সাইফুল ইসলাম সুমন, আসাম শিলচর থেকে
বাংলা ভাষার আবেগ-উচ্ছ্বাসে ভাসল শিলচর সহ গোটা বরাক উপত্যকা
ছবি- সাইফুল ইসলাম সুমন
বিশ্বের কোনো জাতি নিজের ভাষার জন্য বাঙালিদের মতো এত ত্যাগ স্বীকার করেনি। নিজের ভাষার জন্য, মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য যে প্রাণ দেওয়া যায়, নিজের সবটুকু উৎসর্গ করা যায়, সবকিছু নির্দ্বিধায় ছুঁড়ে ফেলা যায়— বাঙালিরা তা করে দেখিয়েছে।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার দাবিতে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছিলেন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউরসহ নাম না জানা অনেকে। তেমনি ভারতের আসামের বরাক উপত্যকায় রাজ্যের কেন্দ্রীয় ভাষা বাংলা করার দাবিতে ১৯৬১ সালে ১৯ মে প্রাণ দিয়েছিলেন কানাইলাল নিয়োগী, চন্ডীচরণ সূত্রধর, হিতেশ বিশ্বাস, সত্যেন্দ্রকুমার দেব, কুমুদরঞ্জন দাস, সুনীল সরকার, তরণী দেবনাথ, শচীন্দ্র চন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, সুকোমল পুরকায়স্থ ও কমলা ভট্টাচার্য নামের ১১ জন মাতৃভাষাপ্রেমী বাঙালি। পার্থক্যটা কেবল দেশের। বাংলার প্রতি, বাংলা ভাষার প্রতি বাঙালির তীব্র আবেগ আর নিজস্বতা সবসময় আকাশচুম্বী।
বরাক উপত্যকাবাসীর জন্য গত রোববার ছিল অমর ১৯ শে মে। বাংলা ভাষা শহীদ দিবস। উনিশ বাংলা ভাষাভাষী মানুষের আত্মপরিচয়, আবেগ- উচ্ছ্বাসে ভেসে এমনটা বুঝিয়ে দিল ভারতের আসাম রাজ্যের শিলচর সহ গোটা বরাক উপত্যকা। মাতৃভাষাপ্রেমী মানুষের আবেগের ঢেউ রীতিমতো আছড়ে পড়ে বরাকের তিন জেলায়ই। রবিবার শিলচরের রাজপথ সজ্জিত হয় একাধিক বর্ণাঢ্য শোভাযাত্রায়। এই আবেগ-উচ্ছ্বাস বার্তা দিল, উনিশ যেমন বাংলা ভাষাভাষী মানুষের আত্মপরিচয়, অহঙ্কার ও ভালোবাসা।
মহান ১৯ শে মে শহিদ দিবস উপলক্ষে এদিন শিলচর শহরের রেল স্টেশন সহ শ্মশানঘাট এবং গান্ধীবাগ ময়দানে চলে বিভিন্ন অনুষ্ঠান। একাদশ শহিদকে শ্রদ্ধা জানাতে শিলচরের রাজপথে নামেন বিভিন্ন সংস্থা-সংগঠন সহ ভাষাপ্রেমী মানুষ। সকাল সাড়ে ৬টা থেকে শিলচর রেল স্টেশন চত্বর, শ্মশানঘাটের শহিদ-স্মারক এবং দুপুরে গান্ধীবাগের শহিদ বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করতে ভাষাপ্রেমীদের ঢল নামে। শহিদ তর্পণে শুধু বাংলাভাষী নন, বিষ্ণুপ্রিয়া মণিপুরি, ডিমাসা, মণিপুরি, নেপালি, হিন্দিভাষী সবাই শামিল হয়েছিলেন। উনিশের আবেগে সাড়া দিয়ে দিল্লি, কলকাতা, ত্রিপুরা এবং বাংলাদেশ থেকেও অনেক প্রতিনিধি শিলচরে এসেছেন। সবমিলিয়ে শহিদ তর্পণে উৎসবমুখর হয়ে ওঠে শিলচর শহর।
