শ্যামলাল গোসাঁই
লক্ষীপাশা বাঘের মোকামে একদিন | ভ্রমণ গল্প
বাঘের মোকামের (মুকিম শাহর মাজার) দিকে তাকিয়ে লেখক। ছবি- আই নিউজ
গোলাপগঞ্জের লক্ষীপাশা গ্রামের বাঘের মোকামে এখন আর বাঘ নেই। শোনা যায়, এই মোকামের যিনি পীর (মুকিম শাহ) তিনি এসেছিলেন চট্টগ্রামের মীরসরাই থেকে। সুদূর মীরসরাই থেকে বজরায় চড়ে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে তিনি লক্ষীপাশার খালপাড়ে ওঠেছিলেন সঙ্গী সাথীদের নিয়ে।
সেই খালটি এখন আর দেখা না গেলেও সেসময় এই খালেই নাকি এসে ভিড়ত বিশাল বিশাল সব বজরা, বাণিজ্যিক নৌ যান, স্টিমার। তেমনি এক বিশাল বজরা এসে একদিন এই খালে নোঙর করে। কে জানতো সেদিন এই বজরায় করে আসছেন একজন আধ্যাত্মিক জগতের ভাবুক মানুষ, ফয়েজী ধারার একজন কামেল পীর? ঈদের ছুটিতে বন্ধুবর চ্যাটার্জিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিলাম সেই কামেল পীরের মাজার দর্শনে।
আমরা যখন লক্ষীপাশা গ্রামে এসে পৌঁছেছি রাত্র তখন নয়টার কাটা ছুঁইছুঁই করছে। সিলেটের সামান্য বাইরের একটি উপজেলার ছোট্ট একটি ইতিহাস সমৃদ্ধ গ্রাম লক্ষীপাশা। এ গ্রামের সওদাগর বাড়ি, মিনিষ্টার বাড়ি কিংবা সারেং বাড়ি এখনো যেন গ্রামের আদি ইতিহাসের ছাপ-ছোপ বয়ে বেড়াচ্ছে। কিন্তু রাতের আঁধারে ঐতিহ্যবাহী এসব বাড়ির কোনো বাড়িই আমাদের চোখে পড়ছিলো না। আমাদেরও পেটে ক্ষিদের চামচিকা উড়াউড়ি শুরু করেছে। তাই গাড়িগুড়া না পেয়ে সোজা হাঁটা ধরলাম আমার নিমন্ত্রণকারীর বাড়িতে। সেখান থেকেই আমরা পরদিন সকালে মুকিম শাহর মাজার বা বাঘের মোকাম দর্শনে যাওয়ার কথা।
ভরপেটে নিশ্চিন্ত ঘুম দিয়ে সকালে উঠেই দেখি আকাশে বৃষ্টির ঘনঘটা। মুহুর্ত না কাটতেই গমগম করে তা ঝরতে শুরু করলো। মনটা খারাপ হয়ে গেলো আমার আর চ্যাটার্জির। ভাবলাম বাঘের মোকাম দর্শন বোধয় আর হলো না। কিন্তু ক্ষাণিক পরেই রোদের উপস্থিতি আমাদের সে খারাপি দূর করলো। তড়িঘড়ি করে আমরা হাঁটা ধরলাম মোকামের দিকে। পায়ে হাঁটা পথ। কাঁদায় গেড়ে গিয়ে আমাদের অবস্থাও একেবারে কর্দমাক্ত। যে পাঞ্জাবি পড়ে গিয়েছিলাম তার তলায় কাঁদার দলা ঝুলে আছে বাচ্চাদের হলুদ পায়খানার মতো। যদিও এসবের দিকে আমাদের নজর তখন নেই। কারণ সহযাত্রী নিমাই ভাই তখন আমাদেরকে মোকামে প্রবেশের আদব কায়দা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন। তাই আমাদের ভাবনায় তখন মুকিম শাহ।
