দীপংকর মোহান্ত
আপডেট: ২২:০৫, ২৮ আগস্ট ২০২২
‘গাছ হেংলানেছে- পয়সা মিলেগা’ : চা শ্রমিক ও চা শিল্প
লেখক- দীপংকর মোহান্ত
১৮৬৩ সাল থেকে ১৮৬৬ সালের মে পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিক ছিল ৮৪,৯১৫ জনে তার মধ্যে চিকিৎসার অভাবে মারা যায় প্রায় ৩০, ০০০ জন শ্রমিক। বিসি এলেনের রিপোর্টে দেখানো হয় যে, ১৯০৪ সালের রোগে ৭% শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ওখানের বাস্তব চিত্র বিহার-উড়িষ্যায় পৌঁছার কোনো সুযোগ ছিল না।
ভারতে কোম্পানি শাসন প্রতিষ্ঠার পর লন্ডনের বোটানিক্যাল গার্ডেনের ডিরেক্টর স্যার জোসেফ ব্লাঙ্কাস্ ১৭৮৮ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির [ভারতীয়] ডিরেক্টরকে ভারতে চা চাষের ওপর গুরুত্ব দিয়ে চিঠি লেখেন। ঔপনিবেশিক শাসকরা নতুন ধরনের কৃষিশিল্পে অল্প-বিস্তর মূলধন বিনিয়োগ করে দীর্ঘ মেয়াদি লাভের প্রচেষ্টা চালায়।
১৮২৩ সালে রবার্ট ব্রুস উত্তরপূর্ব আসামের [লক্ষীপুর, গড়গাঁও অঞ্চল] উপজাতির [চিংফৌ নৃগোষ্ঠী] মধ্যে বন্য চা পান করার প্রবণতা লক্ষ করেন। তিনি চা গাছের নমুনা সংগ্রহের চেষ্টা করেন। অতপর ১৮৩৪ সালে উইলিয়াম বেন্টিং ‘টি কমিটি’ গঠন করে চা উৎপাদনে উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন।
এই ধারাবাহিকতায় নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর আসামে ১৯৩৮ সালে চা বাগান করার সম্ভাব্যতা দেখা দেয়। ১৮৩৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি গড়ে ওঠে বিখ্যাত ‘দ্যা আসাম কোম্পানি লি.। তার-ই বানিজ্যিক একটা অংশ হলো ‘আসাম টি কোম্পানি’ [কোম্পানির ৭৮ জন শেয়ার হোল্ডাদের ২০০০ টি শেয়ার ছিল]।
চা আবাদের প্রথম দিকে চীন থেকে দক্ষ শ্রমিক নিয়ে আসা হয়েছিল। ফলে তাদের মজুরি দিয়ে লাভ ওঠানো কোম্পানির জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। কিন্তু তারা হাল ছাড়েনি। আসামের অঢেল বনভূমি নামমাত্রে ইজারা নেওয়া শুরু হয়। ১৮৫৬ সালে সিলেটের সুরমা উপত্যকার বনাঞ্চলে চায়ের গাছ পাওয়া যায় [তৎকালীন করিমগঞ্জ মহকুমার চাপাঘাট অঞ্চল]। পরিশেষে সিলেটের বনাঞ্চলে চা-আবাদ দ্রুত শুরু হয়।
কেন ঔপনিবেশিকরা খুব তাড়াতাড়ি চায়ের সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল?
সংক্ষেপে বললে, প্রধানত চীন তখন একচেটিয়া চা ব্যবসা করতো। ইংরেজ কোম্পানি তখন এই বাজার ধরতে চেষ্টা চালায়। আবার সমকালে নীল বিদ্রোহ শুরু হওয়ায় নীল ব্যবসায় ভাটার টান পড়ে। ফলে চা চাষ ছিল অনেক নিরাপদ ও লাভজনক বাণিজ্য।
১৮৬৬ সালে ইংলন্ডে ৯৬% চা যায় চীন থেকে, সেসময় ভারত থেকে চা যায় মাত্র ৪%। অন্য দিকে ১৮৮৬ সালে ৫৯% চা যায় চীন থেকে; ভারত থেকে যায় ৩৮% [শ্রীলঙ্কা৩%]। ১৯০৩ সালে ১০% চা যায় চীন দেশে থেকে পক্ষান্তওে ভারত থেকে যায় ৫৯% [শ্রীলঙ্কা ৩১%]।
বুঝা যাচ্ছে চায়ের উর্ধ্বমুখি সম্প্রসারণ কী পর্যায়ে গিয়েছিল। পরে চা অন্যন্য দেশে রপ্তানি শুরু হয়। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যদি প্রতিকূল পরিবেশে চা চাষে লাভজনক শিল্পকে দাঁড় করাতে পারলো- তা হলে এখন কেন তার দুরাবস্তা?
