আব্দুর রব
আপডেট: ১৬:০৫, ১৮ জানুয়ারি ২০২১
জলের গ্রাম অন্তেহরি
‘বর্ষায় নাও হেমন্তে পাও’
জলের গ্রাম অন্তেহরির বর্ষাকালীন রূপ। ছবি: আব্দুর রব
কাউয়াদীঘি হাওরের কোল ঘেঁষে অবস্থিত 'জলের গ্রাম'খ্যাত অন্তেহরি। হিজল-করচ-তমালের বন এই গ্রামটিকে করেছে অপরুপ অনন্য। এখানে বর্ষায় মুগ্ধতা ছড়ায় শাপলা-শালুক। আর শীতে হয়ে উঠে সবুজের রাজ্যে পাখিদের নিরাপদ শান্তির নীড়।
বর্ষাকালে অন্তেহরি গ্রামে যাতায়াতের প্রধান ভরসা নৌকা। অন্যদিকে শীত মৌসুমে পথ চলতে হবে পায়ে হেঁটে। তাহলে বলা যেতেই পারে- ‘বর্ষায় নাও হেমন্তে পাও ’।
মৌলভীবাজার জেলার রাজনগর উপজেলাধীন কাউয়াদিঘি হাওর। এই হাওরের পশ্চিম প্রান্তে ফতেপুর ইউনিয়নের এক নিবৃত পল্লি- অন্তেহরি। জলের গ্রাম অন্তেহরি ভ্রমণে পাবেন প্রকৃতির মমতা মাখা ছোঁয়া। নামে রূপে গ্রামখানি প্রশান্তির আদর্শ স্থান। ধূলোমাখা মেঠোপথ পেরিয়ে প্রবেশ করতে হয় গ্রামটিতে।
প্রবেশের সাথে সাথে এর বিচিত্র রুপ আপনাকে স্পর্শ করবে। বর্ষায় গ্রামের বাড়িগুলো দেখতে যেমন মনে হয় পানির উপর ভেসে আছে । শীত মৌসুমে তার বিপরীত। শীতে এক একটি বাড়ি মনে হবে টিলার উপর তৈরি।
হাওরের বাড়িঘর খুব সহজে পানিতে নিমজ্জিত হয়, ফলে বাড়িগুলো অনেক উঁচুতে নির্মাণ করতে হয়। প্রতিটি বাড়ির চারিদিকে দেখা মিলবে বিভিন্ন জাতের গাছ গাছালি। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে হিজল-তমাল- করচ। এই গাছগুলোই বর্ষায় হাওরের ঢেউ থেকে বাড়িগুলোকে রক্ষা করে এবং সারাবছর দেশীয় পাখিদের জন্য নিরাপদ আবাসস্থল হয়ে রয়েছে।
শীত মৌসুমে দেশি- বিদেশি নানা জাতের পাখি একত্রে বসবাস করে এখানে। গ্রামের লোকজন কেউ পাখি শিকার করেন না। বাইরে থেকে কেউ পাখি শিকারের উদ্দেশ্যে এলে তারা কঠোরভাবে প্রতিরোধ করেন।
এই গ্রামের তরুণ শিক্ষক পিকলু দাশ। তিনি জানান- আমাদের গ্রামের সব বাড়িতে সারাবছর পাখিরা বসবাস করে। পাখিদের কেউ বিরক্ত করে না। আমরা ছোটবেলায় দেখেছি প্রচুর পাখি শিকার হতো, কিন্তু এখন কেউ পাখি শিকার করে না। গ্রামের মানুষ এখন অনেক সচেতন, পাখিদের নিরাপত্তায় আমরা সব সময় সচেষ্ট থাকি। বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ আসে পাখি দেখতে, দেখে তারা মুগ্ধ হয়, আমাদেরও ভালো লাগে।
বর্তমানে হাওর শুকনো, মাঠে সবুজ কচি ঘাস দেখলে মনে হবে সবুজ গালিচা বিছানো রয়েছে। যতদূর চোখ যায় শুধু এই দৃশ্য। সবুজ মাঠে হাজার হাজার সাদা বক উড়ে বেড়ায় খাদ্যের সন্ধানে। সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে হেলান দেয় তখন নানা জাতের পাখিগুলো গ্রামের গাছগুলোতে এসে আশ্রয় নেয়। ঘুরতে আসা ভ্রমণপিপাসুরা এমন দৃশ্য দেখে মুগ্ধ হন বেশি।
