Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, মঙ্গলবার   ০৮ এপ্রিল ২০২৫,   চৈত্র ২৫ ১৪৩১

কমলগঞ্জ (মৌলভীবাজার) প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ১২:৪৯, ২২ আগস্ট ২০২২
আপডেট: ১৮:১২, ২২ আগস্ট ২০২২

চা-বাগান যেভাবে জীবন মিশে আছে পাতার রঙে

চা-পাতা উত্তোলন করছেন এক চা শ্রমিক। - ছবি : আইনিউজ

চা-পাতা উত্তোলন করছেন এক চা শ্রমিক। - ছবি : আইনিউজ

“দুটি পাতা একটি কুঁড়ি” খ্যাত চায়ের দেশে তখন সন্ধ্যা নামছে। কিন্তু এই সময়টিতে আকাশ অন্ধকার হয়ে এসেছিল ছাইকালো মেঘে। বিজলি ও মেঘের ডাক সমানে চলেছে। ঝড়ো হাওয়া সাথে করে হঠাৎ ঝেঁপে বৃষ্টিও নেমেছে। মেঘ-বৃষ্টি যাই থাক, অন্যদিন হলে চা-বাগানে এই মুহ‚র্তটিতে দেখা যেত সারা দিনের কাজ শেষে দল বেঁধে ক্লান্ত-শ্রান্ত নারী চা-শ্রমিকরা ধীরপায়ে ঘরে ফিরছেন।

কিন্তু গত শুক্রবার (১৯ আগস্ট) মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ উপজেলার দেওড়াছড়া চা-বাগানের এই সন্ধ্যাটি অন্য চেনা কর্মদিবসের মতো ছিল না। ওই দিন চা-বাগানে ছুটি না থাকলেও সন্ধ্যাটি ছিল ছুটির আমেজে। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে চা-বাগানসমূহে চা-শ্রমিকদের লাগাতার কর্মবিরতি চলছে। নারী শ্রমিকরা এসময় ঘরেই ছিলেন।

দেওরাছড়া চা-বাগানের মধ্য বাবল বিল এলাকার একটি দোকানে বসে কয়েকজন পুরুষ শ্রমিক নিজেদের ভেতর কথা বলছিলেন। অচেনা আগন্তুক দেখে শুরুতে কথা বলতে কিছুটা দ্বিধা-দ্বন্ধেই ছিলেন তাঁরা। কিন্তু দ্বিধার ভয় সরে গেলে কমবেশি মুখর হয়ে ওঠেন সবাই। সারা দেশের ১৬৭টি চা-বাগানে ৩০০ টাকা মজুরির দাবিতে লাগাতার কর্মবিরতিতে রুটি-রুজির পথ থমকে আছে ১ লাখ ৩ হাজার নিবন্ধিত এবং ৩৫ হাজার অনিবন্ধিত শ্রমিকের। চরম অভাব-অনটন চলছে। তা সত্বেও কর্মবিরতিতে কেন সবাই অনড়।

সবুজ পাতার রঙে কিরকম জীবন, জীবনের বঞ্চনা আর কষ্টসমূহ মিশে আছে, কথায় কথায় তাই যেন তুলে ধরতে থাকেন সকলে। চা-শ্রমিক সুচিত্র বলেন, ‘পরিবারে বাবা-মা আছে। দুই বাচ্চা আছে। ছয়জনের একটা পরিবারে ১২০ টাকায় কেমনে পোষায়। ঠিক করে ডাইল-ভাতও খাওয়া যায় না। বাইচ্চা একটা পড়ানো যায় না। ধর্মঘট চললে কষ্ট অইবো। মজুরি মিলত না। কি করবো, একবেলার খানি দুইবেলায় খাবো।’ মোহন মুন্ডা বলেন, ‘আমরা একবারে চলতে পারি না। মালিকপক্ষ কিছু দিলে দেশে জিনিসপত্রের যে দাম, চলতে পারতাম। এখন তিনবেলা খাইতে পারি না। এক পট চালের ভাতে পাঁচ লিটার পানি দিয়া রাখি।’ তিনিসহ অন্যরা পানি দেওয়ার ব্যাখাও দিলেন, এক পট চাল দিয়ে শুধু ভাত হলে সবার হবে না। তাই পানি দিয়ে পান্তা ভাতের মতো তৈরি করা হয়।

