প্রকাশিত: ০৯:৫১, ২২ জুলাই ২০১৯
আপডেট: ১০:১২, ২২ জুলাই ২০১৯
আপডেট: ১০:১২, ২২ জুলাই ২০১৯
এভাবে কাউকে মেরে ফেলা বীরের ধর্ম নয়
উজ্জ্বল দাশ
কান নিয়ে গেছে চিলে। কানে হাত দিয়ে কি দেখেছি আদৌ কানটা জায়গামতোই আছে না সত্যি সত্যিই, চিলে নিয়ে গেছে! ছোটবেলায় পড়ে আসা শামসুর রাহমান এর 'পন্ডশ্রম' এর সরলার্থটি মুখস্থ করেছি। বুঝে করিনি, পরীক্ষা পাশের জন্য এরকম কত কিছুই করতে হয়েছে। তখন বুঝিনি, এখন বুঝি। এই কবিতাটির ভাবার্থ কতটা গভীর।
কান নিয়ে গেছে চিলে। কানে হাত দিয়ে কি দেখেছি আদৌ কানটা জায়গামতোই আছে না সত্যি সত্যিই, চিলে নিয়ে গেছে!
হুজুগ বড্ড বিপদজনক, গুজবটা ভয়াবহ। উভয়ের রসায়নে বাণের স্রোতের মত তলিয়ে যায় ব্যাক্তিমন, সমাজ, দেশ। বাংলা নামের সোনার দেশে কারা যে পিতলের প্রলেপ দিতে বসেছে, বুঝে পাই না। অবশ্য আমার মতো নগণ্যজনের বুঝেও কিছু করার সামর্থই বা কি আছে। বেঁটে মানুষ আমি, লাফ দিলে কি আর চাঁদ ছুঁয়ে দেখতে পারি? মোটেই না। তাই আফসোস আর উৎকন্ঠা মনের ভেতর চিন চিন ব্যাথা ধরায়, অসহ্য যন্ত্রণার রব উঠে। মনের না বলা কথা একসময় মিলিয়ে যায় মনের গহীনে। কুঁড়েঘরে থেকে কি আর শিল্পের বড়াই মানায়? আবারো সেই ব্যাথা জ্বালা ধরায়, আগ্নেয়গিরির লাভার মতো সে উপর দিকে উদগীরিত হয়ে উঠে। এবার বুঝি বেরিয়ে আসবে জ্বালামুখ থেকে।
একটা সময় আমার 'মা' আমাকে বাড়ি থেকে বের হতে দিতেন না। মা ভাবতেন বাইরে বের হলেই ছেলেধরা ( খুছকর) ধরে নিয়ে যাবে। এদের হাতে নাকি চটের বড় একটা থলে থাকে, হাতে থাকে অজ্ঞান করে দেবার ঔষধ। বাচ্ছা ছেলেমেয়েদের দেখলেই অজ্ঞান করে হাতে রাখা চটের থলেতে পুরে নিয়ে যাবে দূর কোথাও! কাজেই বাড়ির প্রাচীর টপকানো রীতিমত দু:সাধ্য ছিলো। অবশ্য খুছকর মহাশয়ের দেখা মেলেনি কখনো। সীমিত মানুষের সিলেট সীমিত যানবাহনের শহরে বেবিটেক্সি'র (একধরনের বাহন) শব্দ শুনলেই ভোদৌঁড়। মিথ ছিলো এসব ছেলেধরা'রা নাকি বেবিটেক্সিযোগেই আসে।
তারপর কেটে গেছে কত প্রহর, কত বছর । ছেলেধরা আর দেখা হয়ে উঠেনি। আমি এখন কর্মক্ষম, এক কন্যা সন্তানের পিতা। ফেলে আসা চিরচেনা সেই একই আকাশের নীচের স্থায়ী বাসিন্দা। বামে গেলেও আকাশ আমার, ডানে গেলেও আকাশটা আমার। এখানে নেই কোন বিভাজন, নেই কোন ছেলেধরার আতংক। তাহলে মন কুঁকড়ে যাবার কারণ কী? পৃথিবীর সব ঘটে যাওয়া ঘটনার পেছনে আরেকটি ঘটনা বর্তমান। সত্যাশ্রয়ীদের চোখে সেটি সত্য আর মিথ্যাশ্রয়ীদের চোখে সেটি মিথ্যা বেদনাদায়ক অনুভূতি।
প্রযুক্তির ক্রমবিকাশের সাথে সাথে মানুষের আয়েশি জীবনের যেমন সীমারেখ টানতে পারবো না, তেমনি উচ্চ বিলাসীদের কারণে অকারণে ঝগড়াঝাঁটিরও সমাধান দিতে পারবো না। আগেই বলেছি আমি এক নগণ্যজন। কিন্তু পরিস্থিতির ঘোলাটেকরণে আমি আর কিছু পারি আর না পারি অন্তত স্বজনের কাছে কিছু অনুরোধ অনুযোগতো করে যেতে পারি। রাখা না রাখা সেটি স্বজনদের স্বকীয় ভাবনা, পুরো মুখটা নাই ঢুকালাম।
শহরে হ্ঠাৎ গুজব এলো পদ্মা সেতুর জন্য মাথা চাই। মাথা চাই মানে! আস্ত মাথা তাও শিশুবাচ্চাদের। এক কান দুকান করে করে বাংলাদেশ নামক ভূখন্ডের প্রতিটি পাড়া মহল্লায় এই আতংক ছড়িয়ে পড়লো। এই তো শুরু। খবরের কাগজের জন্য একটি কথা প্রচলিত আছে, "বাজে খবর নাকি বাতাসের আগেও ছড়িয়ে পড়ে।" কথাটা যে মিথ্যা নয়, এটি বুঝতে সময় লাগেনি। মুহূর্তে ছড়িয়ে পড়ার কারণে অপ্রত্যাশিত কিছু ছন্দপতন কিছু প্রিয়মুখ আমাদেরকে হারাতে হচ্ছে চিরদিনের জন্য।
