মাসরুর আরেফিন
আপডেট: ১৮:৩৭, ১০ জুন ২০২৪
ফ্রানৎস কাফকার মৃত্যুর ১০০ বছর : সত্য হয়ে উঠেছে কাফকার জগৎ
ফ্রানৎস কাফকার মৃত্যুর ১০০ বছর
গেল ৩ জুন, সোমবার ফ্রানৎস কাফকার মৃত্যুর এক শ বছর হলো। ১৯২৪ সালের এই দিন দুপুরে যক্ষ্মায় ভুগে কাফকা মারা যান অস্ট্রিয়ার ভিয়েনার ক্লস্টারনুবার্গের কিয়েরলিং নামে ছোট শহরটার এক ক্লিনিক বা স্যানাটোরিয়ামে।। নিঃসন্দেহে গত শতাব্দীর সবচেয়ে প্রভাবশালী লেখক তিনি।
মাত্র ৪০ বছর ১১ মাস বয়সে মারা যাওয়া এই লেখককে বলা হয় সাহিত্যে আধুনিকতাবাদের প্রবর্তক। তিন অসম্পূর্ণ উপন্যাস, কিছু ছোট গল্প, কিছু চিঠি ও দিনপঞ্জি—এত কম লিখে এবং একটা উপন্যাসও লেখা পুরো শেষ না করে কীভাবে তিনি বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম প্রধান চিরায়ত লেখকের স্থান পেয়ে গেলেন সেটা এক বড় প্রশ্ন। আধুনিক সাহিত্যের মানদণ্ড নির্ধারণ করে দেবার কাজে এবং সারা পৃথিবী জুড়ে অসংখ্য খ্যাতনামা লেখক সৃষ্টিতে তাঁর সমান আর কেউই নেই। ১৯২০ সাল থেকে আজ অবধি সাহিত্যে নোবেল পাওয়া ১২৫ জনের মতো লেখক-কবির এক তৃতীয়াংশই তাদের লেখায় কাফকার প্রভাবের কথা সরাসরি স্বীকার করেছেন। শেকসপিয়রের পরে আর কোনো লেখককে নিয়ে এতটা লেখালেখি হয়নি, যতটা হয়েছে তাকে নিয়ে। গত মধ্য নব্বই দশকের আগেই তাঁর ওপরে লেখা হয়ে গেছে ১০ হাজার গবেষণা গ্রন্থ। ডব্লু এইচ অডেন বলেছিলেন, ‘যদি কোনো একজন লেখকের নাম করতে হয় যিনি আমাদের কালের সঙ্গে সেই সম্পর্ক বহন করেন যেটা দান্তে, শেকসপিয়র ও গ্যেয়টে করতেন তাদের কালগুলোর সঙ্গে, তাহলে সবার প্রথমে মাথায় আসবে ফ্রানৎস কাফকার নাম।’
১৯৫৬ সালে, যখন সোভিয়েত ট্যাংক গুঁড়িয়ে দিয়েছে হাঙ্গেরির প্রতিরোধ আন্দোলন, বুদাপেস্টে গ্রেপ্তার করা হলো বিখ্যাত মার্ক্সবাদী দার্শনিক গেয়র্গ লুকাচকে। বন্দী করে তাঁকে রাখা হলো এক রোমানিয়ান দুর্গে, জানানো হলো না তাঁর অপরাধ কী, কিন্তু বলা হলো, ‘আপনার আইনি অধিকারের সবটাই আছে।’ লুকাচ লিখলেন, ‘তার মানে কাফকা তো আসলে বাস্তববাদী ছিলেন।’ ফ্রানৎস কাফকার কিছুই তাঁর মৃত্যুর এক শ বছরে এসে আর মনে হয় না যে পরাবাস্তব। উল্টো প্রতিমুহূর্তে এ বোধ জাগে, কাফকা অতিবাস্তব।
তাঁর মৃত্যুর প্রথম শতবর্ষ ঘিরে কয়েকদিন ধরে রীতিমতো উন্মাদনা দেখছি পৃথিবীর প্রধান সব সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে। সবটাতে মোটা দাগে একটাই কথা—মৃত্যুর এক শ বছর পরে কাফকা আমাদের জন্য এখন আরও প্রাসঙ্গিক। অর্থাৎ বর্তমান সময়-সমাজ, রাষ্ট্র-রাজনীতি ও মানুষের জীবনধারা যে পথে চলেছে, তাতে প্রতি মুহূর্তে এই বোধ জাগছে যে আধুনিক পৃথিবীর তাবৎ লেখকের মধ্যে একমাত্র কাফকাই বুঝি পেরেছেন আমাদের জীবনসত্যের সবচেয়ে ‘সত্য’ বয়ানটা লেখায় রেখে যেতে। কী সেই বয়ান?
