হেলাল আহমেদ
মৃৎশিল্পের খোঁজে একদিন... (ভ্রমণ গল্প)
মৃৎশিল্পের খোঁজে একদিন
মৃৎশিল্প এদেশের ঐতিহ্যের একটি বড় অংশ৷ গ্রামের মানুষের কাছে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও ছিলো ব্যাপক। একটা সময় অনেক মানুষ জীবনধারণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই শিল্পটিকে। কিন্তু শিল্পায়নের এই যুগে বাজারে এসেছে এল্যুমিনিয়াম, প্লাস্টিক, মেলামাইনের তৈরি নতুন নতুন তৈজসপত্র। ফলে ক্রমশই চাহিদা কমেছে মাটির তৈরি জিনিসের। হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় সংস্কৃতির অন্যতম একটি অংশ মৃৎশিল্প। শুধু যে শিল্পই হারিয়ে যাচ্ছে তানয়। বরং শিল্পের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছেন এই শিল্পের সাথে জড়িত গ্রাম গঞ্জের মৃৎশিল্পীরাও। তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও এ নিয়ে জানার তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা। যা আমাদের জন্য খুবই হতাশার।
তিন-চার দশক আগেও বাংলার গ্রামে গঞ্জের প্রতিটা ঘরেই মাটির তৈজসপত্র খুঁজে পাওয়া যেতো। মাটির থালা, বাটি, পানি খাওয়ার ঘটি-এসব জিনিসই ছিলো গ্রামের মানুষের নিত্য ব্যবহৃত মাটির জিনিস। কিন্তু আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে, এগিয়েছে বাংলার গ্রামগুলোও। যেকারণে এখন আর গ্রামে ঘুরলে তিন দশক আগের ব্যবহৃত নিত্য প্রয়োজনীয় মাটির তৈজসপত্রগুলোর দেখা পাওয়া যায় না। মৃৎশিল্প এখন শুধুমাত্র স্কুল-কলেজে বইয়ের পাঠ্য বিষয়। শহরের আধুনিক জীবনে মৃৎশিল্পীদের তৈরি এসব তৈজসপত্র আজ ইট পাথরের বনসাই।
তবে এখনো ভাটি বাংলর কিছু কিছু গ্রামের মানুষ নিজেদের আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রেখেছেন ঐতিহ্যবাহী এই মৃৎশিল্পকে। প্রধান পেশা হিশেবে এখনো তারা পছন্দের তালিকায় রেখেছেন মৃৎশিল্পকে। তেমনি একটা পাড়া আজমিরিগঞ্জ উপজেলার নগর গ্রামের কুমার আটি(কুমার পাড়া)। তিন যুগেরও বেশি সময় ধরে যারা বাঁচিয়ে রেখেছেন মৃতপ্রায় এই মৃৎশিল্পকে। শুধুমাত্র কাজের প্রতি ভালো লাগা আর ঐতিহ্যকে বাঁচিয়ে রাখার তাগিদেই এখনো কাঠের চাকা ঘুরিয়ে মাটির বিভিন্ন জিনিস তৈরি করছেন এই আটির মানুষজন।
কুমার আটিতে ঢুকলেই প্রথমে চোখে পড়ে প্রতিটা ঘরের উঠোনে শুকাতে দেওয়া মাটির বিভিন্ন তৈজসপত্র। এক পাশে একজন ব্যস্ত কাঠের চাকা ঘুরাতে। সেখান থেকে ভেসে আসছে কাঠের খচখচ শব্দ। অন্যদিকে রোদের আলোয় কাঁচা মাটির জিনিসগুলোকে আরো মজবুত করার জন্য রোদের আলোয় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিচ্ছেন কেউ কেউ। উঠোন জুড়ে কাঁচা এঁটেল মাটির গন্ধ। সবকিছুই যেন পাঠ্য বইয়ে পড়া কোনো কুমার পল্লীর গল্পের মতো।
কালের পরিক্রমায় হারাতে বসেছে দেশের মৃৎশিল্প ও এ শিল্পের শিল্পীরা
