মো. রওশান উজ্জামান রনি
আপডেট: ২১:১২, ১১ আগস্ট ২০২৩
মৃত সাগর বা ডেড-সি সম্পর্কে অজানা তথ্য
ডেড-সি বা মৃত সাগর। ছবি অনলাইন
ভূপৃষ্ঠের সর্বনিম্ন বিন্দুটির অবস্থান কোথায় জানেন কি? অনন্য এই খেতাবধারী ডেড-সি বা মৃত সাগর নামক এই জলাশয়টির উপকূল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে চারশো তিরিশ মিটারের বেশি বা প্রায় আধা কিলোমিটার গভীরে অবস্থিত। নামের সাথে সাগর থাকলেও ডেড-সি মূলত একটি হ্রদ। এই হ্রদটির কথা ইতিহাসে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধর্মগ্রন্থেও উল্লেখিত হয়েছে। প্রাচীরকা থেকে এই জলাশয়টির নাম রিত হওয়ার কারণ এখানে দৃশ্যমান কোন উদ্ভিদ বা প্রাণী জীবন ধারণ করতে পারে না। কারণ এর পানি অতিরিক্ত মাত্রায় লবনাক্ত।
অবশ্য জলজ প্রাণী এবং উদ্ভিদের জন্য প্রাণঘাতী লবনাক্ত প্রাণী মানুষের ত্বকের বিভিন্ন রোগের ভালো ওষুধ হিসেবে কাজ করে। তাই হাজার হাজার বছর ধরেই মানুষ এই রথকে বিভিন্ন চর্মরোগ নিরাময় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করে এসেছে। জর্ডান, ইজরাইল এবং প্যালেস্টাইনের মধ্যে অবস্থিত বিখ্যাত জলাশয়টির সম্পর্কে আপনাদের দশটি চমকপ্রদ তথ্য জানাতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে। চলুন তবে মৃত সাগর সম্পর্কে সেই তথ্য গুলো জেনে আসি।
ধর্মীয় এবং ঐতিহাসিক নানা কারণে বিখ্যাত এই জলাশয়টির উৎপত্তির কারণ নিয়ে বিস্তর গবেষণা হয়েছে। সেই সব গবেষণা অনুযায়ী এই জলাশয়টির সৃষ্টি হয়েছিল প্রায় পঁচিশ থেকে তিরিশ লাখ বছর আগে। ওই সময় ভূপৃষ্ঠের অ্যারাবিয়ান এবং আফ্রিকান এই দুটি টেকসনিক প্লেট পরস্পর থেকে দূরে সরে যাওয়া শুরু করে। এতে প্লেট দুটোর মধ্যে বিশাল একটি গর্তের সৃষ্টি হয়। পশ্চিম দিকে ভুমধ্যসাগর পর্যন্ত বিস্তৃত সেই গর্তে ভূমধ্যসাগর থেকে পানি এসে ভরে যায়। অর্থাৎ ওই সময় বর্তমান সিরিয়া, জর্ডান, ইজরায়েল এবং প্যালেস্টাইনের পুরোটা কার্যত ভূমধ্য সাগরের নিচে তলিয়ে ছিল। এর কয়েক লাখ বছর পর এক ভূমিকম্পে ভূমধ্যসাগরের ডেড-সি সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তারপর সূর্যের তাপে সে জলাশয় শুকিয়ে বর্তমান আকারে এসে পৌঁছেছে। অতীতে সে মৃত সাগরের একটি অংশ বর্তমানে C of gallisy নামে পরিচিত। এর অবস্থান বর্তমান মৃত সাগর এর উত্তর দিকে। মৃত সাগর নামক জলাশয়টির চলমান এই শুকিয়ে যাওনে উদ্বেগ তা মোকাবিলায় নিয়ে উদযোগ এবং সম্ভাব্য পরিনাম সম্পর্কে একটু পরেই বিস্তারিত জানতে পারবেন।