প্রতি বছরের মতো এবারও শহিদ স্মরণের উদ্দেশে ব্যাপক কর্মসূচি হাতে নেয় ভাষা শহিদ স্টেশন শহিদ স্মরণ সমিতি। এদিন ৬৩ তম শহিদ দিবস উপলক্ষে সকাল থেকেই শিলচর রেল স্টেশনের শহিদ বেদি প্রাঙ্গণে ভাষাপ্রেমীরা জড়ো হতে থাকেন। সকাল সাড়ে ৬টায় আর্য সংস্কৃতি বোধনী সমিতির উনিশের গানের সঙ্গে শহিদ বেদিতে মাল্যদান এবং পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ অনুষ্ঠান শুরু হয়। সকালে স্টেশন চত্বরে শহিদ-স্মারকে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করেন বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ। বাংলা ভাষা পরিষদের পক্ষে মাসুদ করিম, স্বপন কুমার ভট্টাচার্য, ভাষা শহিদ স্টেশন শহিদ স্মরণ সমিতির সভাপতি বাবুল হোড়, সম্পাদক রাজীব কর, আমরা বাঙালির পক্ষে বিশিষ্ট সংগঠক সাধন পুরকায়স্থ, দিল্লি থেকে আগত কবি ও স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. ইন্দিরা দাশ, ত্রিপুরার বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক ড. দেবব্রত দেবরায়, নয়াদিল্লির বিশিষ্ট সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব অধ্যাপক ড. নীলাঞ্জন সাহা, ইয়াসির সঞ্জীব রায়, বরাক উপত্যকা বঙ্গ সাহিত্য ও সংস্কৃতি সম্মেলনের কাছাড় জেলা কমিটি, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ সহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠনের পক্ষথেকে শহিদদের শ্রদ্ধাঞ্জলি প্রদান করা হয়।
স্টেশন প্রাঙ্গণে ভাষা শহিদ স্টেশন শহিদ স্মরণ সমিতি আয়োজিত উনিশের সহযোদ্ধা ড. তাপসশংকর দত্ত স্মৃতিমঞ্চে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিধায়ক কমলাক্ষ দে পুরকায়স্থ বলেন, বর্তমান সরকার ভাষা শহিদদের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। ২০১৯ সাল থেকে অসম সরকার উনিশে মে-কে ভাষা শহিদ দিবস হিসাবে সরকারি ক্যালেন্ডারে স্থান দিয়েছে। তাছাড়াও ২০১৯ সালের বাজেটে ভাষা শহিদ স্মারক গৃহীত হয়েছিল কিন্তু জায়গার অভাবে তা গড়ে তোলা যায়নি। তিনি আরও বলেন, ভাষা শহিদ পরিবারকে আর্থিক সাহায্য প্রদানের বিষয়টি তিনি আগে বিধানসভায় উত্থাপন করেছিলেন। মুখ্যমন্ত্রী জানিয়েছিলেন ভাষা শহিদদের পরিবারকে আর্থিক সাহায্য দিতে কোনও আপত্তি নেই। এসব ব্যাপারে আলোচনা সাপেক্ষে সিদ্ধান্তের প্রয়োজন রয়েছে বলে মনে করেন তিনি। এদিন মঞ্চে উন্মোচিত হয় বর্ণমালা 'রোদ্দুর'। ভাষা শহিদ স্টেশনের অনুষ্ঠানে ড. তাপসশংকর দত্ত স্মৃতিমঞ্চে বিশিষ্ট কবি-লেখক আসাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. তপোধীর ভট্টাচার্যকে উনিশের পদক সম্মাননা তুলে দেওয়া হয়।
চেতনার পথে দ্বিধাহীন অভিযাত্রী বেশে বাঙালিকে সর্বদা চলার প্রেরণা জোগায় উনিশ। বীর শহিদদের আত্মবলিদানের কথা মাথায় রেখে ভাষার • মর্যাদা রক্ষার জন্য সকল ভাষাপ্রেমীদের একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানান - বাংলাদেশের একুশের পদকপ্রাপ্ত আবৃত্তিকার ও নাট্যজন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কবি দেবাশিস চন্দ, বিশিষ্ট তথ্যচিত্র নির্মাতা মাসুদ করিম, মণিকান্ত সিনহা, ডা. ইন্দিরা দাশ, সাংবাদিক সাইফুল ইসলাম সুমন সহ অনেকেই।