দিনপঞ্জিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘ভয়ংকর এক পৃথিবী আমি বয়ে চলেছি আমার মাথার মধ্যে। আমার নিজের ভেতর ওগুলো ধরে রাখার চাইতে হাজার গুণ ভালো হয় মাথা ছিঁড়ে-কেটে টুকরো করে ফেলা। আসলে এজন্যই আমার এই পৃথিবীতে আসা।’ কোন পৃথিবী?
তিনি নিজেই বলেছেন, ‘ভয়ংকর’ এক পৃথিবী, এমন এক দুনিয়া যেখানে ‘একটা খাঁচা আছে একটা পাখির সন্ধানে।’ আমাদের মুক্তি ও বন্দীত্ব নিয়ে লেখা তাঁর এই ছোট প্রবচনটার মধ্যেই ইংগীত আছে এ জগৎ কোন অর্থে ভয়ংকর। এই পৃথিবীর সামাজিক-রাজনৈতিক কাঠামো বা ‘সিস্টেম’গুলোকে বানানোই হয়েছে কীভাবে আমাদের নিয়ন্ত্রণে বা বশে রাখা যায়, সেই আয়োজনের স্বার্থে। ওই আয়োজনের ধাপে ধাপে সাজানো সব সামাজিক, রাষ্ট্রীয় ও সরকারি ব্যবস্থাপনার মধ্যে কাফকা দেখতে পেয়েছেন একটাই শব্দ—আইন। এ আইন শুধু আদালত, অফিস, মিউনিসিপ্যালিটি বা ধর্মীয় অনুশাসনের আইন নয়, তাঁর হিসেবে এটা সর্বপরিব্যাপ্ত এক আইন, ‘যেমন আমাদের গায়ের ওপরে থাকা চামড়া।’ এই ‘আইনের’ সামনে ব্যক্তিমানুষ এতটাই অসহায় যে তার সংগ্রামগুলো তার নিজের কাছেই অপার বেদনার এবং পরের কাছে তা হাস্যকররূপ নিতে বাধ্য।
কিন্তু পৃথিবীর এসব কায়দা-কানুন, ব্যপার–স্যাপার কাফকার কাছে কখনোই অস্বাভাবিক বলে মনে হয়নি। যদি হতো তাহলে আমরা তাঁর প্রায়শই অতি-নাটকীয়, প্রায়শই হেঁয়ালি ও কমিকে ভরা লেখাগুলোর মধ্যে শুধু প্যারোডিই খুঁজে পেতাম; লেখা পড়ে মনে হতো, তিনি বুঝি মানুষের জীবনসংগ্রামগুলো নিয়ে তামাশা করছেন। তা আমাদের মনে হয় না। উল্টো যেটা হয়, সেটা রীতিমতো গায়ে কাঁটা দেওয়া এক বিভীষিকাময় অনুভূতি। কারণ কমিক আসলে কাফকা করেননি। যে লেখকের ঘোষিত মিশন ছিল, দুনিয়াকে তিনি ‘পৃথিবীর শুদ্ধ, সত্য ও পরিবর্তনের অতীত’রূপে তুলে ধরবেন, তাঁর পক্ষে যেমন সম্ভব ছিল না কলমকে বিদ্রোহীর কৃপাণ বানানো, তেমন অসম্ভব ছিল পাঠকের মনজুড়ানো প্রেমকাহিনি লেখা। ‘আমি নিখুঁতভাবে সবকিছু দেখে দেখে কাগজে টুকে রাখা এক স্টেনোগ্রাফার’, তাঁর বিখ্যাত উক্তি। আরও যেমন: ‘আমাদের ইতিহাসের এই যুগ সত্যিই অনেক বেদনাদায়ক‘; আর লেখালেখি ‘ধাঁধায় ভরা এক মিশন‘।
বহু গবেষণা হয়েছে কাফকার এই পৃথিবীকে ‘শুদ্ধ, সত্য ও পরিবর্তনের-অতীত’ (‘raise the world into the pare, the true, the unchangeable’) চেহারায় লেখার মধ্যে ধরতে চাওয়ার অভিপ্রায়টা নিয়ে। গবেষকেরা বুঝতে চেয়েছেন, ধর্মীয় সন্তের মতো করে বলা, কোনো প্রফেটের মতো করে উচ্চারণ করা তাঁর এ কথাগুলোর গূঢ়ার্থ।
