সুমন্ত গুপ্ত
আপডেট: ১৯:২৪, ৭ ফেব্রুয়ারি ২০২২
সুনামগঞ্জের মহিষখোলা গ্রাম
যাদুকাটা নদী
সুনামগঞ্জের মহিষখোলা গ্রাম : স্থপতি রাজন দাশ সিলেটের জনপ্রিয় এক নাম। স্যারের বেশ কিছু স্থাপত্য কর্ম বেশ প্রশংসাও অর্জন করেছে। অনেক দিন ধরে প্ল্যান করছি স্যারকে নিয়েই বের হবো তার স্থাপত্য কর্মগুলো দেখতে। কিন্তু স্যার সব সময় ব্যস্ত থাকায় ব্যাটে বলে মিলছিলো না। তারপরেও আশা ছাড়িনি।
অবশেষে একদিন বিকেলে স্যারের কাছ থেকেই এলো ফোন। ফোনেই ঠিক হলো দিনক্ষণ। পরেরদিন সকাল সকাল বের হচ্ছি। শীত যাই যাই করছে। এই আরামদায়ক সকালে ঘুম থেকে উঠতে ইচ্ছে করে না। তারপরেও মায়ের তাড়ায় দ্রুত তৈরি হয়ে নিলাম।
চারদিকে শান্ত নিরব পরিবেশ। গ্রামের পশ্চিমে গা ঘেঁষে মহিষখোলা নদী, উত্তরে ২০০ গজের মধ্যেই ভারত সীমান্তে মেঘালয়ের পর্বতমালা, পূর্বে সংখ্যাতীত খাল-বিল আর সুবিশাল টাঙ্গুয়ার হাওর। এ হাওরের সঙ্গে রাগে-অনুরাগে জড়িয়ে আছে আরেকটি স্নিন্ধ নদী যাদুকাটা।
মহিষখোলা : যে গ্রামে ঘুমিয়ে আছেন একাত্তরের বীর শহীদেরা
রাজান স্যারকে তাঁর বাসা থেকে তুলে নিয়ে শুরু হলো আমাদের যাত্রা। যাচ্ছি সুনামগঞ্জ জেলার উত্তর-পশ্চিম প্রান্তে ভারত-সীমান্ত লাগোয়া ধর্মপাশা উপজেলার মহিষখোলা গ্রামে। সেখানে ঘুমিয়ে আছেন একাত্তরের বীর শহীদেরা।
স্নিগ্ধ সকাল। জিন্দাবাজার, চৌহাট্টা, আম্বরখানা পেরিয়ে এগিয়ে চলেছি। মহাসড়কে সূর্যদেবের আভা পড়েছে তির্যকভাবে। পেটে দানাপানি দিতে যাত্রা বিরতি দিলাম পাগলা বাজারে। কোনো দিকে না তাকিয়ে সোজা ঢুকে পড়লাম দয়াল মিষ্টান্ন ভাণ্ডারে।
ওখানকার গরম গরম পরটা আর ভাজি ছিল এককথায় অমৃত। পেটে ক্ষুধা থাকায় সেসব শেষ হতে খুব একটা সময়ও লাগলো না। পেট পূজা শেষ করে আবার শুরু হলো আমাদের যাত্রা।
ঘড়ির কাঁটার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পৌছালাম সুনামগঞ্জ শহরে। এখান থেকে যেতে হবে তাহিরপুর। গ্রামীণ পথে চলার মজাই আলাদা। দুই পাশে ধানক্ষেত। সেসবের মাঝ দিয়ে সোজা এগিয়ে চলেছি।
সুনামগঞ্জ থেকে প্রায় দুই ঘণ্টার পথ পাড়ি দিয়ে এসে পৌঁছালাম তাহিরপুর বাজারে। একটু অধৈর্য্য হয়ে রাজন স্যারকে বলেই বসলাম, আর কতক্ষণ? স্যার বললেন, এবার টাঙ্গুয়ার হাওর হয়ে যেতে হবে। সময় লাগবে প্রায় দুই থেকে আড়াই ঘণ্টা। বর্ষা ছাড়াও এই মৌসুমেও হাওয়ারের একটা আলাদা সৌন্দর্য আছে। সেটা দেখার জন্য স্পিডবোটের বদলে শ্যালো ইঞ্জিনের নৌকাতেই যাওয়ার সিদ্বান্ত নিলাম।