শহর থেকে ঘুরতে আসা তপন দে জানান- শুনেছি অনেক পাখির বসবাস। আসার পর পুরোই অবাক। এতো পাখি একসাথে কখনো দেখিনি। হাজার হাজার সাদা বক ঝাঁক বেধে উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখিরা বসার পর প্রতিটি সবুজ গাছ সাদা রং ধারণ করেছে। এছাড়া পানকৌড়ি, শামুককুল,কানিবক, ডাহুক সহ নানা জাতের পাখি দেখেছি। পাখিদের কলরবে সত্যিই বিকেলটা দারুণ মুগ্ধতায় কাটলো।
একদিকে সবুজ মাঠ অন্যদিকে হিজল-তমাল- করচের বন দেখে মনে হবে শিল্পীর তুলিতে আকা ছবি। এই গ্রামে স্থানীয় দর্শনার্থীদের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ভ্রমণপিপাসুরা এসেছেন ঘুরতে।
এখানে স্ববান্ধবে ঘুরতে এসেছেন জুয়েল আহমদ। তিনি জানান এই গ্রামে বর্ষায় এবং শীতে দুই রুপ। বর্ষায় চলতে হয় নৌকা করে আর শীতে পায়ে হেঁটে। বর্ষায় অনেকবার এসেছি, শীতে এই প্রথম আসলাম। পুরো গ্রাম ঘুরলাম, একটা মুগ্ধতা নিয়ে ফিরছি।
বর্ষায় হাওরের বুকে থাকে থইথই জল কিংবা জলের উপর এক টুকরো সবুজের হাতছানি। শাপলা-শালুক অথবা নাম না জানা বাহারী বর্ণের ফুল যেন জানান দেয়- স্বাগতম হে অতিথি জলের গ্রামে।
হাওর পাড়ের এই গ্রামটির অধিকাংশ মানুষই কৃষিজীবী। হাওরে সাধারণত একটি ফসল হয় বোরো ফসল। বোরো ফসলের উপর নির্ভর করে সারা বছর চলতে হয় গ্রামবাসীদের। খাদ্য, শিক্ষা, চিকিৎসাসহ সকল মৌলিক চাহিদা ও সামাজিক অনুষ্ঠান এই ফসলের আয় থেকেই চলে। পাশাপাশি যে সময় যে কাজ পান সেগুলোও করে জীবন ধারণ করেন গ্রামবাসীরা। কেউ কেউ আবার বর্ষা মৌসুমে হাওরে মাছ ধরে বাজারে বিক্রি করে চাহিদা পূরন করেন।
২০১৮ সালে এই গ্রামটিকে সরকারিভাবে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করা হয়। নামকরণ করা হয় 'জলের গ্রাম অন্তেহরি' সারাবছর পর্যটকরা নির্বিঘ্নে আসার লক্ষ্যে নানাবিধ উদ্যোগ নিয়ে কাজ চলছে। সরকারি উদ্যোগে ইতোমধ্যে কিছু উন্নয়ন হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পরিকল্পনা চলছে। এই গ্রামকে পর্যটন কেন্দ্র ঘোষণা করায় কাজের সুযোগ পাবেন বোরো ফসলের উপর নির্ভরশীল গ্রামের অনেক দরিদ্র মানুষ। পাশাপাশি বাড়বে তাদের জীবনযাত্রার মানও।
এখানকার সবচাইতে আকর্ষণ- জলের মধ্যে হিজল-করচের ডুবাডুবি খেলা, যা ভাটিবাংলার মানুষের কাছে অতি সাধারণ দৃশ্যপট আর নগরজীবনের কাছে কৌতূহল। পুরো গ্রাম মনে হবে জলের উপর ভেসে বেড়াচ্ছে, প্রতিটি বাড়ি মনে হবে ভাসমান কটেজ। খাল, বিল, পুকুর কিংবা গ্রামীণ রাস্তা-ঘাট সব একাকার হয়ে যায় হাওরের পানিতে। এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি যাতায়াতের ভরসা নৌকা।