ড. তপোধীর ভট্টাচার্য বলেন, কমলা ভট্টাচার্য ও সুদেষ্ণা সিনহা দু'জন মহিলা ভাষা শহিদ বিশ্বকে উপহার দিয়েছে বরাক উপত্যকা। তিনি মাতৃভাষার বিকাশের জন্য সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
এদিন বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এসএম দেব সিভিল হাসপাতালের সহযোগে সকাল ১১টায় স্টেশন চত্বরে আয়োজিত হয় উনিশের রক্তদান শিবির। এদিন সকাল ৮টায় শহিদদের শ্রদ্ধা জানাতে শিলচর শ্মশানঘাটে ভাষাপ্রেমীদের ভিড় জমে। যেখানে পাশাপাশি ১১টি চিতা জ্বালিয়ে অন্ত্যেষ্টি করা হয়েছিল- কমলা ভট্টাচার্য, শচীন্দ্র পাল, বীরেন্দ্র সূত্রধর, কানাইলাল নিয়োগী, চণ্ডীচরণ সূত্রধর, সত্যেন্দ্র দেব, হিতেশ বিশ্বাস, কুমুদরঞ্জন দাস, তরণী দেবনাথ, সুনীল সরকার এবং সুকোমল পুরকায়স্থকে। এদিন ছোট-বড় মিছিল করে অনেকে শ্মশানে গিয়ে তাঁদের স্মরণ করেন। এতে বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীরাও অংশ নেয়। শহিদ স্মরণে উপস্থিত ছিলেন রাজ্যের মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য, বিজেপির কাছাড় জেলা সভাপতি বিমলেন্দু রায়, শিলচর জেলা কংগ্রেস সভাপতি অভিজিৎ পাল, শিলচর আসনের কংগ্রেস প্রার্থী সূর্যকান্ত সরকার, বেঙ্গলি ফরোয়ার্ড ক্লাব। সকালে বিভিন্ন ক্লাবের সদস্যরা মিছিল করে শ্মশানে গিয়ে ভাষা শহিদ স্মৃতি স্মারকে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। বিশ্বহিন্দু মহাসংঘের পক্ষে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় সম্পাদক (উত্তর- পূর্বাঞ্চল) সৌমিত্র নাথ, কাছাড় জেলা সভাপতি হিমাদ্রি অধিকারী, সাধারণ সম্পাদক নান্টু ঘোষ, বিজন নাথ, গীতালি পাল, দেবাশিস রায়, বিধানরঞ্জন পাল, বিশ্বজিৎ দাস। ভারত বিকাশ পরিষদ, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক মঞ্চ, স্ফুলিঙ্গ সাহিত্য পত্রিকাগোষ্ঠী, অগ্রণী ক্লাব, পূবালী, রূপম, শিলচর মহকুমা শিক্ষক সম্মিলন, বাংলা সাহিত্য সভা, সারা আসাম উচ্চতর মাধ্যমিক শিক্ষক কর্মচারী সংস্থা, ১৯শে মে উদযাপন কমিটি, কোরাস, এআইডিএসও, রেডক্রস হসপিটাল অ্যান্ড সোসাইটি, ডিএসএ, শিলচর জেলা কংগ্রেস কমিটি, মধ্যসহর সাংস্কৃতিক সংস্থা, জয়েন্ট অ্যাকশন কমিটি, গণসুর, কৃষ্টি বিবেক সাংস্কৃতিক সংস্থা, বরাকের আওয়াজ, বৈশ্য সম্প্রদায় উন্নয়ন পরিষদ, সরকারি পেনশনার্স অ্যাসোসিয়েশন, এক্স স্টুডেন্ট ফোরাম অব শিলচর পলিটেকনিক, শিলচরের ছাত্রসমাজ, শিলচর জেলা বার সংস্থা, সাউথ পয়েন্ট স্কুল সহ অনেক সংগঠনের পক্ষে শহিদদের শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
