Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, শনিবার   ১৯ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৬ ১৪৩২

জাহাঙ্গীর জয়েস 

প্রকাশিত: ১৭:৩০, ১৬ আগস্ট ২০২১
আপডেট: ১৩:৪২, ১৭ আগস্ট ২০২১

আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ আজিজুর রহমানের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

আজিজুর রহমান

আজিজুর রহমান

লুঙ্গি পাঞ্জাবি বা লুঙ্গি ফতোয়া; তার ওপর মুজিব কোট, ঘাড় থেকে বগল প্যাঁচিয়ে চাদর। তারমধ্যে হাতে বা বগলে ডায়েরি, পত্র পত্রিকা নিয়ে তিনি শহরের অলিগলিতে আর হাঁটেন না। তাঁকে আর দেখা যায় না চাঁদনীঘাট, শান্তিবাগ, কোর্ট রোড কিংবা ক্লাব রোডে। তিনি আর মনুব্রিজ পেরিয়ে শহরে আসেন না। প্রায় বছর হতে চল্লো তিনি ঘুমিয়ে আছেন জন্মগ্রাম গুজারাইয়ে। 

এই তিনি হলেন ১৯৭০ সালের প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, ১৯৮৬ ও ১৯৯১ সালের সংসদ সদস্য, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান, দেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা আজিজুর রহমান। 
তিনি ছিলেন আজীবন সংগ্রামী আপাদমস্তক একজন বিশুদ্ধ চর্চার সার্বক্ষণিক রাজনীতিবিদ। 

নির্লোভ, নিরহংকার, উদার, জনদরদি, অসাম্প্রদায়িক, প্রগতিশীল, দেশপ্রেমিক- এভাবে বিশেষণ ব্যবহার করলে অগণিত বিশেষণ ব্যবহার করা যাবে। রাজনীতি, নির্বাচন, ভোট শব্দের সাথে যখন প্রথম পরিচিত হই সম্ভবত তখন যার নাম প্রথম শুনি তিনি হলেন আজিজুর রহমান। কিশোর, যুবক, প্রৌঢ়-প্রৌঢ়া, বৃদ্ধ-বৃদ্ধা সবার কাছে যিনি আজিজ মিয়া হিসেবে সমধিক পরিচিত ছিলেন। সাধারণ মানুষের শান্তি এবং সাহসের আশ্রয়স্থল। বলা যায় রাজনীতি ছিলো অকৃতদার আজিজুর রহমানের সংসার, উঠোন ছিলো রাজপথ। 

একদিন রাত দশটা বা সাড়ে দশটার দিকে আমাদের পার্টি অফিস (সিপিবি অফিস, মৌলভীবাজার) থেকে নেমেই উনার সামনে পড়ে যাই। মাথায় হেলমেট। সালাম দিতেই বলেন, 'কে রে?' আমি মাথা থেকে হেলমেট খুলতেই বলেন, 'ও, তুই।' এতো বড়ো একজন মানুষের এই যে স্নেহমাখা কোমল স্বরের আন্তরিকতাপূর্ণ বলার ধরন। শ্রদ্ধায় আপনার মাথা নুয়ে আসবে এটাই স্বাভাবিক। 

মানুষকে আপন করে নেওয়ার সহজাত ক্ষমতা সবার হয় না। অসাধারণ সম্মোহনী শক্তি ছিলো তাঁর। তাইতো ছাত্র জীবনে যে রাজনীতি শুরু করেছিলেন তার ধারাবাহিকতায় মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মতো একটি দলের জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক, সভাপতি শুধু নয় কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এবং যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হতে পেরেছিলেন। ১৯৯১ সালে জাতীয় সংসদে বিরোধী দলীয় হুইপ ছিলেন। ভারপ্রাপ্ত চীফ হুইপের দায়িত্বও পালন করেছেন। 

আজিজুর রহমান ১৯৪৩ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর মৌলভীবাজার জেলার চাঁদনীঘাট ইউনিয়নের গুজারাই গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। তাঁর বাবার নাম আব্দুল ছাত্তার এবং মায়ের নাম মাহমুদা বেগম (কাঞ্চন বিবি)। তিনি শহরের শ্রীনাথ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় থেকে প্রাথমিক, মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক, মৌলভীবাজার সরকারি কলেজ থেকে উচ্চ মাধ্যমিক এবং হবিগঞ্জের বৃন্দাবন সরকারি কলেজ থেকে বি.কম. ডিগ্রি অর্জন করেন। 

পরিচ্ছন্ন, কর্মীবান্ধব এই রাজনীতিবিদ ২০১১ সালের ২০ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার জেলা পরিষদ প্রশাসক মনোনীত হোন। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত নির্বাচনে তিনি জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হোন। 

ছাত্রজীবন থেকে মানুষের অধিকার আদায়ের যে আন্দোলনে যুক্ত হয়েছিলেন তার ধারাবাহিকতায় স্বাধীকার, স্বাধীনতার আন্দোলন, সামরিক, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনসহ দেশের প্রতিটি গণতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি ছিলেন একজন নিবেদিত প্রাণ যোদ্ধা।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাকবাহিনী তাঁকে গ্রেফতার করে এবং তাঁর ওপর চালায় নির্মম নির্যাতন। মুক্তিযোদ্ধারা সিলেট কারাগার থেকে জেল ভেঙে তাঁকে বের করে নিয়ে আসেন। 

এ প্রসঙ্গে লেখক, সাংবাদিক মুক্তাদীর আহমদ মুক্তা লিখেছেন, '১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ পাক হানাদার বাহিনীর হাতে তিনি গ্রেপ্তার হন। তালা ভেঙ্গে সিলেট কারাগার থেকে মুক্তিযোদ্ধারা তাঁকে মুক্ত করেন। পাকবাহিনীর মৌলভীবাজার আক্রমণের পর ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনে আত্মনিয়োগ করেন। মুজিবনগর সরকারের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতির আহ্বানে পশ্চিমবঙ্গের বাগডুগায় (দার্জিলিং) পার্লামেন্ট অধিবেশনে যোগদান করেন। প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হিসেবে সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন এবং ৪ নম্বর সেক্টরের রাজনৈতিক কো-অর্ডিনেটর হিসেবে দায়িত্ব লাভ করেন। ৮ ডিসেম্বর মৌলভীবাজার মহকুমা প্রশাসকের কার্যালয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে মৌলভীবাজার মহকুমাকে হানাদার মুক্ত ঘোষণা করেন।'

রাজনীতি (ছাত্র জীবনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। বর্তমানে বাংলাদেশ যুব ইউনিয়ন এবং বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি মৌলভীবাজার জেলা কমিটির সাথে যুক্ত) কিছুটা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এবং এক-আধটু লেখালেখির সুবাদে রাজনীতির এই প্রবাদ পুরুষের সাথে বিভিন্ন অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখতে পেরেছি যা শৈশব, কৈশোরে কখনো কল্পনায়ও আসেনি। এই কীর্তিমান, বরণীয় ব্যক্তিত্ব সভাপতি, প্রধান অতিথি ছিলেন এমন কিছু অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলাম যা আজ অনন্য স্মৃতি হিসেবে চোখে ভাসছে। 

জনকল্যাণে নিবেদিত, আদর্শিক এই রাজনীতিবিদের সভাপতিত্বে শেষবারের মতো বক্তব্য দিয়েছিলাম সিপিবি কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আবু জাফর আহমদের নাগরিক শোক সভায়। তিনি ওই নাগরিক শোকসভা কমিটির আহবায়ক ছিলেন। যেকোনো সামাজিক, সাংস্কৃতিক আয়োজনে তাঁর উপস্থিতি, সহযোগিতা, পৃষ্ঠপোষকতা ছিলো দারুণ প্রেরণাসঞ্চারী। 

সন্ত্রাস, লুটপাট, দুর্নীতি, দখলদারিত্বের পাহারাদার রাজনৈতিক নেতার সংখ্যা যখন বাড়ছে দিনকে দিন। পাঁচ, দশ বছরে যখন নেতাদের দুই তিনশো গুণ সম্পদ বেড়ে যায়। আইন প্রনেতা যখন মানব পাচারের অভিযোগে বিদেশে কারারুদ্ধ হয়। সংসদ সদস্য যখন দখল করা জমির কাগজ দিয়ে ব্যাংক থেকে শত কোটির ওপর ঋণ নিয়ে আসেন। এক দুই টার্ম ক্ষমতায় থেকে এমপি যখন ৮ম শ্রেণী পাশ থেকে বিবিএ পাশ করে ফেলেন তখন মানব কল্যাণ তথা সুস্থ রাজনীতি চর্চায় নিবেদিত আজিজুর রহমানের মতো আদর্শবান রাজনীতিবিদের দিকে তাকালে হৃদয়ে যে শান্তির হাওয়া বয়ে যায়; সেই শান্তির হাওয়া কোনো মূল্য দিয়ে, সম্পদের পাহাড় দিয়ে পাওয়া সম্ভব নয়। 

মানুষ হিসেবে ব্যাক্তিগত জীবনে অত্যন্ত সাদামাটা জীবন যাপনের অধিকারী, সজ্জন, শান্ত, সংস্কৃতিমান একজন অসাধারণ মানুষ আজিজুর রহমান যুগ যুগ বেঁচে থাকবেন তাঁর মহৎ কর্মের মধ্য দিয়ে অগণিত মানুষের হৃদয়ে। 

আগামী বুধবার (১৮ আগস্ট) তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন এই স্থিতধী পুরুষ, আপাদমস্তক রাজনীতিবিদ আজিজুর রহমান। তাঁর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকীতে জানাচ্ছি বিনম্র শ্রদ্ধা।

Green Tea
সিলেট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়