হাওর থেকে নৌকা বুঝাই করে প্রথমে কাঁচা এঁটেল মাটি এনে ভালো করে পানি মিশিয়ে মাটিকে তৈরি করে নেন তারা। অবশ্য এই মাটিকে তারা এঁটেল মাটি না বলে আনকোলা মাটি বলেন। তাদের ভাষায় আনকোলা মানে হচ্ছে আঠালো। এই আঠালো মাটির সাথে পরে পাঠ মিশিয়ে মাটি যাতে না ফেটে যায় সেইরকম করেই প্রস্তুত করা হয়। পাঠ মিশানো এই আঠালো মাটির উপরে মৃৎশিল্পীরা এঁকে দেন তাদের কারুকার্য। হাতের ছোঁয়ায় নান্দনিক করে গড়ে তোলেন একেকটি তৈজসপত্র।
পরে এগুলোকে আবার রোদে শুকাতে দেওয়া হয়। রোদে শুকানো শেষ হলে তৈরি মাটির জিনিসগুলোর উপর বিভিন্ন রঙ মাখিয়ে আরো আকর্ষনীয় করে তোলেন এই মৃৎশিল্পীরা। পরে এগুলো স্থানীয় আজমিরিগঞ্জ বাজারে নিয়ে বিক্রি করেন তারা। আর এভাবেই দিনের পর দিন দেশের মৃৎশিল্পকে বাঁচিয়ে রাখছেন কুমার আটির শিল্পীরা।
এ পর্যন্ত এদের গল্পটা খুব সহজ-সুন্দর হলেও এই শিল্পীদের জীবনের গল্প একদমই ভিন্ন। কেননা এতো কষ্ট করে যেই মৃৎশিল্পকে তারা টিকিয়ে রাখছেন সেখানে তারা দেখছেন না লাভের মুখ। একটি মাটির জিনিস তৈরি করতে যে পরিমাণ টাকা খরচ হয় অনেকসময় এই মাটির জিনিস বিক্রি করে তা তোলতে পারেন না তারা লাভ তো দূরের কথা মূল টাকাও তোলতে পারেন না।
একসময় দেশে মাটির তৈজসপত্রের ব্যাপক চাহিদা থাকলেও বর্তমানে প্লাস্টিক পণ্যের কারণে বিলুপ্তির পথে মাটির তৈরি তৈজসপত্র
এর কারণ হিশেবে তারা জানান, মাটি দিয়ে এসব জিনিস তৈরি করতে যেই উপাদানের দরকার হয় চলমান বাজারে তার দাম বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ। অন্যদিকে সেই অনুপাতে তৃণমূল পর্যায়ে দাম বাড়েনি মাটির তৈরি জিনিসপত্রের। ফলে লাভ নয় লোকসানের মুখ দেখতে হয়। অবশ্য তাদের মতে সরকার যদি এই ক্ষেত্রে মৃৎশিল্পকে টিকিয়ে রাখতে কোনো উদ্যোগ নিতেন তাহলে হয়তো খেয়েপড়ে বাঁচতে
পারতেন তারা।
তবে এতোকিছুর পরেও দেশের এই ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটিকে ছেড়ে দেন নি তারা। মৃতপ্রায় এই শিল্পটিকে বাঁচিয়ে রাখতে কুমার আটির শিল্পীরা নিজেরাই গড়ে তোলেছেন 'নগর মৃৎশিল্প সমিতি।' নিজেদের পরিশ্রমের টাকা দিয়েই এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন সমিতিকে। অনেকসময় সুদের উপর টাকা এনেও কাজ করতে হয় তাদেরকে। বিষন্ন মুখে এসব বলছিলেন সমিতির সদস্যগণ।
সমিতির সভাপতি শচীন্দ্র পাল জানান, আজ থেকে দশ বছর আগে সরকার থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা অনুদান আসে তাদের জন্য। কিন্তু সেই টাকার এক কড়িও তারা পান নি! কোথায় গেল এই টাকা? শচীন্দ্র পাল বলেন, 'কই গেলো জানিনা। তয় আমরারে কইছিলো এই টেকা পাইতে কিছু টেকা খরচ করতে হইবো। আমরা সবাই মিল্যা প্রায় দশ হাজার টেকা খরচও করছিলাম। কিন্তু তারপরও টেকা পাই নাই।'