কৃষি শিল্পে মজুর উপেক্ষিত থাকলে উৎপাদনে বিঘ্ন ঘটে
মনে রাখা দরকার শিল্প টিকিয়ে রাখা এক বিষয় এবং ব্যবসা এক বিষয়। যদিও দুটোর মধ্যে যোগসূত্র অভিন্ন। ফড়িয়া ব্যবসায়িদের বা কর্পোরেট ব্যবসায় শ্রম বা শ্রমজীবীদের প্রতি দায় কম দেখায়। কৃষি নির্ভর শিল্পে চালিকা শক্তি বা মজুর উপেক্ষিত থাকলে উৎপাদনে গতি বাড়ে না। তাদের জীবন ও জীবিকার বাস্তবতা কথা মাথায় রাখতে হয়।
ঔপনিবেশিক আমলের আইন-কানুন প্যাটার্ন অনেক বদলেছে- একুশের দোয়ার যেমন খোলা- তেমনি দেশের অভ্যন্তরেও চা পানের চাহিদা অনেক অনেক বেড়েছ্। চা ব্যবসায় যে একেবারে লাভ বাড়ছে না এমন কথাও বলা যাবে না। কিন্তু থমকে আছে বা ধীর গতিতে বাড়ছে শ্রমিকদের মজুরি- যা দিয়ে বিশ্বায়নের যুগে পরিবার নিয়ে চলাই দায়।
আসামের জঙ্গল কেটে বাগান আবাদের সময় এই কষ্টসাধ্য শ্রমে দেশীয় শ্রমিকরা কম মজুরিতে আসতে চায়নি। ফলে ধুরন্ধর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভারতের দরিদ্র ও প্রবল দুর্ভিক্ষপীড়িত অলের শকুণি চোখ ফিরায়। নিরন্ন মানুদের লোভ দেখিয়ে ছলে বলে কৌশলে সিলেট-আসামের জঙ্গলে একপ্রকার ‘চিরদাসত্বে’ নিয়ে আসা হয়। এই জন্য সৃষ্টি করা হয় এক শ্রেণির দালাল- যাদের বলা হতো ‘আড়কাঠিয়া’। তারা বিপন্ন লোকদের বলতো আসামের জঙ্গলে টাকার গাছ আছে- গাছে ঝাড়া দিলে পয়সা পড়ে। অর্থাৎ ‘গাছ হেংলানেছে পয়সা মেলেগা’।
আশা নিয়ে আসা চা শ্রমিকদের হতাশার আসাম
আশায় বুক বেঁধে অনিশ্চিত পথে বিহার, রাচী, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ থেকে নানা ভাষাভাষী মানুষ পূর্বা লের পাহাড়ে পথ ধরে। কিন্তু জন্ম মাটিতে ফিরে যাবার কোনো পথ ছিল না। দুর্গম রাস্তায় ‘আড়কাঠিয়া’দের অনুসরণ করে আসার পথে অনেক মানুষ মারা যায় [১৫.১২.১৮৫৯ থেকে ২১. ১১. ১৮৬১ সাল পর্যন্ত আসাম চা কোম্পানি ২,২৭২ জন শ্রমিক সংগ্রহ করতে পেরেছিল- তার মধ্যে রাস্তায় মারা যায় ১১%, রাস্তায় পানিতে পড়ে মারা যায় ৫.২৫%, বিনা চিকিৎসায় মারা যায় একটা বৃহৎ অংশ।
পরে চালু হয় ‘গিরমিটি/‘গিরমিট’ [এগ্রিমেন্ট] প্রথা। এগ্রিমেন্টের কাগজে কী লেখা ছিল তা অশিক্ষিত সাধারণ মানুষ বুঝতে পারেনি [ইংরেজিতে লেখা]। অনেক কষ্টে শ্রীহট্ট-আসামের পাহাড়ের শ্বাপদ সংকুল পরিবেশ দেখে তাদের স্বপ্ন ভেঙে যায়। কিন্তু পালানোর পথ ছিল রুদ্ধ। এমতাবস্থায় জঙ্গলে নানা রোগে, সাপ ও বন্য জীবজন্তুর আক্রমণে কিছু মারা যায়।
এক রিপোর্টে দেখা যায়, ১.৫.১৮৬৩ থেকে ১.৫. ১৮৬৬ পর্যন্ত নিয়োগপ্রাপ্ত শ্রমিক ছিল ৮৪,৯১৫ জনে তার মধ্যে চিকিৎসার অভাবে মারা যায় প্রায় ৩০, ০০০ জন শ্রমিক। বিসি এলেনের রিপোর্টে দেখানো হয় যে, ১৯০৪ সালের রোগে ৭% শ্রমিকের মৃত্যু হয়। ওখানের বাস্তব চিত্র বিহার-উড়িষ্যায় পৌঁছার কোনো সুযোগ ছিল না। তাই বলা যায় চা শ্রমিকের রক্ত ও জীবনের বিনিময়ে উত্তর-পূর্বা লে লাভজনক চা-ব্যবসা শুরু হয়।
চা শ্রমিকদের সাথে চরম অমানবিকতা
ঘন জঙ্গল কাটার কাজে অনভ্যস্ত শ্রমিকদের কাজে বাধ্য করতে চা-কররা নানা আইন কানুন তৈরি করে। শ্রমিকদের কষ্ট ভুলিয়ে রাখার জন্য আসামের চা বাগানগুলোতে মদ-গাঁজার মহোৎসব শুরু হয় [সে সময়ের আসামের চা বাগানে মদের লাইসেন্স প্রদান ও সরবরাহের দিকে লক্ষনীয়।