পানিতে ভাতের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর সাথে আলুভর্তা, নয়তো জঙ্গল থেকে কুড়িয়ে আনা কচুশাক, পালই শাক, কচুলতি, পাহাড়ি ডাঁটা রান্না করে খেয়ে দিন কাটছে তাদের। মাধবপুর বাজার এলাকায় সাত-আট বছর ধরে নির্মল গোয়ালার দোকান। তিনি বলেন, ‘ধর্মঘটের পর বেচাবিকি মন্দা। মাইনসের টাকা-পয়সা থাকলে না কিনবো। আমিইবা তাদের কত আর বাকি দিব।

আমারওতো মহাজন বাকি আছে।’ এদিকে চা-বাগানে চায়ের কচি পাতাদের বয়স বাড়ছে। পাতারা লকলক করে আগাছার মতো উপরের দিকে বাড়ছে। এই চা-পাতার সাথেই চার-পাঁচ লাখ চা-জনগোষ্ঠীর জীবন-জীবিকা জড়ানো। চা-পাতার মধ্যেই মিশে আছে জীবনের শ্রম-ঘাম, সাধ-আহলাদ, আকাক্সক্ষা। এখন চা-পাতা তোলার ভরা মৌসুম। একজন চা-শ্রমিককে রোজ ২৩ থেকে ২৪ কেজি পাতার নিরিখ (ওজন) পূরণ করতে হয়। কিন্তু ভরা মৌসুমে একজন চা-শ্রমিক ১১০ কেজি পর্যন্ত পাতা তুলতে পারেন। নিরিখের অতিরিক্ত প্রতি কেজি পাতার মজুরি চার টাকা থেকে সাড়ে চার টাকা।

নির্মল গোয়ালাসহ আরও অনেকে মনে করেন, এখন বাগান বন্ধ থাকায় পাতা তোলা হচ্ছে না। এতে মালিক-শ্রমিক সবার ক্ষতি হচ্ছে। শ্রমিকের বাড়তি আয় হচ্ছে না। অনেকেরই কথা, মালিকপক্ষ যদি দাবিগুলো আগেই মেনে নিত। চুক্তির মেয়াদ শেষ হওয়ার আগেই নতুন চুক্তি সম্পন্ন হতো, তাহলে এই কর্মবিরতি হতো না। কেউই ক্ষতিগ্রস্ত হতো না। শুক্রবার রাতে দেওরাছড়া কারখানা-সংলগ্ন দেওরাছড়া-মোকামবাজার সড়কের পাশে একটি চা-স্টলে বসে রাজকুমার ছত্রী বলেন, ‘বাজারে দেখেন শুধুমাত্র আলুটা একটু কম। আর কোনোটাই ৫০/৬০ টাকার কম না। ১২০ টাকা দিয়া জীবিকা রক্ষার কোনো উপায় নাই। সেদিন তলব (মজুরি) পাওয়ার পর ভাবলাম একটু মাছ কিনি। পারি নাই।

এক হালি ডিম নিছি, তাও ৬০ টাকা। কেউ একটা ডিম খাইতে পারি নাই। সবাই ভাগ করি খাইছি।’ নতুন চুক্তির বিলম্ব প্রসঙ্গে বলেন, ‘মালিকপক্ষ দেরাম-দিচ্ছি বলে নুন-পানি খাওয়াই রাখি দিল। আমরা মরলে কি, বাঁচলেই কি ১২০ টাকা। আমরা কুয়ার পানি খাই। ঘরের অবস্থা নাই। রাইতে ঘরে শুয়ে তারা দেখি। ঘরে মেঘ (বৃষ্টি) পড়ে। বুকের বেদনা, কোমরের বেদনা, ঠ্যাংয়ের বেদনা হলেও প্যারাসিটামল দিয়া বলে এইটা খাও। এখনও ব্রিটিশ শাসনে চা-বাগান চলে।’ সুদাম তেলাঙ্গার কথা, কেউ যদি নিজে মোরগ-ছাগল পালে, তাহলে মাংস খেতে পারে। কিনে খাওয়ার উপায় কারো নেই। এরকম কষ্ট-বেদনার কথা প্রায় সকলেরই মুখে-মুখে। চা-শ্রমিক ইব্রাহীম মিয়া বলেন, ‘একেকজন শ্রমিক চার-পাঁচ হাজার টাকা করে বাকি খাইতেছে।