মৃৎশিল্প এদেশের ঐতিহ্যের একটি বড় অংশ৷ গ্রামের মানুষের কাছে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের চাহিদাও ছিলো ব্যাপক। একটা সময় অনেক মানুষ জীবনধারণের জন্য বেছে নিয়েছিলেন এই শিল্পটিকে। কিন্তু শিল্পায়নের এই যুগে বাজারে এসেছে এল্যুমিনিয়াম, প্লাস্টিক, মেলামাইনের তৈরি নতুন নতুন তৈজসপত্র। ফলে ক্রমশই চাহিদা কমেছে মাটির তৈরি জিনিসের। হারিয়ে যাচ্ছে দেশীয় সংস্কৃতির অন্যতম একটি অংশ মৃৎশিল্প। শুধু যে শিল্পই হারিয়ে যাচ্ছে তানয়। বরং শিল্পের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছেন এই শিল্পের সাথে জড়িত গ্রাম গঞ্জের মৃৎশিল্পীরাও। তরুণ প্রজন্মের মধ্যেও এ নিয়ে জানার তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছেনা। যা আমাদের জন্য খুবই হতাশার।
সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মৃৎশিল্পীরাও
এক সময়ের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পটি হারিয়ে যাচ্ছে সময়ের সাথে। সরকারের তেমন কোনো উদ্যোগ না থাকায় এ শিল্প থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন মৃৎশিল্পীরাও। আজমিরিগঞ্জের কুমার আটিতে কথা বলার এক পর্যায়ে তারা বলেন, এই কাজ করে যদি শেষমেশ খাইতে নাও পারি তাও এই কাজটারে ধইরা রাখবো। কারণ এই কাজের সাথে মিশ্যা আছে আমরার বাপ-দাদা।'
কুমার আটির এই মৃৎশিল্পীরা পূর্ব পুরুষের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কাজ করে গেলেও আমাদের উচিত দেশের ঐতিহ্যকে টিকিয়ে রাখতে মৃতপ্রায় মৃৎশিল্পের দিকে নজর দেওয়া। কারণ শুধু আজমিরিগঞ্জের কুমার আটিই নয় সমগ্র বাংলাদেশের মৃৎশিল্পীদেরই এক অবস্থা। তাই আমাদের ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখতে আমাদেরকেই এগিয়ে আসতে হবে।
লেখক- হেলাল আহমেদ, কবি ও সাংবাদিক
লেখকের আরও লেখা:
- বঙ্গদেশীয় নারীবাদ: কিংবা কিছু কথা
- ভাটির কবি আব্দুল করিম এবং কিছু কথা
- দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: ইতিহাসে ভিন্নরকম এক সঙ্গীতায়োজন
- এ পি জে আব্দুল কালাম: ‘দ্য মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- সিলেট ট্রেনের সময়সূচি ২০২৩ দেখুন
- ঢাকা টু সিরাজগঞ্জ ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- চট্টগ্রাম টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- শীতকালে সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ
- ঢাকা টু পাবনা ট্রেনের তালিকা এবং সময়সূচী
- ‘লাসুবন’- শ্রীমঙ্গলে প্রাচীন গিরিখাতের সন্ধান!
- এবার মাল্টার ভিসা পাওয়া যাবে ঢাকা থেকেই!
- ঢাকা টু দিনাজপুর ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা ২০২৩
- টাঙ্গাইল টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়া তালিকা
- ঘুরে আসুন ঝর্ণার স্বর্গ মিরসরাই সীতাকুণ্ডে