যেমনটা জানিয়েছে মৃত সাগর বা ডেড-সির নাম ইতিহাসের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন গ্রন্থে উল্লেখিত হয়েছে। ইতিহাসবিদদের মতে টিকে থাকা নথিপত্র অনুযায়ী ডেড-সির প্রথম উল্লেখ পাওয়া যায় খৃস্টপূর্ব ২৫৮ সালে। ওই সময় ইজরাইলের রাজা উপকূলে অবকাশ যাপনে উপস্থিত ছিলেন। অবশ্য বিখ্যাত গ্রিস দার্শনিক অ্যারিস্টোটালও ভূমধ্যসাগরের অদূরে একটি স্বাস্থ্যকর জলাশয়ের কথা উল্লেখ করেন। তার বর্ণনা অনুযায়ী এ জলাশয়ের পানিতে কোনো উদ্ভিদ বা প্রাণীর জীবন ধারণ করতে পারে না। তবে এর পানি মানুষের ত্বকের জন্য উপকারী হিসেবে উল্লেখ করেন। অ্যারিস্টেটাল পরবর্তী রোমান আমলে এই জলাশয়টি গুরুত্বপূর্ণ নৌপথ হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই পথে যাতায়াতকারী জাহাজে মূলত কৃষি পণ্যের পাশাপাশি এই জলাশয়ের তলদেশ থেকে নির্গত এসপুল বা আলকাতরা এবং লবন পরিবহন করা হতো। বিশেষ করে আলকাতরার জন্য এই জলাশয়ে এতটাই খ্যাতি অর্জন করে যে অনেক রোমান নাগরিক এই জলাশয় টিকে আলকাতরা হ্রদ নামে চিনতেন।
ভূতাত্ত্বিকদের সর্বশেষ পরিমাপ অনুযায়ী মৃত সাগরের উপকূল এবং জলপৃষ্ঠ নিকটবর্তী সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪৩০.৫ মিটার গভীরে অবস্থিত। আর জলাশয়টির তলদেশ উপকূল থেকে গড়ে ১৯৯ মিটার গভীরে অবস্থিত। যদিও ডেড-সি এর সর্বোচ্চ গভীরতা ২৯৮ মিটার। অর্থাৎ তলদেশের বিন্দুটি নিকটবর্তী সমুদ্র পৃষ্ঠের ৭২৮ মিটার বা প্রায় পৌনে এক কিলোমিটার গভীরে অবস্থিত। এর সৃষ্টি এবং পরবর্তী বিবর্তনের কারণেই এমনটা হয়েছে। বর্তমানে বিদ্যমান জলাশয়টি মূলত প্রাচীন সেই বিশাল ভূমধ্যসাগরের ভগ্নাংশ মাত্র। অর্থাৎ প্রাচীন সেই সাগরের গভীরতম অঞ্চলেই এই রথটির অবস্থান। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এত গভীরে হওয়ায় এই হ্রদের তীরে সূর্যের ক্ষতিকর অতিবেগুনি রশ্মির শক্তি অনেকটাই দুর্বল হয়ে যায়। বাড়তি গভীরতার কারণে এখানে বায়মণ্ডলের পুরোত্ব স্বাভাবিকের তুলনায় বেশি হওয়ার ফলেই এমনটা ঘটে থাকে।
একে তো মৃত সাগর নামক জলাশয় থেকে পানি বের হবার কোনো পথ নেই। তার উপরে জলাশয়ে পানি প্রবেশের পথও মাত্র একটি। সর্বসাকুল্যে এই জর্ডার নদী দিয়েই মৃত সাগরে পানি প্রবেশ করতে পারে। পাশাপাশি এই অঞ্চলে বার্ষিক বৃষ্টিপাতের পরিমাণ পঞ্চাশ মিলিমিটার এরও কম। সব মিলিয়ে ডেড-সির পানি অতিরিক্ত মাত্রায় লবনাক্ত। সম্ভবত এটি পৃথিবীর সবচেয়ে লবণাক্ত প্রাকৃতিক হ্রদ। বিজ্ঞানীদের হিসেবে এর পানির সাধারণ সাগরের পানির তুলনায় নয় গুণ বেশি লবনাক্ত। বিজ্ঞানের ভাষায় জলাশয়ের প্রতি লিটার পানিতে দ্রবিভূত অবস্থায় থাকা বিভিন্ন লবণের পরিমান প্রায় শোয়া এক কেজি। শতকরার হিসেবে এই জলাশয়ের চৌত্রিশ ভাগই লবন। এরমধ্যে সব লবণ অবশ্য খাবার টেবিলে ব্যবহার যোগ্য না। সোডিয়াম ক্লোরাইডের পাশাপাশি ডেট সিট পানিতে পটাশিয়াম এবং ক্যালসিয়ামের বিভিন্ন লবণও পাওয়া যায়। উচ্চমাধ্যমিকে পড়া বিজ্ঞান বইয়ের কথা মনে আছে কি? যেখানে পড়েছিলেন লবণাক্ত হওয়ায় সমুদ্রের পানি নদীর তুলনায় বেশি ঘন। আর ঘনত্ব বেশি হওয়ায় নদী