গলা ডোবা হিজল গাছের পাশ দিয়ে যখন নৌকা চলে সামনে, তখন বুঝে নিবেন কোনো ডুবন্ত রাস্তার উপর দিয়ে যাচ্ছেন। কোথায় রাস্তা, কোথায় খাল, কোথায় পুকুর কিংবা কোথায় স্থল। এসবই ৬ মাসের জন্য পানিতে ডুব দেয়।
অন্তেহরির প্রধান রাস্তা ধরে যখন হেঁটে যাবেন সামনে তখন হারিয়ে যাবেন প্রকৃতির রাজ্যে আর হঠাৎ চোখ পড়বে রাস্তার পাশে অযত্নে ফুটে থাকা বনফুলের দিকে। যা গ্রামীণ আবহের আরেক চিত্র। চাইলে সেখানে দাঁড়িয়ে ছবিও তুলে নিতে পারেন। কোথাও আবার কানে ভেসে আসবে টুংটাং শব্দ। এগিয়ে গেলে দেখবেন কারিগররা নতুন নৌকায় পেরেক মারতে ব্যস্ত। নৌকা তৈরির শিল্প কৌশলটাও দেখে নিতে পারেন খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে।
টলটলে জলের উপর দিয়ে ছুটে চলে মাঝির ডিঙি নৌকা, এই জলই আবার বিশাল জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রধানতম মাধ্যম। গভীর হাওরে চোখ পড়বে নৌকার উপর। যেখানে দল বেঁধে জাল টানছেন জেলেরা। আর সারি গেয়ে জাল টানার দৃশ্যটা বেশ নান্দনিক। জলের গভীরে লুকিয়ে থাকা সম্পদের খোঁজে জেলেদের ঘাম ঝরানো গল্পটা প্রতিদিনের। নৌকা ভিড়িয়ে দেখে নিতে পারেন জেলেদের মাছ ধরার বিচিত্র কৌশল।
মৌলভীবাজার শহর থেকে অন্তেহরি গ্রামের দুরত্ব ১৪ কিলোমিটার। বসবাস প্রায় ৬ হাজার মানুষের। ৪/৫ বছর আগেও বিশেষ করে বর্ষা মৌসুমে শহরের সাথে গ্রামটির সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকতো। বর্তমানে সড়ক পথের বেশ উন্নতি হয়েছে। তাই গাড়িতে করে সহজে যেতে পারেন অন্তেহরি। প্রকৃতির উদারতা ও প্রাণবন্ত জীবনের স্বাদ নিতে ছুটে আসুন হাওরপাড়ে।
যেভাবে যাবেন:
মৌলভীবাজার শহরের চাঁদনীঘাট ব্রিজ সংলগ্ন জগতপুর স্ট্যান্ড থেকে ৩০ টাকা ভাড়ায় সিএনজি চালিত অটোরিকশাতে করে যেতে পারেন। অথবা রিজার্ভ গাড়ি নিয়েও সোজা চলে যেতে পারেন অন্তেহরি বাজারে।
আইনিউজ/এসডিপি
- সিলেট ট্রেনের সময়সূচি ২০২৩ দেখুন
- ঢাকা টু সিরাজগঞ্জ ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- চট্টগ্রাম টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- শীতকালে সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ
- ঢাকা টু পাবনা ট্রেনের তালিকা এবং সময়সূচী
- ‘লাসুবন’- শ্রীমঙ্গলে প্রাচীন গিরিখাতের সন্ধান!
- এবার মাল্টার ভিসা পাওয়া যাবে ঢাকা থেকেই!
- ঢাকা টু দিনাজপুর ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা ২০২৩
- টাঙ্গাইল টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়া তালিকা
- ঘুরে আসুন ঝর্ণার স্বর্গ মিরসরাই সীতাকুণ্ডে