তাসলিমা বেগম রেনু (৪০) লক্ষ্মীপুরের রায়পুর উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ১নং ওয়ার্ড উত্তর সোনাপুর গ্রামের বাসিন্দা। ৫ বোন ও এক ভাইয়ের মধ্যে রেনু সবার ছোট। তাহসিন আলমাহিদ (১১) ও এক মেয়ে তাসমিন তাবা (৪)।
ছেলে-মেয়েকে ভালো স্কুলে পড়াবেন, সন্তানেরা বড় হবে—এমন অনেক স্বপ্ন ছিল তাঁর। কিন্তু একটি গুজবেই শেষ হয়ে গেল তাসলিমার সব স্বপ্ন। ছেলেধরা গুজবে গণপিটুনির শিকার হয়ে প্রাণটাই দিতে হলো তাকে।
রাজধানীর উত্তর-পূর্ব বাড্ডা প্রাথমিক স্কুলে গত শনিবার মেয়েকে ভর্তি করার জন্য খোঁজ নিতে গিয়েছিলেন তাসলিমা। কথাবার্তা সন্দেহজনক—কেবল এই অজুহাতে স্কুলের বাইরে এনে তাঁকে বেধড়ক মারধর করা হয়। পুলিশ তাঁকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসকেরা তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন। এভাবেই সপ্তাহের ভেতর ঝরে গেছে আরো কিছু প্রাণ। হয়তো এরা কারো পিতা, না হয় ভাই, না হয় কোন বাবা মায়ের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি।
আজ রেনু গেছেন। কাল হয়তো, প্রতিশোধপরায়ন হয়ে কোন শপিং মলে কিংবা কোন রাস্তার মোড়ে আমি অথবা আপনাকে কেউ ছেলেধরা গুজব রটিয়ে এভাবেই শেষ শয্যায় বিছিয়ে দিতে পারে। ভাবেন তো , একবার মাহিদ, তাবা দের অপরাধ কী? কে তাদের শাড়ীর আচলে মুখ মুছে দেবে। কে তাদের ভাতের গ্রাসটা মুখে পুরে দেবে?
একটিবারের জন্য ভাবেন তো, কি করলেন আপনারা? কেনো করলেন? রেনু মহিলাটির ফরিয়াদ একবারের জন্যও আপনারা শুনার প্রয়োজন মনে করলেন না! যারা লাঠি, হাত পা চালালেন একের পর এক, তারা একটিবার ভেবে দেখলেন না, ইনিও এক জননী, উনার প্রতীক্ষায়ও পথ চেয়ে বসে আছে দুটো সন্তান, এক সন্তান হয়তো ভাবছে , মা আসলেই খেতে বসবো। আরেকটি দুধের বাচ্চা হয়তো নতুন স্কুলে যাবার সুখানুভূতিতে পুলকিত বোধ করছে। হায়রে অভাগা, বেহায়া হন্তারক, কান কি সত্যিই চিলে নিয়ে গেলো!!!
কেবল সন্দেহের বশবর্তী হয়ে এভাবেই চলে যাচ্ছে কিছু জীবন কিছু তরতাজা প্রাণ। অনুগ্রহ করে এবার ক্ষান্ত দেন, প্রথমে জানুন, বুঝুন তারপর সমাধান দেন। এভাবে আপনার আমার দেশ শান্ত থাকতে পারে না। এভাবে কোন দেশ সভ্যতার শিখরে যেতে পারে না। এভাবে কাউকে মেরে ফেলা বীরের ধর্ম নয়। সুড়সুড়ি বিভেদ আনে, সঠিক পথ নির্দেশ করে না। তাছাড়া-
বীরেরা মাথা উঁচু করে বাঁচতে জানে,বীরেরা বীরত্বের ত্যাগে তেজোদীপ্ত হয়;এই বাংলা বীরের দেশ,তোদের জন্য নয়।
লেখক: শিক্ষক, নাট্যকর্মী
আরও পড়ুন
জাতীয় বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
- কাল থেকে যেসব শাখায় পাওয়া যাবে নতুন টাকার নোট
- 'জাতীয় মুক্তি মঞ্চ' গঠনের ঘোষণা
- এক বছরেই শক্তি, ক্ষিপ্রতা জৌলুস হারিয়ে 'হীরা' এখন বৃদ্ধ মৃত্যুপথযাত্রী
- ওয়াহিদ সরদার: গাছ বাঁচাতে লড়ে যাওয়া এক সৈনিক
- ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিকথা (প্রথম পর্ব)
- এবার ভাইরাস বিরোধী মাস্ক বানিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দিলো বাংলাদেশ
- মায়েরখাবারের জন্য ভিক্ষা করছে শিশু
- ২৫ কেজি স্বর্ণ বিক্রি করল বাংলাদেশ ব্যাংক
- ঈদে মিলাদুন্নবী ২০২৩ কত তারিখ
- তালিকা হবে রাজাকারদের
সর্বশেষ
জনপ্রিয়