টাঙ্গুয়ার ঢেউয়ের তালে তালে এগিয়ে চলছি। যেতে যেতে জলকেন্দ্রিক মানুষের জীবনধারা কিছু কিছু নমুনা আমাদের চোখে পড়ে। সেসব ধারণ করার জন্য ইচ্ছে মতো ছবি তুলতে লাগলাম। দেখতে দেখতে কিভাবে যে আড়াইঘণ্টা পেরিয়ে গেলো টেরই পেলাম না।
আমাদের নৌযানটি এসে ভিড়লো ধর্মপাশা উপজেলার মধ্য নগর গ্রামে। সেখানে অপেক্ষা করছিল রাজন স্যারের সহচর সোহাগ আর মুনিম। মোটরবাইকে চেপে বসলাম। এখান থেকে মহিষখোলা গ্রামের পথ দশ মিনিটের। মোটামুটি সেই সময়ের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমাদের সেই গন্তব্যে, মহিষখোলা গ্রামে।
চারদিকে শান্ত নিরব পরিবেশ। গ্রামের পশ্চিমে গা ঘেঁষে মহিষখোলা নদী, উত্তরে ২০০ গজের মধ্যেই ভারত সীমান্তে মেঘালয়ের পর্বতমালা, পূর্বে সংখ্যাতীত খাল-বিল আর সুবিশাল টাঙ্গুয়ার হাওর। এ হাওরের সঙ্গে রাগে-অনুরাগে জড়িয়ে আছে আরেকটি স্নিন্ধ নদী যাদুকাটা। শ্রীচৈতন্যের জেষ্ঠ্য পার্ষদ অদ্বৈতাচার্য এই নদীপাড়েরই সন্তান ছিলেন। মহিষখোলা নদীর পূর্বপাড় ঘেঁষে একখানা প্রায় নিশ্চিহ্ন এক টিনের ঘর চোখে পড়লো।
সব কটা জানালা খোলা
সামনের দিকে আমরা এগিয়ে যেতে লাগলাম। কিছুদূর যেতেই চোখের সামনে ভেসে উঠলো ‘সব কটা জানালা।
মহিষখোলা মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নং সেক্টর ১নং সাব-সেক্টরের অন্তর্গত ছিল।
মহিষখোলা নদীর তীরে এই স্মৃতিসৌধ কাজ শুরু হয় ২০১২ সালে। সুনামগঞ্জ জেলা পরিষদের সহযোগিতায় কাজ শুরু হয় এই শহীদ মিনারের। এর আগে ৪২ বছর ধরে মনুষ্যস্পর্শহীন ঘরের আশপাশটা জঙ্গলে পরিণত হয়েছিল অঞ্চলটি। অথচ এই ঘরে ১৯৭১ সালে মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের ফাঁকে ফাঁকে বিশ্রাম নিতেন। এমনকি পাক হানাদারদের ধরে এখানে বন্দী করে রাখা হতো। মুক্তিযুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের এক ভয়াল সংঘর্ষ হয়। অনেক যোদ্ধা মারা যান। মহিষখোলা নদীর পাড়ঘেঁষা এই বাড়িটি ধ্বংস হয়ে যায় তখনই। আর শহীদ যোদ্ধাদের গণকবর রচিত হয় তারই এদিক-ওদিক।
'সব কটা জানালা' খোলা
আমরা ঘুরে দেখছি শহীদ মিনারের চারপাশ। চারদিকে বইছে পূবালী বাতাস, অসাধারণ পরিবেশ। রাজন স্যারের কাছে জানতে চাইলাম তাঁর এই “সব কটা জানালা খুলে দাও না” এর স্থাপত্য ভাবনা। স্যার বললেন এখানেই শায়িত আছেন একাত্তরের শহীদ হওয়া বীরপ্রাণ। এই স্মৃতিসৌধের পূর্ব-পশ্চিম দিকে সমান্তরাল দুটি সুউচ্চ দেয়াল নয় ফুট বেদির উপর দাঁড়িয়ে আছে, তার উপর ছাদ এর ছায়া এসে পরে। সিড়ি ভেঙ্গে পূর্বদিকের তাকালেই দেখা পাওয়া যায় নদী পারের মানুষের জীবনযাত্রা। তাছাড়া উত্তর-দক্ষিণের ২৭ ফুট উঁচু দেয়ালে অনেকগুলো ছোট-বড় জানালা খোলা অবস্থায় আছে। ঠিক চোখ-মেলে-তাকানোর মতো। ‘যারা এই দেশটাকে ভালবেসে দিয়ে গেছে প্রাণ’, তারা তো বদ্ধ ঘরে থাকে না তাই। তাই ‘সব কয়টা জানালা’ই খুলে আছে।
