যাশা রাখছি।
খছরু চৌধুরী : হাওর রক্ষা সংগ্রাম কমিটির জেলা সদস্য এবং লীলা নাগ স্মৃতি পরিষদ, মৌলভীবাজার-এর সাধারণ সম্পাদক।
[email protected]
আই নিউজ/এইচএ
- মেয়ের বাড়িতে ইফতার: সিলেটি প্রথার বিলুপ্তি চায় নতুন প্রজন্ম
- অবশেষে ক্লাস করার অনুমতি পেল শ্রীমঙ্গলের শিশু শিক্ষার্থী নাঈম
- দেশের চতুর্থ ধনী বিভাগ সিলেট
- শ্রীমঙ্গল টু কাতারে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালি নেটওয়ার্ক
মৌলভীবাজারে অনলাইন জুয়ায় রাতারাতি কোটিপতি সাগর - এসএসসির ফলাফলে বিভাগে ৩য় স্থানে মৌলভীবাজার
- বিজ্ঞাপন
মৌলভীবাজারে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় লাইফ লাইন হাসপাতাল (ভিডিও) - মৌলভীবাজারে ট্যুরিস্ট বাসের উদ্বোধন বৃহস্পতিবার
- ১ ঘন্টার জন্য মৌলভীবাজারে শিশু কর্মকর্তা হলেন তুলনা ধর তুষ্টি
- মৌলভীবাজার শহরে একদিনে ৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত
- বন্ধ থাকবে মৌলভীবাজারের ‘এমবি’