শ্রমিকদের নির্মম অত্যাচারের বিরুদ্ধে তখন ‘ব্রাহ্ম সমাজ’ প্রতিবাদ করে। চা শ্রমিকদের সাথে স্থানীয়দের যাতে কোনো ধরনের যোগাযোগ না ঘটে সেজন্য নানাবিদ আইন ছিল, চা বাগানে রাজনীতি করা নিষিদ্ধ ছিল। বৃত্তাবদ্ধ থাকার জন্য চা বাগানগুলোতে ‘বাগানী টাকা’র প্রচলন ঘটে। শ্রমিকদের জীবন চলে দুর্বিসহ চক্রে। প্রথম তারা অসহযোগ আন্দোলনের সময় [১৯২১ সাল] সংঘবদ্ধ হয়ে চা বাগান ছেড়ে ‘মুল্লুকে চল’ যাত্রা করে। চাঁদপুরের ঘাটে অনেক শ্রমিকের সলিল সামাধি ঘটে, কারো রক্ত ঝরে। তবু স্বদেশে যাওয়ার সুযোগ পায়নি।
পাকিস্তান আমলে চা শ্রমিকদের হালচাল
চা শ্রমিকরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় পাকিস্তান আমলে। চা বাগানে বহিরাগত শ্রমিককে সচেতনভাবে প্রবেশ করানো হয়। পাকিস্তানী প্রশাসন যন্ত্রের কাছে ‘চা শ্রমিক’রা ক্রমে ‘বহিরাগত’ ‘হিন্দু’তে পরিণত হয়। তখন কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির চা শ্রমিকদের মুক্তির জন্য কাজ করার চেষ্টা চালায়।
চা শিল্পে পুরাতন মালিকদের পরিবর্তে নতুন-নতুন মালিকদের আগমন ঘটে। কিন্তু শ্রমিকদের জীবন-মান গোলক ধাঁধাঁয় থেকে যায়। ১৯৫৪ সালের ‘যুক্তফ্রন্ট সরকারে’র আগ পর্যন্ত পালিকপক্ষ, ট্রেড ইউনিয়ন, প্রতিনিধিত্বশীল সংগঠন চা শ্রমিক ইউনিয়ন এবং সরকারে পক্ষের মধ্যে কোনো সুসংগঠিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। চলবে...
দীপংকর মোহান্ত, শিক্ষক, লেখক ও সাংবাদিক
- খোলা জানালা বিভাগে প্রকাশিত লেখার বিষয়, মতামত, মন্তব্য লেখকের একান্ত নিজস্ব। eyenews.news-এর সম্পাদকীয় নীতির সঙ্গে যার মিল আছে এমন সিদ্ধান্তে আসার কোন যৌক্তিকতা সর্বক্ষেত্রে নেই। লেখকের মতামত, বক্তব্যের বিষয়বস্তু বা এর যথার্থতা নিয়ে eyenews.news আইনগত বা অন্য কোনো ধরনের কোনো দায় গ্রহণ করে না।
আইনিউজে আরও পড়ুন-
- মৌলভীবাজারে বঙ্গবন্ধু : খুঁজে পাই পিতার পদচিহ্ন (ভিডিও)
- দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: ইতিহাসে ভিন্নরকম এক সঙ্গীতায়োজন
- এ পি জে আব্দুল কালাম: ‘দ্য মিসাইল ম্যান অফ ইন্ডিয়া’
বিশ্বের মজার মজার গল্প আর তথ্য সম্বলিত আইনিউজের ফিচার পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি
দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS
হানিফ সংকেত যেভাবে কিংবদন্তি উপস্থাপক হলেন | Biography | hanif sanket life documentary | EYE NEWS
আশ্চর্য এন্টার্কটিকা মহাদেশের অজানা তথ্য | Antarctica continent countries | facts। Eye News
- বাংলাদেশে শিশু শ্রম: কারণ ও করণীয়
- ২০২৩ সালে কী সত্যিই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ আসছে?
- পনেরো আগস্ট পরবর্তী রাজনৈতিক দ্বন্ধ
মোশতাক বললেও মন্ত্রীদের কেউ সেদিন বঙ্গবন্ধুর লাশের সঙ্গে যায়নি! - করোনা যেভাবে চিকিৎসকদের শ্রেণীচ্যুত করলো
- চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সমস্যা এবং সম্ভাবনা
- ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের কুকুর স্থানান্তরকরণ ও ভবিষ্যৎ
- শরীফার গল্প পড়তে আমাদের এতো কেন সমস্যা?
- ফিলিস্তিনে প্রাণ হারাচ্ছেন গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্বরা
- মহান মুক্তিযুদ্ধে বিদেশী গণমাধ্যমের ভূমিকা
- রেমডেসিভির একটি অপ্রমাণিত ট্রায়াল ড্রাগ