১৯২২ সালে, মৃত্যুর দুই বছর আগে, কাফকা লিখেছিলেন, ‘লেখালেখির সান্ত্বনা’ এটাই যে এর মাধ্যমে ‘খুনিদের লাইন’ থেকে তিনি বেরিয়ে আসতে পারেন। এই ‘খুনিদের লাইন’ই মোটা দাগে শাসক বা ক্ষমতাশালীদের লাইন। যদিও শাসক বলতে আমরা রাষ্ট্র চালানো যে লোকগুলোকে ধরি, কাফকা ঠিক তাদেরকে নির্দিষ্ট করে কিছু বলেননি, কারণ ‘রাজনৈতিক লেখক‘ বলতে আমরা প্রথাগত অর্থে যা বুঝি, তা তিনি কোনোভাবেই ছিলেন না। তাঁর ‘খুনিদের লাইন’-এর মধ্যে পড়ে আমলা-শিক্ষক-গ্রামপ্রধান-ডাক্তার-পিতা-পুলিশ-উকিল-অফিসের বস-ইহুদি প্রার্থনাগৃহের যাজক-চিৎকার করা কুকুর, এমনকী অতিরিক্ত চিঁইইই করা নেতৃস্থানীয় ধেঁড়ে ইঁদুর, এবং দেখা যায় না কিন্তু বোঝা যায় সেই এক শক্তি যা আমাদের দেশ, শাসনব্যবস্থা ও সমাজ চালায়। অর্থাৎ সবই। যা কিছু আমাদের ভয় দেখাতে পারে, বিরক্ত-বিভ্রান্ত-উৎপীড়িত করতে পারে—তার সবটা; এবং যেহেতু আমাদের বাড়িওয়ালারা থেকে শুরু করে ট্রাফিক পুলিশ পর্যন্ত সবাই সেটা আমাদের সঙ্গে করতে পারে, তাই কাফকার পুরো পৃথিবীটাই এখন ‘কাফকায়েস্ক’ এক জগৎ। পৃথিবীকে তিনি ‘শুদ্ধ, সত্য ও পরিবর্তনের অতীত’-রূপে আঁকতে গিয়ে পৃথিবীর জন্য প্রযোজ্য কোনো বিশেষণকে বদলে দিয়ে যাননি; বরং পৃথিবী তাঁর নাম দিয়েই নিজেকে সঙ্গায়িত করার সোজা পথ বেছে নিয়েছে।
যেকোনো ইংরেজি অভিধানেই ‘কাফকায়েস্ক’ শব্দটা এখন হাজির। চার বড় ইংরেজি অভিধানে এ শব্দের চার রকম সংজ্ঞা পাই—এক. অর্থহীন, বিভ্রান্তকর, প্রায়শই ভীতিকর ও বিপজ্জনক জটিলতা; উদাহরণ: ‘কাফকায়েস্ক আমলাতন্ত্র’। দুই. পরাবাস্তব বিকৃতিতে ভরা এবং প্রায়শই আগাম বিপদ ও নৈরাজ্যের বোধ-জাগানো অনুভূতি; উদাহরণ: ‘কাফকায়েস্ক বিচারব্যবস্থা’। তিন. দুঃস্বপ্নপীড়িত জটিল, উদ্ভট ও বিচিত্র অথবা অযৌক্তিক কিছু; উদাহরণ: ‘রাষ্ট্রক্ষমতার কাফকায়েস্ক অলিগলি’। চার. অত্যাচার, নিপীড়ন, বৈষম্য এবং দুঃস্বপ্নের লক্ষণাক্রান্ত কাল্পনিক জগৎ।
সন্দেহ নেই, এই চার সংজ্ঞায় যা কিছু বলা হচ্ছে তার সবটাই একক ও সম্মিলিতভাবে আমাদের গত শতাব্দি এবং এই চলমান শতকের মূল চেহারা। আমাদের আধুনিক মনের বর্তমান মানচিত্র ঠিক এমনই। পরিস্থিতিগুলো থেকে বাঁচার বা পালানোর পরিষ্কার কোনো পথ আর আপনার হাতে নেই; বরং হাতে উঠে এসেছে স্মার্টফোন, যার পর্দার বিভ্রান্তকর আলোর দিকে তাকিয়ে আপনি কোনো সামাজিক অনুষ্ঠানে গিয়ে কোনো একভাবে শুধু নিজেকে লুকাবেন।