এনজিও থেকে কিস্তি তুলে দোকানের ঋণ দেয়। অনেকে কিস্তি নিয়া খুব চাপের মধ্যে আছে।’ চা-স্টলে বসেই আলাপ হয় বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন দেওরাছড়া চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটির সভাপতি সুবোধ কৈরীর সাথে। সবার সাথে তিনিও চা-শ্রমিকদের জীবন, সংকট, বঞ্চনার নানা দিক তুলে ধরেন। সবার কথাতেই তখন কষ্ট, বেদনার হতাশা, বঞ্চনার ক্ষোভ। তাঁরা এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তির নিঃশ্বাস খোঁজছেন। সুবোধ কৈরী বলেন, ‘মালিকরা শিক্ষিত। আমরা মনে করছি তারা মানবিক হবেন। কিন্তু তারা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলে আমাদের ঠকাইছে। আমাদের মা-বাপরে ঠকাইছে। যদি মালিকরা সময় মতো চুক্তিটা করতো।

শ্রমিকরা মজুরিটা পেলে অন্য কাজে টাকাটা লাগাইতে পারতো। তারপরও নিয়মিত (নিবন্ধিত) শ্রমিকরা না হয় মুজুরি বাড়ার বকেয়া টাকাটা পাইবো। অনিয়মিত শ্রমিকরা কিন্তু বকেয়া টাকা পায় না। এরাতো পুরাই ঠকলো।’ তিনি বলেন, ‘শ্রমিক বাঁচলে বাগান বাঁচবো। আমরাতো বাগান বন্ধ করতে চাই না। বাগান বন্ধ করলে সবারই লস।’ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রথা অনুযায়ী প্রতি দুবছর পরপর চা-বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা-সংসদ এবং বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের মধ্যে দ্বি-পাক্ষিক আলোচনা হয়।

দর-কষাকষি করে চা-শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু প্রায় প্রতিবারই চুক্তির মেয়াদের অনেক পরে নতুন চুক্তি করা হয়ে থাকে। এবারও মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। ১৯ মাসেও মজুরির সমাধান হয়নি। চা-শ্রমিক ইউনিয়ন দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকার দাবি করেছে। মালিকপক্ষ তা না মানায় ৯ আগস্ট থেকে চা-শ্রমিকরা কর্মবিরতির আন্দোলনে আছেন।

এদিকে শনিবার (২০ আগস্ট) সরকারপক্ষ থেকে এক বৈঠক শেষে ১৪৫ টাকা মজুরির সিদ্ধান্ত জানানো হয়েছিল। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা বৈঠকে সিদ্ধান্ত মেনে ধর্মঘট প্রত্যাহারের ঘোষণাও দেন। কিন্তু চা - শ্রমিক ইউনিয়নের বিভিন্ন ভ্যালি (কয়েকটি বাগান নিয়ে একটি ভ্যালি) কমিটি, চা-বাগান পঞ্চায়েত কমিটিসহ সাধারণ শ্রমিক এই মজুরি প্রত্যাখ্যান করে ধর্মঘট অব্যাহত রাখার ঘোষণা দিয়েছেন।

আইনিউজ/প্রনীত রঞ্জন দেবনাথ/এসকেএস

দেখুন আইনিউজের ভিডিও গ্যালারি

চা শ্রমিক মা কিভাবে ছেলেকে পড়ালেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে, শুনুন সেই সংগ্রামের গল্প || Eye News

দিনমজুর বাবার ছেলে মাহির বুয়েটে পড়ার সুযোগ || BUET success story of Mahfujur Rhaman || EYE NEWS

নৌযান বানিয়ে এলাকায় আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন ছোট কিশোর হাকিমুল || Eye News || Moulvibazar || Bout

সিরিজ বোমা হামলা দিবসে মৌলভীবাজারে আওয়ামী লীগের বিক্ষোভ মিছিল || Eye News || Awami League || Moulvibazar

মৌলভীবাজারে জাতির পিতার পদচিহ্ন নিয়ে ‘খুঁজে ফিরি পিতার পদচিহ্ন’

বিস্ময় ছোট বালিকা দেয়ালিকা চৌধুরী বলতে পারে ১৯৫ দেশের রাজধানীর নাম | Deyalika | Eye News

Green Tea
সিলেট বিভাগের সর্বাধিক পঠিত
সর্বশেষ
জনপ্রিয়