১৮৭০০ স্কয়ার ফিট জায়গার ওপর নির্মিত হয়েছে এই স্মৃতিসৌধ। স্মৃতিসৌধ তৈরিতে খরচ হয়েছে দেড়কোটি টাকা। আমাদের মতো এই এলাকার আশপাশ থেকে অনেকেই এসেছেন এই দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ দেখতে। এই স্মৃতিসৌধের স্থপতিকে কাছে পেয়ে সবাই খুব খুশি। কেউ কেউ আবার স্যারের কাছে আবদার করে বসলেন ছবি তোলার জন্য। স্যার সবার সাথে ছবি তোলায় ব্যস্ত। এই ফাঁকে আমি একের পর এক ছবি তুলতে লাগলাম। যারা স্মৃতিসৌধ দেখতে এসেছেন সবার একি কথা যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি সাধন হলে অনেক পর্যটক আসবেন এই দৃষ্টিনন্দন স্মৃতিসৌধ দেখতে।
বাটা মশলায় হাওরের মাছের খাবার
হোটেলে প্রবেশ করতেই আমাদের মাঝে পরিবেশন করা হলো নানা রকমের মাছের তরকারি। রানী মাছ, টেংরা মাছ, পুঁটি মাছ, মলা মাছ আরো নাম না জানা মাছ। আমরা রানী মাছ, টেংরা মাছ, ভেরাইটিজ মাছ নিলাম আহারের জন্য। প্রতিটি পদ এর স্বাদ অসাধারণ।
এদিকে আমার পেটে আবার রাম রাবনে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আমার চেহারা দেখে স্যার ঠিক ধরতে পেরেছেন যে আমার পেটে আবার কিছু দিতে হবে। বললেন কি পেটে কিছু দিতে হবে তাই না। আমি ভদ্রতার খাতিরে বললাম না না স্যার কি যে বলেন আমি আরো দুই তিন ঘণ্টা না খেয়ে থাকতে পারবো। স্যার বললেন আমার তো পেটে লেগেছে খুব। চল তাহিরপুর বাজারের দিকে যাই। তাহিরপুর বাজার অনেক পুরনো বাজার। সেখানকার হোটেলগুলোতে টাঙ্গুয়ার হাওর থেকে আহরিত টাটকা মাছ দিয়ে খাবার পরিবেশন করা হয়। এই কথা শোনার পর আমার জিভে জল আশার যোগাড়। আমরা স্মৃতিসৌধ পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম টাঙ্গুয়ার হাওর পাড়ি দিতে। টাঙ্গুয়ার হাওর এর শীতল বাতাস আমাদের চলার পথের ক্লান্তি দূর করে দিচ্ছিল।
