সুমন্ত গুপ্ত
আপডেট: ১৭:৫৪, ১৮ ফেব্রুয়ারি ২০২২
শমসেরনগর বধ্যভূমি
শমসেরনগর বধ্যভূমি
আজ বিকেলে ফিরতে হবে নিজ গন্তব্য স্থলে। তাই আগে থেকেই পরিকল্পনা করে রেখেছিলাম আজ সকাল সকাল বের হবো নতুন গন্তব্যের সন্ধানে। তা নাহলে ফিরতি ট্রেন ধরতে দেরি হয়ে যাবে। শীত আসি আসি করছে তাই এই সময়টার ঘুম অন্য যে কোন সময়ের তুলনায় আরামদায়ক। তাই ঘুম থেকে উঠতে কষ্ট হচ্ছিল বৈকি।
আমি বললাম, চা বাগান তো দেখেছি আর কোথায় যাওয়া যায়? তিনি বললেন তাইলে আপনারা বধ্যভূমি থেকে ঘুরে আসতে পারে। সেখানে তেমন একটা লোকজন যায়না বললেই চলে।
ঘুম থেকে উঠেই প্রস্তুতি নেয়া শুরু করলাম নতুন গন্তব্যে যাওয়ার জন্য। মনে মনে ভাবছিলাম কোথায় যাওয়া যায়। কারণ বেশি সময় দেয়া যাবে না। ফিরতি ট্রেন ধরে আমাদের ফিরে যেতে হবে শহর পানে। অহ বলাই হলো না আমরা আছি সিলেটের মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ উপজেলার শমসেরনগরে অবস্থিত সুইস ভ্যালী রিসোর্টে। আমরা রিসোর্টের কর্মীর কাছে জানতে চাইলাম, আশেপাশে খুব কম সময়ে কোথা থেকে ঘুরে আসতে পারবো। বলতেই বললেন নিকট দূরত্বে চা বাগান আছে। সেখানে ঘুরে আসতে পারেন। আমি বললাম, চা বাগান তো দেখেছি আর কোথায় যাওয়া যায়? তিনি বললে্ তাইলে আপনারা বধ্যভূমি থেকে ঘুরে আসতে পারে। সেখানে তেমন একটা লোকজন যায়না বললেই চলে। আমি বললাম, তাহলে যাওয়া যায়। আর এই সুযোগে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে শহীদ বীর সেনানীদের শ্রদ্ধা ও জানিয়ে আসতে পারবো।
আমি বললাম, আমরা যাবো কিভাবে? প্রত্যুত্তরে রিসোর্টের কর্মী বললেন, আপনি রিসোর্ট থেকে বের হয়ে যে কাউকে বললেই আপনাকে ঘুরিয়ে নিয়ে আসবে শমসেরনগর বধ্যভূমি থেকে।
আমরা বের হলাম রিসোর্ট থেকে বের হয়েই পথের ধারে তিন চাকার যানবাহন পেলাম। বললাম বধ্যভূমি যাবো। আমার কথা শুনে আকাশ থেকে পরলেন তিন চাকার যানের কাণ্ডারি। তিনি বললেন, এখানে বধ্যভূমি পেলেন কোথা থেকে? আমি বললাম, সামনেই আছে বুঝি। আমার কথা শুনে পাইলট মহোদয় বললেন, চলেন যাই। খুঁজে বের করে নেবো। আশেপাশে আর কোন যানবাহনের দেখা নেই। ভাবলাম ওনাকেই নিয়ে নেই খুঁজে বের করে নেবো । এখন সময় নষ্ট করা যাবে না।
আমরা বের হলাম। পাইলট সাহেব বললেন, বাজারে গিয়ে দেখি কেউ চিনতে পারে কিনা আপনাদের কাঙ্খিত বধ্যভূমি। স্বল্প সময়ের মধ্যে আমরা পৌঁছে গেলাম বাজারে। পাইলট মহোদয় কয়েক জনের সাথে কথা বললেন। এবার বললেন- ‘চলেন। এইবার চিনতে পেরেছি। এখানে মানুষজন যায় না বললেই চলে তাই চিনতে পারছিলাম না আমি।’
ভ্রমণ বিষয়ক আরো ফিচার পড়ুন : রোমাঞ্চকর মৌলভীবাজারের দর্শনীয় স্থান কালা পাহাড়
পঁচিশ মিনিটের মাঝেই আমরা পৌঁছালাম শমসেরনগর বধ্যভূমি। জঞ্জালে ঘেরা অপরিছন্ন অবস্থায় দেখতে পেলাম বধ্যভূমি। দেখে খারাপই লাগলো। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর, পৃথিবীর বুকে জন্ম নেয় নতুন একটি রাষ্ট্র। বিশ্ব মানচিত্রে যুক্ত হয় বাংলাদেশের নাম। টানা ৯ মাস ধরে চলা রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বাংলাদেশকে দিতে হয়েছে ৩০ লক্ষ শহীদের প্রাণ। আর দুই লক্ষ মা-বোনের সম্ভ্রম। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার দ্বারা এদেশের মানুষের সাথে ঘটে যাওয়া বর্বরতা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন ঘটনার অন্যতম উদাহারণ। আর বাংলাদেশ শহীদের আত্মত্যাগ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের নিখাদ দেশপ্রেমের চূড়ান্ত ফসল। কিন্তু আমরা সেই সব শহীদদের প্রতি প্রাপ্ত সম্মান কি দেখাতে পেরেছি! জানিয়েছি কি সেই সব শহীদদের আত্মত্যাগের ইতিহাস প্রজন্মের কাছে!