আর একই বিষয়গুলোর রাষ্ট্রীয় বা জাতিগত পর্যায়ে এখনকার চেহারা? বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বাড়ছে। বিনা বিচারে কারাগারে মানুষের পচে মরা বাড়ছে। নিত্যদিন বড় বড় অফিস-হাসপাতাল-থানায়-বিদ্যালয়ে আমাদের হয়রানির শিকার হওয়া বাড়ছে। পৃথিবী ভরে যাচ্ছে কাফকার নায়ক জোসেফ কে.-এর মতো বা গ্রেগর সামসার মতো অস্পৃশ্য, নেড়িকুকুর সদৃশ মানুষ ও পোকায়। যে মূল বোধে আমরা ভুগছি, তা হীনম্মন্যতার বোধ। টিভির পর্দায় বা ফেসবুকে যখন আমরা নিত্যদিন দেখছি যে ক্ষমতাশীলরা কেমন দুম করে কী সূক্ষ্ম ভাষায় যুদ্ধ চাপিয়েই চলেছে সাধারণ মানুষের ওপরে, তখন স্বাভাবিক কোনো অচেনা নাম্বারের ফোন ধরতেও তো ভয় পাচ্ছি আজকাল। ফোনের ওপাশে যদি এমন কেউ থাকে যে আমাকে আমার মৃত্যু পরোয়ানা জানাবে?
আপাত চোখে খোদার দয়ালু হাতের ছোঁয়া থেকে বঞ্চিত, নিষ্ঠুর এই আধুনিক বিশ্বে কাফকার লেখা আপনি না পড়তে পারেন, কিন্তু ‘কাফকায়েস্ক’ দৃশ্যমালা এড়াবেন কী করে? সাড়ে তিন মাস আগে জেলে মারা গেলেন (আসলে খুন হলেন) রাশিয়ার বিদ্রোহী নেতা আলেক্সি নাভালনি। তাঁর অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ার দিন আমরা দেখলাম, অনেক ফুলের মাঝখানে মাটিতে রাখা আছে ফ্রানৎস কাফকার ‘দি ট্রায়াল‘ উপন্যাসের তিন প্রচ্ছদে তিন সংস্করণ। আর তিন রুশ পুলিশ ওই বইগুলো এখানে রাখা যুবকদের ঘাড়ে হাত রেখে যেন বলছে, ‘জলদি করো‘। এ দৃশ্যটুকু কাফকায়েস্ক নয়। যেটা কাফকায়েস্ক তা হলো, মাঝখানের সুদর্শন পুলিশটার চোখে আমরা দেখতে পাচ্ছি এক স্পষ্ট ধমক যে, ‘শোনো বিরোধীদলের ছেলেপেলেরা, তোমরা আমাদের সার্বক্ষণিক নজরদারির মধ্যে আছ‘।
এই এরাই কাফকার বলা ‘খুনিদের লাইন’-এর অংশ। আর ক্ষণজন্মা এ লেখক মনে করতেন, একমাত্র লেখালেখিই পারে তাঁকে ওই ‘খুনিদের লাইন’ থেকে দূরে সরাতে, যেখানে তিনি সৃষ্টি করতে পারবেন ‘আরও উচ্চতর ধরনের এক দেখার চোখ। সেই চোখ যত বেশি উঁচুতে যাবে, খুনিদের লাইন থেকে আমার অস্তিত্ব তত বেশি দূরে যেতে পারবে।’
সেই উচ্চতর দেখার চোখ দিয়েই তিনি লিখলেন অবিস্মরণীয় কিছু লেখা। সেসব লেখায় আমাদের দৈনন্দিনের এই পৃথিবীতেই বিচিত্র কিছু ঘটনা এমনভাবে ঘটে যেন ওসবের মধ্যে অস্বাভাবিকতার সামান্য কিছু নেই। কয়েকটা উদাহরণ দিই। গ্রেগর সামসা নামের এক সেলসম্যান এক সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখে, সে একটা তেলাপোকায় পরিণত হয়ে গেছে, আর তাঁর বস তাঁর বাসায় হাজির তাঁর