পথে চলাচলকারী যানগুলো সমুদ্রে প্রবেশ করলে খানিকটা ভেসে ওঠে। আর সমুদ্রে কোন জাহাজ নদীতে প্রবেশ করলে জাহাজটি পানিতে তলিয়ে থাকা অংশের পরিমান বেড়ে যাই। অতিরিক্ত লবণাক্ত হওয়ায় মৃত সাগরের পানিতে এই বিষয়টি আরো বেশি হয়। নৌ জাহানের বদলে বিষয়টি অবশ্য ব্যক্তি পর্যায়ে বেশি উপভোগ করা সম্ভব। কারণ মৃত সাগরের পানিতে ভেসে থাকতে আপনার কিছুই করতে হবে না। চাইলেও আপনি এর পানিতে ডুবে থাকতে পারবেন না। তবে জলাশয়ে চলাচলকারী নৌযান গুলোর জন্য বাড়তি লবণাক্ততা বরং বিপদজনকই বলতে হবে। বেশি সময় পানিতে থাকলে নৌচানির খোলে প্রচুর লবণ জমে যায়। যা সরানো না হলে নৌযানটি চলাচলে জ্বালানি খরচ বেড়ে যেতে পারে।
আগে যেমনটা জানিয়েছি এই জলাশয়ের নাম মৃত সাগর হবার অন্যতম কারণ এই পানিতে দৃশ্যমান কোনো জলজ উদ্ভিদ বা প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। এর কারণ ওই পানির বাড়তি লবনাক্তা। তবে মৃত সাগর পুরোপুরি মৃত না। অণুবীক্ষণ যন্ত্রের কল্যানে এখানে বিভিন্ন প্রজাতির ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাকের সন্ধান পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা। তাছাড়া আবহাওয়াগত কারণে পানির লবণাক্ততা কমে গেলেও এখানে প্রানের উন্মেষ ঘটে। এই অঞ্চলের আবহাওয়া ভূমধ্য সাগরীয় হওয়ায় এখানে শীতকালে বৃষ্টি হয়। কোন বৎসর অতি বৃষ্টির কারণে মৃত সাগরের পানির লবণাক্ততা কমে গেলে এখানে এক প্রজাতির শ্যাওলা জন্ম নেয়। ১৯৮০ সালে শীতকালে এমন হওয়ায় এই হ্রদের পানি গাঢ় নীল থেকে রক্ত লাল বর্ণ ধারণ করেছিল। বিজ্ঞানীরা এর কারণ অনুসন্ধান করে জানান হ্রদের পানির লবনাক্ততা শতকরা ৩৫ ভাগ থেকে কমে ৩০ ভাগে নেমে আসায় পানি জোনালিলা নামক এক প্রজাতির শ্যাওলা জন্ম নেয়। এই শ্যাবলার মধ্যে বসবাসকারী হ্যালো ব্যাকটেরিয়া রং লাল হওয়ায় পানির রক্তবর্ণ ধারণ করেছিল।
মৃত সাগর নামক হ্রদের বর্তমান আয়তন প্রায় ৬০৫ কিলোমিটার বা ২৩৪ বর্গমাইল। মাত্র একটি নদীর পানি এ জলাশয় প্রবেশ করায় সূর্যের তাপে বাষ্পীয় ভবনের কারণে এই রদের আয়তন প্রতি বছর হ্রাস পাচ্ছে। ১৯৩০ সালে এই জলাশয়ের আয়তন ছিল ১০৫০ বর্গ কিলোমিটার বা ৪১০ বর্গমাইল। এই হ্রদের উত্তর দক্ষিণে দুই উপকূলের মধ্যে সর্বোচ্চ দূরত্ব ৫০ কিলোমিটার বা ৩১ মাইল। পূর্ব-পশ্চিমে দূরত্ব মাত্র ১৫ কিলোমিটার বা ৯ মাইলের একটু বেশি। এই জলাশয় সংলগ্ন উপকূলের দৈর্ঘ্য ১৩৫ কিলোমিটার বা ৮৪ মাইল। আর সব মিলিয়ে এই হ্রদে থাকা পানির পরিমাণ ১১৪ ঘন কিলোমিটার।