সকালে শিলচর শ্মশানঘাটে শহিদদের প্রতি সম্মান জানিয়ে মন্ত্রী পরিমল শুক্লবৈদ্য বলেন, এই দিনটি সকলের জন্য খুবই স্মরণীয়। ১১ জন শহিদের মাধ্যমে মাতৃভাষার প্রতি সম্মানের বার্তা সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে মাতৃভাষার বিকাশের জন্য। শিশুরা নিজের মাতৃভাষায় যাতে পড়াশোনা করতে পারে এরজন্য পরিকল্পনা এবং কাজও শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি। পরিমল শুক্লবৈদ্য আরও বলেন, মাতৃভাষার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা মানেই সেই ভাষা ও জাতির প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা। ভাষা শহিদদের স্মৃতিকে সমাজব্যবস্থায় অমর করার জন্য কী করলে ভালো হয়, এনিয়ে নানা মত ও দাবি রয়েছে। শিলচর রেল স্টেশনকে ভাষা শহিদ স্টেশন করার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই দাবি দীর্ঘদিনের। এনিয়ে সরকার চিন্তাভাবনা করছে।
জেলা কংগ্রেস সভাপতি অভিজিৎ পাল বলেন, ১৯শে মে-র ভাষা শহিদরা ভবিষ্যৎ দিশারি। তাঁদের আত্মবলিদানের সুবাদে বরাক উপত্যকায় বাংলা ভাষার অস্তিত্ব টিকে রয়েছে। কিন্তু যে মর্যাদা বাংলা ভাষার পাওয়া উচিত ছিল কিংবা যারা ভাষার জন্য আত্মবলিদান দিয়েছিলেন তাঁদের এখনও শহিদের মর্যাদা দেওয়া হয়নি। অবিলম্বে শিলচর স্টেশনকে ভাষা শহিদ স্টেশন করার দাবি জানিয়েছেন তিনি।
এদিন করাস সাংস্কৃতিক সংস্থা পথনাটিকা পরিবেশন করে। মূল বিষয় অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। একই ধরনের নাটক পরিবেশিত হয় শিলচর শ্মশানঘাটে। এআইডিএসও, এআইডিওয়াইও, এআইএমএসএস এবং কমসোমল লাল পতাকা কাঁধে নিয়ে নিজস্ব কায়দায় লাল সেলাম জানায়। শিলচর রাঙ্গিরখাড়ি থেকে গান্ধীবাগ পর্যন্ত এক বিশাল র্যালি করে।
এদিন বেলা ২টা ৩৫ মিনিটে ভাষা শহিদদের ওপর গুলি চালানোর সময় শিলচর শহরজুড়ে তাঁদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এদিকে, সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান, ক্লাব ও বাড়িতে একাদশ শহিদের উদ্দেশে মোমবাতি জ্বালিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
আই নিউজ/এইচএ
- মেয়ের বাড়িতে ইফতার: সিলেটি প্রথার বিলুপ্তি চায় নতুন প্রজন্ম
- অবশেষে ক্লাস করার অনুমতি পেল শ্রীমঙ্গলের শিশু শিক্ষার্থী নাঈম
- দেশের চতুর্থ ধনী বিভাগ সিলেট
- শ্রীমঙ্গল টু কাতারে গড়ে তুলেছেন শক্তিশালি নেটওয়ার্ক
মৌলভীবাজারে অনলাইন জুয়ায় রাতারাতি কোটিপতি সাগর - এসএসসির ফলাফলে বিভাগে ৩য় স্থানে মৌলভীবাজার
- বিজ্ঞাপন
মৌলভীবাজারে হার্ট অ্যাটাকের চিকিৎসায় লাইফ লাইন হাসপাতাল (ভিডিও) - মৌলভীবাজারে ট্যুরিস্ট বাসের উদ্বোধন বৃহস্পতিবার
- ১ ঘন্টার জন্য মৌলভীবাজারে শিশু কর্মকর্তা হলেন তুলনা ধর তুষ্টি
- মৌলভীবাজার শহরে একদিনে ৮ জন করোনা রোগী শনাক্ত
- বন্ধ থাকবে মৌলভীবাজারের ‘এমবি’