প্রকাশিত: ০৭:১৯, ১১ মে ২০১৯
আপডেট: ০৯:০৯, ১১ মে ২০১৯
আপডেট: ০৯:০৯, ১১ মে ২০১৯
শতবর্ষী গাছ কেটে ১৩ হাজার একর বনভূমি দখল
কক্সবাজারঃ কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগে প্রতিদিন একের পর এক শতবর্ষী গর্জন গাছ কেটে সাবাড় করা হচ্ছে , সাড়ে ১৩ একর বনভূমি ইতোমধ্যে দখল হয়েছে। একারণে উজাড় হতে চলেছে সরকারি বন বিভাগের জায়গা। বনের জায়গা দখল করে নির্মিত হচ্ছে বসতবাড়ি-দোকানঘর। সরকারি উড লট ও আগর বাগান এখন দখলদার চক্রের কব্জায়। আরও অভিযোগ উঠেছে, স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় বনাঞ্চলের পাহাড়ের মাটি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে। জব্দ করা মালামাল বিক্রি করে ফেলছে বন রক্ষকরা।
অভিযোগ উঠেছে, প্রভাবশালীরা বিভিন্ন ধর্মীয় ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের নামে দখল করে রেখেছে কয়েকশ একর সরকারি জায়গা। প্লট বানিয়ে বিক্রি করা হচ্ছে বনের জায়গা। এমনকি, ধর্মীয় রীতির বাইরে গিয়ে বনের জায়গায় বানানো হচ্ছে কবরস্থান-শ্মশান। আর এর সবই চলছে স্থানীয় কিছু অসাধু বনবিট কর্মকর্তা ও বন জায়গিরদারদের যোগসাজশে। দেখে-শুনেও ‘চুপ’ করে থাকছেন সংশ্লিষ্টরা কর্মকর্তারা। এ সবকিছুই শক্তিশালী সিন্ডিকেটের মাধ্যমে হচ্ছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। সেই সিন্ডিকেটে জনপ্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, হেডম্যান, ভিলেজারের নামও রয়েছে।.
অবৈধভাবে বনভূমি দখলের কথা স্বীকার করেছেন খোদ কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা কেরামত আলী মল্লিক। তিনি জানিয়েছেন, কক্সবাজার উত্তর বনবিভাগে ১৩ হাজার ৭৫৪ দশমিক ১২ একর জমি দখল হয়ে গেছে। দখলদারের বিরুদ্ধে বিচারাধীন মামলা সংখ্যা চার হাজার ৪৮৩ টি। তাদের মোট জমির পরিমাণ ৯১ হাজার ৮৬৪ দশমিক ২১ একর। সেখান থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে আইনি প্রক্রিয়ায় হস্তান্তর করা হয়েছে ১৬ হাজার ৮৮৪ একর।
তবে দখলে কর্মকর্তাদের যোগসাজশ থাকার অন্যান্য অভিযোগ মানতে রাজি নন বন কর্মকর্তা কেরামত আলী মল্লিক। জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনারা শুধু বন বিভাগের দোষ খোঁজেন। আমরা তো দখল করছি না। বনের জায়গা দখল করছে জনগণই। আবার অবৈধ দখল উচ্ছেদ করতে গিয়ে আমরা বাধাগ্রস্ত হই। প্রভাবশালীরা প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘কোথায় কোথায় দখল হচ্ছে, কারা দখল করছে- সেগুলো নিয়ে লিখেন। আপনাদের লেখনি দিয়ে মানুষকে সচেতন করেন। তাহলেই সরকারি সম্পদ বাঁচবে।’.
জানা গেছে, চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী রেঞ্জের সেগুন বাগিচা বাগানিপাড়া এলাকায় ২০০৭/০৮ সালের উডলট ও ২০০৮/০৯ সালের আগর বাগানের ৩০ একর জায়গা দখল হয়ে গেছে। গাছ কাটতে কাটতে খুটাখালীর সেগুন বাগিচা এখন প্রায় বিরানভূমি। বাগানের ফাঁকে ফাঁকে অবৈধ বসতি ছাড়া আর কিছুই নেই। ওঠানো হচ্ছে স্থায়ী দালান-কোঠা। অভিযোগ রয়েছে, প্রতি বসতি থেকে নেওয়া হয়েছে ন্যুনতম ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকা। মেধাকচ্ছপিয়া বনবিটেরও একই হাল।
ঠাণ্ডাছড়ি মধুশিয়া এলাকার শতবর্ষি গর্জন বাগান থেকে ইতোমধ্যে ২০০ এর বেশি ‘মাদার ট্রি’ কাটা হয়েছে। সংরক্ষিত বনেও ঢুকে পড়েছে মানুষ। নির্মিত হচ্ছে বসতঘর-স্থাপনা। গত কয়েক বছরে খুটাখালী বন বিট এলাকা থেকে অন্তত ৩০ হাজার গর্জন গাছ উজাড় হয়ে গেছে। এসব দখলের পেছনে স্থানীয় বিট কর্মকর্তার সম্পৃক্ততা রয়েছে বলে স্থানীয়দের অভিযোগ।
তবে ‘সব অভিযোগ সত্য নয়’ বলে দাবি করেছেন অভিযুক্ত বিট কর্মকর্তা মোজাম্মেল হোসেন। তিনি বলেন, ‘সেগুন বাগিচা এক দিনে দখল হয়নি। অবৈধ ঘরবাড়ি নির্মাণের সমস্যা দীর্ঘদিনের। বিষয়টি স্থানীয় প্রশাসন ও ঊর্ধ্বতন কর্মৃপক্ষকে বিভিন্ন সময় লিখিত অভিযোগ করা হয়েছে। দখলকারীদের বিরুদ্ধে থানায় জিডি ও মামলাও রয়েছে।’ উডলট ও আগর বাগানের ৩০ একর জায়গা দখল করে নেওয়ার বিষয়টি তিনি স্বীকার করে বলেন, ‘স্থানীয় একটি রাজনৈতিক ও প্রভাবশালী দখল করে নিতে চেষ্টা করেছিল। তাদের প্রতিহত করা হয়েছে।’
ফুলছড়ি রেঞ্জের অফিসের ১০০ গজের মধ্যে বন বিভাগের জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বসতঘর ও দোকানপাট। ‘ফ্রি স্টাইলে’ দখলযজ্ঞ চললেও মাথা ব্যাথা নেই ‘বস’দের। স্থানীয় একটি সুত্রের দাবি, এখানে একটি বাড়ি করার জন্য বন বিভাগের এক কর্মকর্তাকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে।
ইসলামাবাদ-ইসলামপুর মধ্যবর্তী শাহ ফকির বাজারে অবৈধভাবে গড়ে উঠেছে অসংখ্য দোকান ঘর। নির্মিত হচ্ছে বসতি। সেখানেও জড়িত রয়েছে স্থানীয় একটি প্রভাবশালী সিন্ডিকেট। নাপিতখালী বনবিটের অধীন ২০০৫/০৬ সালের ‘উডলট’ বাগানের কোনও চিহ্নই এখন আর নেই। একই সঙ্গে সামাজিক বনায়ন ও বনাঞ্চলের পাহাড়ও শেষ হয়ে যাচ্ছে। ৭/৮টি পাহাড় কেটে সমান করে ফেলা হয়েছে।
এসব দখলবাজদের সঙ্গে ফুলছড়ি রেঞ্জ অফিসার কাজি মোকাম্মেল কবিরের সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের। তাদের মতে, কাজি মোকাম্মেল কবির যোগদানের দেড় বছরে বন বিভাগ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দৃশ্যমান অভিযানে নামেননি তিনি। দখলবাজচক্রের সঙ্গে তার গভীর সখ্য রয়েছে। এ সুযোগে বনের জায়গা বেহাত হয়ে যাচ্ছে দিন দিন।.
অভিযোগ উঠেছে, প্রকৃতি ধ্বংস করা হলেও পরিবেশ অধিদফতরের খবর নেই। মাঝে মধ্যে ‘লোক দেখানো’ অভিযানে নামে বন বিভাগ। পরে ‘মোটা অংকের উপঢৌকনে’ ম্যানেজ হয়ে যায় অভিযানকারীরা।
কক্সবাজার পরিবেশ অধিদফতরের সহকারী পরিচালক সর্দার শরিফুল ইসলামের কাছে পাহাড় কাটার ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন, ‘পাহাড় কাটার ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বনকর্মকর্তারা নিরব ভূমিকা পালন করে। তাছাড়া পরিবেশ অধিদফতরকে কোনও ধরণের তথ্য দেয় না। তাই সহজে অভিযানে যাওয়া যায় না।’ ফুলছড়ি রেঞ্জ কর্মকর্তা কাজী মোকাম্মেল কবিরের বক্তব্য জানতে গিয়ে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করলেও রিসিভ করেননি।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের ইসলামপুর রেঞ্জের আওতাধীন বিভিন্ন বন থেকে দুর্বৃত্তরা বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। গত ১৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় নাপিতখালী চাকার দোকান এলাকা থেকে পাচারকালে বিশালাকার গর্জন গাছের ৬টি টুকরা জব্দ করা হয়। এই এলাকা থেকে প্রায় প্রতিদিনই চান্দেরগাড়ি, ডাম্পার, ট্রাক নিয়ে মহাসড়ক হয়ে কাঠ পাচার হলেও সংশ্লিষ্ট বনকর্মকর্তারা রহস্যজনক ভূমিকা পালন করছেন। সংঘবদ্ধ গাছ খেকোরা সামাজিক বনায়নের গাছ কেটে সাবাড় করলেও ঘুম ভাঙছে না বনরক্ষকদের।
এদিকে চকরিয়া উপজেলার খুটাখালী মেধাকচ্ছপিয়া ন্যাশনাল পার্কের শতবর্ষী ‘মাদার ট্রি’ কেটে সাবাড় করছে বনখেকোরা। বনখেকোদের পাশাপাশি স্থানীয় বন জায়গিরদারদের সখ্যতায় বননিধনযজ্ঞ অব্যাহত রয়েছে। এ কারণে জাতীয় উদ্যানটি দিন দিন বৃক্ষশূন্য হয়ে পড়ছে।
চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক সংলগ্ন খুটাখালী মৌজার মেধাকচ্ছপিয়া এলাকায় বন বিভাগের প্রায় ১ হাজার একর জমিতে ন্যাশনাল পার্ক বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয় সরকার। ২০০৪ সালের এপ্রিল মাসে পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয় এই বনভূমিকে ন্যাশনাল পার্ক হিসাবে ঘোষণা করেন। কিন্তু সরকারের ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণাটি শুধু সাইনবোর্ড লাগানোর মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। একারণে পার্কের সীমানার প্রায় ৪০০ একর বনভূমি অবৈধ দখলে চলে গেছে।
স্থানীয় লোকজনের অভিযোগ, শতবর্ষী গর্জন বাগান এবং ন্যাশনাল পার্ক (জাতীয় উদ্যান) পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই কাঠ পাচারকারীরা দিন দুপুরে গাছ কেটে সাবাড় করছে। এ গর্জন বাগানকে ন্যাশনাল পার্ক ঘোষণার কয়েক বছর পার হয়ে গেলেও বন দস্যূদের একের পর এক বেপরোয়া নিধনযজ্ঞে শতবর্শী গর্জন বাগান হারিয়ে যেতে বসেছে।
একটি সুত্র মতে, প্রায় ৫ শত কোটি টাকা মূল্যে ১০ হাজারেরও বেশি মাদার ট্রি রক্ষার জন্য আর্ন্তজাতিক এনজিও সংস্থা অরন্য ফাউন্ডেশন এবং কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগ আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে বন ভক্ষক ও বন বিট কর্মকর্তা-কর্মচারী ও হেডম্যানদের সহযোগিতায় একের পর এক মাদার ট্রি কাটা হচ্ছে। এতে প্রাকৃতিক ঐতিহ্যবাহী গর্জন বাগানটি উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
খুটাখালি থেকে অন্তত ৫ কিলোমিটার পূর্বে গেলে বিশাল বাগান। সারি সারি করে দাঁড়ানো ‘মা গর্জন’ গাছগুলো। গর্জন গাছের বংশ বিস্তারের জন্য ১৯৫২ এবং ১৯৯৩ সালে সৃজিত হয় এ বাগান। কিন্তু বর্তমানে বাগানের অবস্থা খুবই করুণ। দূর থেকে চোখে পড়া ‘মা গর্জন’র বাগানে ঢুকলে দেখা যাবে ‘প্রকৃত চিত্র’। হাজারেরও বেশি ‘মা গর্জন’ গাছ নির্মমভাবে কেটে ফেলা হয়েছে। পড়ে আছে গাছের গোড়ালিগুলো। ইউনিয়নের হরিখোলা, ঘেছখোলা, খেলির বিল, গুল ডেবা, মুধর শিয়া ও গয়ালমারায় ‘মা গর্জন’ বাগানের এ দশা। বাগানের এ পরিস্থিতি পেছনে স্থানীয়রা এক ‘ভিলেজার ও সংঘবদ্ধ গাছ চোর সিন্ডিকেট’কে দায়ী করেছেন।
স্থানীয় বন জায়গিরদাররা জানান, একটি পরিচিত কাঠচোর সিন্ডিকেট ন্যাশনাল পার্কের শতবর্ষী গর্জন গাছ কেটে নিয়ে যাচ্ছে। এতে ব্যবহার করছে লোকাল শ্রমিক, বার্মাইয়া নারী ও শিশুদের। প্রতিদিন ভোর ও সন্ধ্যায় এসব বার্মাইয়াদের দিয়ে গাছের গোড়া চেঁছে ফেলে চালায় নিধনযজ্ঞ। বিট কর্মকর্তার অবহেলার কারণে ন্যানশাল পার্কে বৃক্ষের লুটপাট হচ্ছে। দ্রুত এর প্রতিকার চেয়ে সরকারের হস্তক্ষেপ কামরা করেছেন স্থানীয় সচেতন মহল।
আরডি/ ইএন
আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- কাল থেকে যেসব শাখায় পাওয়া যাবে নতুন টাকার নোট
- 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠনের ঘোষণা
- এক বছরেই শক্তি, ক্ষিপ্রতা জৌলুস হারিয়ে 'হীরা' এখন বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী
- ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে লড়ে যাওয়া এক সৈনিক
- ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিকথা (প্রথম পর্ব)
- এবার ভাইরাস বিরোধী মাস্ক বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো বাংলাদেশ
- মায়েরখাবারের জন্য ভিক্ষা করছে শিশু
- ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
- ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৩ কত তারিখ
- তালিকা হবে রাজাকারদের
সর্বশেষ
জনপ্রিয়