মৃত সাগরের অবিরত সংকোচনীয় উদ্বেগের কারণে জর্ডান এবং ইসরাইল তাদের বৈরিতা ভুলে একাধিক বৈঠকে মিলিত হয়েছে। তাদের সেই আলোচনায় সরাসরি লোহিত সাগর থেকেই হ্রদে পানি সরবরাহের কথাও প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে দুটো সাগরের জীববৈচিত্র পুরোপুরি ভিন্ন হওয়ায় এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব পড়ার ও আশঙ্কা রয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় পরিবেশবাদী বিভিন্ন সংগঠন জর্ডান ও ইসরাইলের এই যৌথ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে একাধিক কর্মসূচির আয়োজন করে। প্রস্তাবনা অনুযায়ী এই প্রকল্পের কাজ ২০১৮ সালের শুরু হয়ে ২০২১ সালের শেষ হবার কথা ছিল। কিন্তু পরিবেশবাদীদের বিক্ষোভে তা পিছিয়ে যায়।
পরিবেশগত কারণে পাশাপাশি ধর্মীয় কারনেও এই মৃত সাগর এবং তৎসংলগ্ন এলাকা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। ছোট এবং গমুনার মতো অভিশপ্ত শহরগুলোর বিচরণ এবং অবস্থান এই জলাশয়ের উপকূলে ছিল। বাইবেল এবং কুরআনের বর্ণনা অনুযায়ী এই শহর দুটোকে অধিবাসীদের পাপাচারের কারণে সৃষ্টিকর্তা ধ্বংস করে দিয়েছিলেন। এর কয়েকশ বছর পর ইহুদীদের রাজার ডেভিডের শীতকালীন রাজধানী ও এই মৃত সাগরের তীরে অবস্থিত ছিল। কালের পরিক্রমায় এলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এর হাত ধরে এই এলাকার নিয়ন্ত্রণ ইজরায়েলি গোত্রগুলোর হাত থেকে রোমান সাম্রাজ্যের কাছে চলে আসে। এরপর খ্রিস্টাব্দ চতুর্থ শতকের প্রথম ভাগে রোমান সম্রাট কনস্ট্যান্ট খ্রিস্ট ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করেন।
এর ধারাবাহিকতায় তিনি বর্তমান তুরস্কে অবস্থিত শহর নাইসিয়ায় একটি আলোচনা সভার আয়োজন করেছিলেন। কাউন্সিল অফ নাইসিয়া নামক বিখ্যাত সেই সভায় উপস্থিত ধর্ম বিদরা হাতেগোনা কয়েকটি বইকে বাইবেলের অন্তর্ভুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেন। ওই সময় বাইবেল হিসেবে প্রচলিত বাকি বইগুলোকে ধ্বংসের আদেশ দেন কন্সটানটেন। কিন্তু এই বইগুলোকে ধর্মীয় গ্রন্থ হিসেবে বিশ্বাস করি মানুষগুলো তাদের ধর্ম বাঁচাতে মৃত সাগরের তীরবর্তী বিভিন্ন গুহায় আশ্রয় নিয়েছিল। সে সময় তাদের সংগ্রহে থাকা বইগুলো ধ্বংসের হাত থেকে বেঁচে যায়। বিংশ শতাব্দীতে এসে পুনরুদ্ধার হওয়া এই বইগুলো ডেডসি স্কলস নামে পরিচিত।
আই নিউজ/আর
- সিলেট ট্রেনের সময়সূচি ২০২৩ দেখুন
- ঢাকা টু সিরাজগঞ্জ ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- চট্টগ্রাম টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা
- শীতকালে সিলেটের দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ
- ঢাকা টু পাবনা ট্রেনের তালিকা এবং সময়সূচী
- ‘লাসুবন’- শ্রীমঙ্গলে প্রাচীন গিরিখাতের সন্ধান!
- এবার মাল্টার ভিসা পাওয়া যাবে ঢাকা থেকেই!
- ঢাকা টু দিনাজপুর ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়ার তালিকা ২০২৩
- টাঙ্গাইল টু ঢাকা ট্রেনের সময়সূচী এবং ভাড়া তালিকা
- ঘুরে আসুন ঝর্ণার স্বর্গ মিরসরাই সীতাকুণ্ডে