আমরা চার মূর্তি বাঘের মোকামে যখন পৌঁছালাম বৃষ্টি তখন অনেকটাই কেটে গেছে। তবে আকাশের অন্ধকার, গুমোট ভাব কাটে নি। আশেপাশে নানা ধরনের লতা, গুল্মের জঙ্গল। আর কিছু দূরে দূরে নতুন, পুরাতন সারিসারি কবর। গা ছমছমে পরিবেশ। যদিও নিয়ত ভ্রমণের কারণে আমার এসব পরিবেশে মানিয়ে নিতে সমস্যা হয় না। আমরা ঘুরে ঘুরে কবর আর প্রাঙ্গণ দেখছি। হাফিজ ভাই যিনি আমাদেরকে এখানে নিয়ে এসেছেন তিনি দক্ষ পর্যটক গাইডের মতো গড়গড় করে মুকিম শাহ সমাচার শোনাচ্ছেন : যখন লক্ষীপাশার খালপাড়ে এসে বসতি গাড়েন তখন এ পুরো এলাকা ছিল জঙ্গলে ঘেরা; বন্যপশুর অভয়াশ্রম। হিংস্র প্রাণীর মধ্যে বাঘ, ভাল্লুকসহ নানা ধরনের সরীসৃপে ভরা ছিল এই অঞ্চল। মুকিম শাহ ধীরে ধীরে অত্র এলাকাকে বসবাদযোগ্য করে তোলেন। সেসময় একটি বাঘকে প্রায়শই তাঁর সাথে ঘুরতে ফিরতে দেখা যেতো। আবার কেউ কেউ বলেন মুকিম শাহ মারা যাওয়ার পর তাঁর কবরকে ঘিরে একটি বাঘকে প্রায়শই প্রদক্ষিণ করতে দেখা যেতো। যেকারণে এই মোকামটির নাম অত্র এলাকায় বাঘের মোকাম হিসেবে পরিচিতি পায়। এখনো মোকামের গেটে নামফলকে বাঘের মোকাম লিখা আছে।
যাহোক, কালের যাত্রায় অনেকখানি বদলে গেছে লক্ষীপাশা। এখন আর নেই আগের জঙ্গল, বন্য পশু। বাঘের দেখা এখন আর বাঘের মোকামে পাওয়া যায় না। তবে সর্বক্ষণ একটি বিড়ালকে দেখতে পাওয়া যায় মোকামে। চব্বিশ ঘণ্টাই বিড়ালটি বাঘের মোকামকে ঘিরে থাকা প্রকাণ্ড বটগাছে কিংবা ছোট্ট ছাউনির নিচে ঘুরাফেরা করে। যেকেউ দেখতে গেলে বিড়ালটিকে সেখানেই পাবেন।
আমরা সেদিন যখন বাঘের মোকামে এসেছি মুকিম শাহ'র সাথেই কোনো না কোনোভাবে সম্পৃক্ত একজনের সাথে। তিনি হাফিজ ভাই। হাফিজ ভাই যখন আমাদেরকে মুকিম শাহর নানা ইতিহাস, আখ্যান শোনাচ্ছিলেন তখন আবার বৃষ্টি নামলো। আমরা মোকামের ভেতরের ছোট্ট একটি জায়গায় আশ্রয় নিয়েছিলাম। বৃষ্টি সময়ের সাথে বেড়ে চলেছে। ভিজে গিয়ে আমাদেরও ততোক্ষণে একেবারে বলিহারি অবস্থা। এর মাঝে দেখলাম বিড়ালটি ওই ছাউনির ওখানেই বসে আছে। ওখানে বসে থাকলে পানি গায়ে লাগে না এমন নয়। বিড়ালটা ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো। কিন্তু ওই আসন ছেড়ে ওঠার নাম নেই। পুরো বৃষ্টির সময় বিড়ালটা ওখানেই বসে বসে ভিজছিলো। সঙ্গে থাকা নিমাই বললো- এ বিড়াল হারাদিন ইকানেই তাকে। ইকানেই তাঁর সবতা। মাইরা দিলেও যাইতো নায়।
এর ফাঁকে হাফিজ ভাই জানালেন- এই এলাকায় যখন জঙ্গল ছিলো তখন অনেক পশুপাখি ছিলো। আবার সেসময় শিকারের একটা প্রচলনও ছিল। মুকিত শাহ অত্র অঞ্চলে পাখি শিকার সহ যেকোনো ধরনের বন্যপ্রাণী হ-ত্যার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। একারণেই হয়তো প্রাণীকুলের সাথে তাঁর একটি ভিন্নতর সপর্ক গড়ে উঠতে পেরেছিলো। এই বাঘের মোকামে এখন বিড়াল ছাড়াও এক জোড়া ঘুঘু (ডুফি) পাখিও থাকে। বটগাছের একটি শাখায় সারাদিন বসে বসে ডাকাডাকি করে এই দুটো। এই পাখি দুইটিও মোকাম প্রাঙ্গণ ছেড়ে যায় না!
মুকিম শাহকে নিয়ে সবথেকে লোমহর্ষক পুরাণটি বেশ চমকপ্রদ খানিকটাও অবিশ্বাস্যও! একদিন মুকিম শাহ তাঁর আস্থানার পাশ দিয়ে বয়ে চলা খালপাড়ে বসে ছিনা চাক করছিলেন (ছিনা চাল= ধর্মীয় বিশ্বাসমতে উচ্চ পর্যায়ের ওলী, আউলিয়ারা নিজেদের হৃদপিণ্ডকে নিজেরাই বাইরে এনে ধৌত বা পরিষ্কার করতে পারতেন। নবী মুহাম্মদ (স) এর জীবনেও একাধিকবার ছিনা চাক এর ঘটনা ঘটে।) মুকিম শাহ যখন খালপাড়ে নিজের হৃদপিণ্ডকে বাইরে এনে নিজের হাত দিয়েই পানিতে ধুচ্ছিলেন তখন কিছু স্থানীয় জেলে ঘটনাটি দেখে ফেলে। এটি দেখার পর তারা হতভম্ব হয়ে যায়। মুকিম শাহও দেখে ফেলেছিলেন তাঁদেরকে। পরে তিনি তাঁদেরকে ডেকে এনে এ ঘটনা বাইরে কাউকে না বলার জন্য বলেন।
বৃষ্টি থামলে ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি কখন যে ১২টা বেজে গেছে আমরা কেউই খেয়াল করিনি। বারে শুক্রবার ছিলো। ইমু ভাই বললেন বাড়ির দিকে ফেরা যাক। আমাকে আবার নামাজে যেতে হবে। বুঝলাম যাওয়ার সময় চলে এসেছে। আরেকবার সবাই সালাম করলাম। কাকে সালাম করলাম জানি না। কিন্তু প্রথমবারের সালামের মতো রইলো না। এবারে সালামের পর এক ধরনের প্রশান্তি বোধ করলাম। মুকিম শাহ সম্পর্কে অনেক কিছু জানার পর যেন এই প্রশান্তি বোধ উপহারস্বরূপ আমারই ভেতর থেকে উত্তোলিত হয়েছে। এই প্রশান্তির পেছনে বৈজ্ঞানিক কোনো যুক্তি হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিন্তু অনুভূতিকে যে অনুভব করেই প্রমাণ করতে হয় তা কিছু লোককে বুঝাবে কে?
আমরা লক্ষীপাশা গিয়েছিলাম হাফিজ ভাইয়ের নিমন্ত্রণে। যাদের পরিবার বাঘের মোকামের সাথে জড়িয়ে আছেন নানাভাবে অনেকগুলো বছর ধরে। তাঁদের কাছে মুকিম শাহর মোকাম বা মুকিম শাহ অন্যরকম এক আবেগ আর অভিজ্ঞতার নাম। মুকিম শাহর পাশেই দাফন করা হয়েছে তাঁদের পরিবারের আরও অনেককে। তাই তারা এখানে প্রায়ই আসেন। নিরব, নিস্তব্ধ পরিবেশে আরও নিরব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা মাটিতে কিছুটা দেবে যাওয়া তাঁদের স্বজনদের কবরের দিকে তাকিয়ে।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- সিলেট ট্রেনের সময়সূচি ২০২৩ দেখুন
- ঢাকা টু সিরাজগঞ্জ ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- চট্টগ্রাম টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- শীতকালে সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ
- ঢাকা টু পাবনা ট্রেনের তালিকা এবং সময়সূচী
- ‘লাসুবন’- শ্রীমঙ্গলে প্রাচীন গিরিখাতের সন্ধান!
- এবার মাল্টার ভিসা পাওয়া যাবে ঢাকা থেকেই!
- ঢাকা টু দিনাজপুর ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা ২০২৩
- টাঙ্গাইল টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়া তালিকা
- ঘুরে আসুন ঝর্ণার স্বর্গ মিরসরাই সীতাকুণ্ডে