পারফরমেন্সের রিপোর্ট কার্ড নিয়ে (গল্প ‘রূপান্তর‘)। জোসেফ কে. নামের এক নিরাপরাধ ব্যাংকারকে একদিন সকালে অজানা এক অপরাধের দায়ে দুজন সরকারি লোক আকস্মিক গ্রেফতার করে বসে, কিন্তু কেউ তাকে কোথাও ধরে নিয়ে যায় না, তাকে শুধু ‘মুক্ত’ভাবে ঘোরাফেরা করার অনুমতি আর ‘পরবর্তী নির্দেশের জন্য অপেক্ষা’ করার আদেশ দেওয়া হয় মাত্র (উপন্যাস ‘বিচার’)। কে. নামের এক ভূমিজরিপকারী বেচারা ভদ্রলোক একদিন হাজির হয় এক গ্রামে, উদ্দেশ্য গ্রামের শাসকদের দুর্গ বলে পরিচিত এক রহস্যময় দুর্গের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সে দেখা করবে এবং এই গ্রামে আইনগত ও বৈধভাবে অবস্থানের স্বীকৃতি আদায় করবে (উপন্যাস ‘দুর্গ’)। এক অদ্ভুতদর্শন কিলিং মেশিন আক্ষরিক অর্থেই দণ্ডিত আসামিদের গায়ে শত শত সুই দিয়ে নকশা বুনে লিখে দেয় তাদের যার যার অপরাধের কথা (গল্প ‘দণ্ড উপনিবেশ’)। এক লোক সারা জীবন আইনের দরজার বাইরে অপেক্ষা করে ভেতরে ঢুকবার জন্য; তারপর যখন সে মারা যাচ্ছে, তখন তাকে বলা হয়, এই দরজাটা শুধু তার জন্যই বানানো হয়েছিল (গল্প ‘আইনের দরজায়’)। এক ছেলে বিয়ে করে স্বাধীনভাবে সংসার করতে চায় আর এতে খেপে গিয়ে তার বৃদ্ধ পিতা, এক ক্ষমতা-উন্মাদ বুড়ো, ছেলেকে পানিতে ডুবে মরার মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বসেন (গল্প ‘রায়’)। এক বৃদ্ধ গ্রাম্য ডাক্তার বরফে ঢাকা রাতে নিজের বাসার মেয়েটাকে ধর্ষণোদ্যত এক লোকের হাতে ফেলে রেখে রোগি দেখতে যান দূরের এক গাঁয়ে; সেই রোগির শরীরে ফুলের মতো এক ক্ষত, যার মধ্যে কিলবিল করছে পোকা; আর গ্রামের লোকেরা ডাক্তারকে তার রোগ সারানোর ব্যর্থতার শাস্তি হিসেবে শুইয়ে দিলো রোগির বিছানায় (গল্প ‘এক গ্রাম্য ডাক্তার)। এক সম্রাটের একখানা বার্তা নিয়ে তার বাহক কোনোদিনই পৌঁছুতে পারে না গন্তব্যে; অন্যদিকে নামহীন এই সম্রাটের ক্ষমতার বিপরীতমুখী শক্তি যারা, তারা বিরামহীন চেষ্টা করে যাচ্ছে তাদের বিষমাখা তীর দিয়ে কীভাবে সম্রাটকে আসন থেকে সরানো যায়; জনগণ এবার গলিপথগুলোর শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে, আর আমরা দেখি শহরের মার্কেট স্কোয়ারে চলছে সম্রাটকে ফাঁসিতে ঝোলানোর কাজ (গল্প ‘চীনের প্রাচীর’)। এক লোকের পেশাই হচ্ছে না খেয়ে থাকা, ক্ষুধা-শিল্পী সে; দর্শকেরা তাঁর এই না-খাওয়ার আর্টে মুগ্ধ, কিন্তু দিন বদলায়; এই আধমরা অনশন-শিল্পীর কাছ থেকে মুখ ফিরিয়ে তারা এবার পাশের গর্বিত বাঘের খাঁচার সামনে ভিড় করে; একদিন না খেয়ে খেয়ে মারা মারা যায় এই শিল্পী, আর মরার আগে বলে যায়, এ পৃথিবীতে খাওয়ার মতো কোনো খাদ্য সে খুঁজে পায়নি বলেই অনশন ছিল তাঁর শিল্প (গল্প ‘এক অনশন শিল্পী’)।