মনে মনে খুঁজছিলাম শমসেরনগর বধ্যভূমির ইতিহাস সম্বলিত কোন ফলক পাওয়া যায় কিনা। কিন্তু কোন ইতিহাস লিপিবদ্ধ অবস্থায় দেখতে পেলাম না। শুধুমাত্র মুক্তিযুদ্ধকালীন গণহত্যার স্বীকার শহীদদের নাম ও ঠিকানা একে একে করে দেওয়া আছে। বধ্যভূমির পাশে তেমন কারো দেখাই পেলাম না, কিছুক্ষণ পরপর যাত্রীবাহী যানবাহন ছাড়া। আমার পাইলট মহোদয়ও এর ইতিহাস সম্পর্কে কিছুই বলতে পারলেন না।
ভ্রমণ বিষয়ক আরো ফিচার পড়ুন : ‘লাসুবন’- শ্রীমঙ্গলে প্রাচীন গিরিখাতের সন্ধান!
ফলকে যাঁদের নাম দেখতে পেলাম তাঁরা হলেন : পিযুষ পাল– সোনাপুর গ্রাম, প্রতাপ পাল- সোনাপুর গ্রাম, মো. রুস্তম মিয়া– কেছ্লুটি গ্রাম, মো. আমজদ আলী- শমশেরনগর বাজার, মো. মবশ্বীর আলী- সোনাপুর গ্রাম, আব্দুল হাই– শিংরাউলী গ্রাম, মরহুমা জহুরা হাই- শিংরাউলী গ্রাম, মোতাহির আলী– শিংরাউলী গ্রাম, হাজী সাদ উল্ল্যা- ভাদাইরদেউল গ্রাম, ডা. হোসেন আহমদ- ভাদাইরদেউল গ্রাম।
আমরা কিছু সময় দাঁড়িয়ে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানালাম। পুবের বাতাস বইছে দূর থেকে ভেসে আসছে পাখিদের ডাক। আমাদের পাইলট সাহেব বললেন, এক জায়গায় বেশি সময় দাঁড়িয়ে থাকবেন না জোঁকে ধরতে পারে। তাঁর কথা শুনতেই আমি তাকাতে লাগলাম পায়ের দিকে। কিছু সময় দাড়াতেই পা বেয়ে বিচুটি ওঠা শুরু করেছিল। চোখে পরেছিল বলে রক্ষা।দেখতে দেখতে কীভাবে যে সময় ছুটে চলছিল আমরা টেরই পেলাম না। আমরা চললাম ফিরতি পথে। প্রকৃতপক্ষে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের চিহ্ন এসব বধ্যভূমি। যেখানে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের ত্যাগ, নির্যাতিত মা বোনদের হাহাকার। আর সাক্ষী হয়ে আছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও এদেশীয় সহচরদের নারকীয় গণহত্যা, নারী নির্যাতনের। দূর থেকে দেখলে মনে হয়- খোলা আকাশের নিচে বধ্যভূমি স্মৃতি স্তম্ভটি নির্ভীক প্রহরীর মতো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে।
কীভাবে যাবেন শমসেরনগর বধ্যভূমি
দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাস, ট্রেন বা বিমানযোগে মৌলভীবাজার যাওয়া যাবে। রেলপথে এলে ঢাকা থেকে সিলেটগামী আন্তঃনগর ট্রেনে করে নামতে হবে শ্রীমঙ্গল স্টেশন, ভানুগাছ বা শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশন বা কুলাউড়া জংশনে। সব আন্তঃনগর ট্রেন শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে যাত্রাবিরতি করলেও ভানুগাছ ও শমসেরনগর রেলওয়ে স্টেশনে সব আন্তঃনগর ট্রেনের যাত্রাবিরতি নেই। ফলে আগেই জেনে নিতে হবে কোথায় নামতে হবে। শ্রীমঙ্গল রেলওয়ে স্টেশনে নামলে সেখান থেকে বাস ও সিএনজি অটোরিকশা পাওয়া যায়। বাসও পাওয়া যায়।
শমসেরনগর পর্যন্ত বাসে যাওয়ার পর সিএনজি অটোরিকশা নিয়ে সহজেই শমসেরনগর বধ্যভূমি পৌঁছানো সম্ভব। যাদের প্রচুর হাঁটার অভ্যাস আছে তারা শমসেরনগর থেকে প্রায় চার কিলোমিটার পথ হেঁটেও যেতে পারেন। আর ঢাকা বা দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে বাসে আসতে চাইলে আসতে হবে মৌলভীবাজার জেলা শহরে। সেখান থেকে লোকাল বাস বা সিএনজি করে শমসেরনগর যাওয়া যায়। সিএনজি করে গেলে সরাসরি বধ্যভূমি যাওয়া যায়। আর লোকাল বাস বাি ট্রেনে গেলে শমসরেনগর বাজার থেকে টমটম (অটোরিকশা) করে বধ্যভূমি যাওয়া যায়। এছাড়া বিমানে এলে সিলেট ওসমানী বিমানবন্দরে নেমে বাস বা ট্রেনে আসা যাবে শমসেরনগর।
মৌলভীবাজারে কোথায় থাকবেন
মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে শতাধিক আবাসিক হোটেল ও রিসোর্ট। মৌলভীবাজারকে হোটেল রিসোর্টের জেলা বলা হয়ে থাকে। কক্সবাজারের পর মৌলভীবাজারে সবচেয়ে বেশি রিসোর্ট রয়েছে। আছে পাঁচতারকা মানের হোটেল থেকে শুরু করে মাঝারি ও কম টাকার হোটেল রিসোর্টও।
গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট এন্ড গলফ এবং দুসাই পাঁচতারকা মানের নয়নাভিরাম রিসোর্ট।এছাড়া মৌলভীবাজার শহরের কাছে মনু নদীর বিচ্ছিন্ন অংশের পারে (যেটা এখন লেকে পরিণত হয়েছে) অবস্থিত রাঙাউটি রিসোর্ট। যেখানে আপনাকে নিয়ে যাবে প্রকৃতির মাঝে।
এছাড়াও নভেম ইকোরিসোর্ট, বালিসিরা রিসোর্ট, সুইচ ভ্যালী রিসোর্ট, টি হ্যাভেন, শান্তিবাড়ি, হীড সহ অসংখ্য হোটেল-রিসোর্ট। সর্বোচ্চ লাখ টাকা থেকে শুরু করে সর্বনিম্ন দেড়শ-দুইশ টাকায় আবাসিক ব্যবস্থা রয়েছে মৌলভীবাজারে। যার অধিকাংশই শ্রীমঙ্গল ও মৌলভীবাজার শহরে অবস্থিত। কমলগঞ্জেও কিছু হোটেল-রিসোর্ট আছে।
সরকারি কর্মকর্তারা মৌলভীবাজার সার্কিট হাউস, জেলা পরিষদ ডাকবাংলো, উপজেলা ডাকবাংলোসহ সরকারি ডাকবাংলোগুলোতে নামমাত্র ভাড়ায় অতিথি হতে পারেন।
ভ্রমণ বিষয়ক আরো ফিচার পড়ুন : শীতকালে সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ
মৌলভীবাজারে কোথায় খাবেন
মৌলভীবাজার ও শ্রীমঙ্গল শহরে রয়েছে ছোটোবড় অসংখ্য খাবার হোটেল। এরমধ্যে পানসি, মামা বাড়ি উল্লেখযোগ্য। খাবার হিসেবে মৌলভীবাজারের হাওরের বোয়াল, আইড়, টেংরা-গুলশা, পাবদা, পুঁটি, কই, মাগুর ইত্যাদি আপনাকে দারুণ স্বাদ দেবে। এছাড়া সিলেট অঞ্চলের সাতকড়া দিয়ে গরুর মাংস এবং শুটকি ভর্তাও টেস্ট করতে ভুলবেন না।
সুমন্ত গুপ্ত, ভ্রমণ লেখক
মৌলভীবাজারে ট্যুরিস্ট বাস চালু
যেসব দেশে যেতে বাংলাদেশিদের লাগবে না ভিসা
সাজেক: কখন-কীভাবে যাবেন, কী করবেন? জেনে নিন বিস্তারিত
নীলাদ্রি লেক আমাদের এক টুকরো কাশ্মীর
- সিলেট ট্রেনের সময়সূচি ২০২৩ দেখুন
- ঢাকা টু সিরাজগঞ্জ ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- চট্টগ্রাম টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- শীতকালে সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ
- ঢাকা টু পাবনা ট্রেনের তালিকা এবং সময়সূচী
- ‘লাসুবন’- শ্রীমঙ্গলে প্রাচীন গিরিখাতের সন্ধান!
- এবার মাল্টার ভিসা পাওয়া যাবে ঢাকা থেকেই!
- ঢাকা টু দিনাজপুর ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা ২০২৩
- টাঙ্গাইল টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়া তালিকা
- ঘুরে আসুন ঝর্ণার স্বর্গ মিরসরাই সীতাকুণ্ডে