আমরা এসে পৌঁছালাম তাহিরপুর বাজারে। এবার পেট পূজার পালা। আমরা ঢুকে পড়লাম এক নাম না জানা হোটেলে। হোটেলে প্রবেশ করতেই আমাদের মাঝে পরিবেশন করা হলো নানা রকমের মাছের তরকারি। রানী মাছ, টেংরা মাছ, পুঁটি মাছ, মলা মাছ আরো নাম না জানা মাছ। আমরা রানী মাছ, টেংরা মাছ, ভেরাইটিজ মাছ নিলাম আহারের জন্য। প্রতিটি পদ এর স্বাদ অসাধারণ। আর এতে ব্যবহার করা হয়েছে বাটা মশলা। আমরা শহুরে জীবনে সাধারণত গুঁড়া মশলার ওপর নির্ভরশীল। তাই সেই আগেরকার দিনের স্বাদ আর গন্ধ অনুভব করলাম আমরা। আমাদের আহার পর্ব শেষ হবার পর স্যার বললেন আমি চা খাবো। তুই খাবি নাকি। এখানকার চা শহরের মত কন্ডেন্সড মিল্ক দিয়ে হয় না, হয় গরুর দুধ দিয়ে। আমি বললাম চা খাবো না। তবে দুধের স্বর খেতে পাড়ি। সাথে সাথে আমার সামনে দুধের স্বর পরিবেশন করা হল। অসাধারন স্বাদ। অনেক দিন পর খেলাম। অনেক আগে একবার মামার সাথে বেড়াতে গিয়ে ঢাকার মুন্সীগঞ্জে গিয়ে খেয়েছিলাম। আজ এবার খেলাম। এদিকে সূর্যদেবের প্রস্থানের সময় চলে এসেছে আমাদেরও ফিরে যেতে হবে শহর পানে। আমারা ছুটে চললাম শহর পানে। সেই নাগরিক জীবনের মাঝে।
কিভাবে যাবেন
ঢাকা থেকে সুনামগঞ্জ যাবার সরাসরি বাস রয়েছে। এনা, হানিফ, শ্যামলী, ইউনিকসহ অনেক বাস এই পথে চলে। তবে অবশ্যই অগ্রিম টিকিট কেটে রাখুন। তাহলে ঝামেলা পোহাতে হবে না। ভাড়া ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা।
সুনামগঞ্জ শহরে এসে এম এ খান সেতুর কাছে পাবেন মোটরবাইক। অথবা গাড়ি নিয়ে চলে যান তাহিরপুর বাজার। সেখান থেকে নৌকা করে চলে যান মধ্যনগর গ্রামে। মধ্যনগর থেকে মহিষখোলা গ্রাম দশ মিনিটের রাস্তা। দলবেঁধে ঘুরতে গেলেই বেশি আনন্দ করতে পারবেন।
সুনামগঞ্জে কোথায় থাকবেন
সুনামগঞ্জ শহরে থাকার মত উন্নত হোটেল, রিসোর্ট নেই। মোটামুটি মানের কিছু আবাসিক হোটেল আছে।
সুনামগঞ্জের উল্লেখযোগ্য সরকারি ও বেসরকারি আবাসিক হোটেল ও ডাকবাংলোর ঠিকানা ও যোগাযোগ নাম্বার
তাহিরপুরে ২-৩টি আবাসিক হোটেল আছে। বাদাঘাট বাজারে অবস্থিত আবেদীন হোটেল, তারেখ হোটেল ও মক্কা মদিনা হোটেল অবস্থিত।
সুমন্ত গুপ্ত, ভ্রমণ লেখক
- সিলেট ট্রেনের সময়সূচি ২০২৩ দেখুন
- ঢাকা টু সিরাজগঞ্জ ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- চট্টগ্রাম টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- শীতকালে সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ
- ঢাকা টু পাবনা ট্রেনের তালিকা এবং সময়সূচী
- ‘লাসুবন’- শ্রীমঙ্গলে প্রাচীন গিরিখাতের সন্ধান!
- এবার মাল্টার ভিসা পাওয়া যাবে ঢাকা থেকেই!
- ঢাকা টু দিনাজপুর ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা ২০২৩
- টাঙ্গাইল টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়া তালিকা
- ঘুরে আসুন ঝর্ণার স্বর্গ মিরসরাই সীতাকুণ্ডে