এ-ই আমাদের ফ্রানৎস কাফকা—কর্তৃত্ববাদী পিতার চাহনির সামনে অসহায় এক আত্মবিশ্বাসহীন যুবক, যিনি কি না বন্ধুকে চিঠি লিখে মিনতি করে গিয়েছিলেন তাঁর সব লেখা যেন পুড়িয়ে ফেলা হয়। তিনি ছিলেন প্রাগ শহরে বাস করা এক জার্মানভাষী ইহুদি—সংখ্যালঘুদের মধ্যেও সংখ্যালঘু। এই অর্থে যে, সংখ্যাগুরু চেকভাষীদের মধ্যে তিনি ছিলেন এক জার্মানভাষী লেখক, আবার চারদিকের আগ্রাসী খ্রিস্টানদের মধ্যে এক সংখ্যালঘু ইহুদি।
কাফকার লেখা কেন প্রাসঙ্গিক, এর উত্তর তাঁর নিজের বিখ্যাত দিনপঞ্জির এক টুকরো লেখার মধ্যেই আছে। তিনি বলছেন, এই লেখা পড়তে হবে। কারণ এতে আছে তাঁর ‘কালের নেতিবাচকতা’। বলছেন, ‘আমি প্রচণ্ডভাবে আত্মস্থ করে নিয়েছি আমার কালের নেতিবাচক বিষয়গুলো। এমন এক কালে আমি বাস করছি, যার বিরুদ্ধে লড়াইয়ের আমার কোনো ‘আইনি’ অধিকার নেই। তবে এ কালটার প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার আমার আছে।’
কাফকার সেই কাল আজও চলছে, আরও সত্য হয়ে উঠেছে কাফকার জগৎ। আমরা এখন সবচেয়ে নিঃসঙ্গ এক কাল বা প্রজন্মের মানুষ—আমরা জেনারেশন কে.। এটা কলসেন্টারের কাল, ইন্টারনেটে চেহারা না দেখে ‘বন্ধুত্বের’ কাল, জাতিগত ও ধর্মউদ্ভূত ঘৃণা আর যুদ্ধের কাল।
১৯৫৬ সালে, যখন সোভিয়েত ট্যাংক গুঁড়িয়ে দিয়েছে হাঙ্গেরির প্রতিরোধ আন্দোলন, বুদাপেস্টে গ্রেপ্তার করা হলো বিখ্যাত মার্ক্সবাদী দার্শনিক গেয়র্গ লুকাচকে। বন্দী করে তাঁকে রাখা হলো এক রোমানিয়ান দুর্গে, জানানো হলো না তাঁর অপরাধ কী, কিন্তু বলা হলো, ‘আপনার আইনি অধিকারের সবটাই আছে।’ লুকাচ লিখলেন, ‘তার মানে কাফকা তো আসলে বাস্তববাদী ছিলেন।’
ফ্রানৎস কাফকার কিছুই তাঁর মৃত্যুর এক শ বছরে এসে আর মনে হয় না যে পরাবাস্তব। উল্টো প্রতিমুহূর্তে এ বোধ জাগে, কাফকা অতিবাস্তব।
লেখক: মাসরুর আরেফিন, বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা লেখক, অনুবাদক, ঔপন্যাসিক ও গবেষক
- এই লেখাটি প্রথম আলোর সাহিত্য পাতা অন্য আলো-তে ফ্রানৎস কাফকার মৃত্যু শতবার্ষিকীতে লিখেছেন সাহিত্যিক মাসরুর আরেফিন। আই নিউজের সাহিত্য ক্যাটাগরিত প্রকাশিত এই লেখাটি প্রথম আলো থেকে সংগৃহীত।
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা