শ্যামলাল গোসাঁই
মহিউদ্দিন মোহাম্মদ: অবসরে নয়, অবশ্য পাঠ্য বইয়ের লেখক
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের আলোচিত বই দার্শনিক রচনাবলী-১।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের দার্শনিক রচনাবলী-১ বইটি গতকালই হাতে এসেছে। অফিস শেষ করে বাসায় গিয়ে পরদিন আবার অফিসে আসতে আসতে বইটি তিনবার পড়েছি। অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আবার পড়ছি। আমার মনে হচ্ছে অনেকদিন পর এমন কার্যকরী বই পড়ছি। এবং বার বার পড়ি। আমার ছোটভাই ক্লাস সেভেনে পড়ে। ওকে ডেকে গরুর ব্যাপারে চমকপ্রদ তথ্যগুলো শুনিয়েছি। ও বুঝুক না বুঝুক আমি শান্তি পেয়েছি। যার সাথে দেখা হচ্ছে তাঁর সাথেই আলাপ করছি- 'ভাই বইটা কিনেন, পড়ে দেখেন। আমার না আপনারই লাভ হবে।'
আজকে আবার তাঁর আরেকটা বই হাতে এসেছে [ মূর্তিভাঙ্গা প্রকল্প ]। এ বইটাও পড়তে শুরু করেছি। পড়ছি আর হালকা বোধ করছি। এই হালকা ভাব একারণে নয় যে বইটি আমার দুঃখী ভাব দূর করছে। এ বইয়ের লক্ষ্য আপনাকে সুখী বা দুখী করা নয়। আসলে হালকা লাগছে কারণ, এ বইগুলো পড়ে আগের পড়া, জানা অনেক অহেতুক বিষয়াদিকে মন বাতিল করে দিচ্ছে বলে। কেননা, সেগুলো ছিল অস্পষ্ট, দ্বিধাপূর্ণ আর উদ্দেশ্যহীন।
বাঙালী সমাজে বই পড়া নিয়ে একটি বিভ্রান্তির ধারা অনেকদিন ধরে চলে আসছে। এখানকার পাঠকসমাজ এমনকি প্রায় শিক্ষিত সমাজও মনে করেন- সাহিত্যের বই অবসরে সময়ে পাঠের বিষয়। অর্থাৎ, সাংসারিক কাজ-কর্মের ভীড়ে মানুষ যখন একটু অবসরে গা এলিয়ে বসবেন, তখন কোলের উপর নিয়ে বসবেন সাহিত্যের বই। কিন্তু, মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বই পড়লে দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা এই বিভ্রান্তির ধারা যে অন্যায্য সেটা উপলব্ধি করা যায়। অর্থাৎ, মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইগুলো পড়তে শুরু করলে এগুলোকে আর অবসরে পাঠ্য বইয়ের কাতারে ফেলা যায় না। বরং, আদর্শ পাঠকমাত্রই বলে উঠবেন- এ বইগুলো তো অবশ্যপাঠ্য! কেন, কীভাবে এ উত্তর পরে দেব। আগে বাঙালী পাঠক সমাজের দীর্ঘদিনের এই ভ্রান্তিকর সাহিত্য দর্শনের নেপথ্যের কারণ বলা দরকার মনে করি। এতে কেউ ক্ষুব্ধ হবেন, কেউ কিঞ্চিৎ উচ্ছ্বসিত হবেন। কিন্তু, কাউকে ক্ষুব্ধ বা উচ্ছ্বসিত করার চাইতে পাঠককে জানানো দরকার বলে লিখছি।
মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইগুলো সাহিত্যের নামে বাঙালী পাঠক সমাজে 'অবসরে বই পড়া'র ভাবনায় পরিবর্তনের হাওয়া লাগিয়েছেন। যে হাওয়ায় কর্পুরের মত উড়ে যাচ্ছে সস্তা, মোটা মোটা মলাটের অনেক বই। কেননা, তিনি লিখছেন এমনকিছু, যা অবশ্য পাঠ্য; অবসরে পাঠের নয়। তাঁর বই দার্শনিক রচনাবলী-১, আধুনিক গরু রচনা সমগ্র, মূর্তিভাঙা প্রকল্প কিংবা টয়োটা করোলা। প্রতিটি বই আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে এমন কিছু বিষয়ের সম্মুখে যা আমাদের আরও আগে প্রয়োজন ছিল। এ বইগুলো নিয়ে লুকোচুরি করতে হয় না। অনায়াসে আপনার, আমার সন্তানদের হাতে, শিক্ষার্থীদের হাতে তোলে দেওয়ার মত বই এগুলো।
এই যে বাঙালীরা এখনো মনে করেন, সাহিত্যের বই একান্তই অবসরে পাঠের বিষয়। সংসারের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদির সাথে সাহিত্যকে মেশানো ঠিক না; আমি এই ভাবনার একেবারেই বিরুদ্ধ মতের। এটা বলতে আলাদা কোনো সাহসের প্রয়োজন নেই। সৎ পাঠক হলেই চলবে। কথা হচ্ছে, কেন এ দেশের পাঠকের কাছে 'সাহিত্য অবসরের বিষয়' হয়ে উঠল? এর একেবারে সহজ কিন্তু অপছন্দনীয় উত্তর হচ্ছে- এ দেশের বেশিরভাগ সাহিত্যিকদের রচিত অবসরে পড়বার মত গল্প-উপন্যাস বা বইগুলো। হুমায়ুন আহমেদের 'হিমু-রুপা' সিরিজ কোনো অভিভাবকই চাইবে না তাঁর সন্তান সারাদিন পড়ুক। ইমদাদুল হক মিলনের 'প্রিয়দর্শিনী' কোনো মাধ্যমিকে পড়ুয়া ছাত্র-ছাত্রীর হাতে চলে যাক তা শিক্ষক-অভিভাবক কেউই চান না। না চাইবারই কথা। এগুলো আমাদেরকে আনন্দ দেবে, পুলকিত করবে, মিসির আলী থ্রিলিং ফিল দেবে। কিন্তু, বই পড়া শেষ হলে পরে 'আমি শিখলাম/জানলাম' বলার মতো অল্প জিনিসই থাকে। যেখানে আবার আমরা বলি যে সাহিত্য মানুষের জীবনের প্রতিচ্ছবি। বিপরীতে আপনি যদি মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইগুলো পড়েন; সহসাই আপনার মনে হবে, এ বইটা তো আমাদের শিক্ষার্থীদেরও পড়তে দেওয়া উচিত। জীবনকে জানার এক অন্য মাত্রায় নিয়ে যায় তাঁর বই। পার্থক্যটা বুঝতে পারছেন? আমার বিশ্বাস সাহিত্য রচনার এই পার্থক্যই বাঙালী সমাজে সাহিত্যকে অবসরে পাঠের বিষয়ে পরিণত করেছে। অর্থাৎ, আমাদের পূর্বজ সাহিত্যিকরা জীবনের বেশিরভাগ সময়ই তাঁদের মেধা ব্যয় করেছেন এমন সব উপন্যাস, গল্প, লেখা লিখে যাকে আমাদের পাঠকরাই অবশ্য পাঠ্য মনে করেন না। তাঁরা মনে করেন, এটি অবসরে পাঠের বই।
সাহিত্য অবসরে পাঠের বিষয় এই ধারণা সম্ভবত আমাদের দেশেই এতো বিস্তৃত আকার ধরেছে। এর দায় আমাদের সাহিত্যিকদেরই। মহিউদ্দিন মোহাম্মদের বইগুলো সাহিত্যের নামে বাঙালী পাঠক সমাজে 'অবসরে বই পড়া'র ভাবনায় পরিবর্তনের হাওয়া লাগিয়েছেন। যে হাওয়ায় কর্পুরের মত উড়ে যাচ্ছে সস্তা, মোটা মোটা মলাটের অনেক বই। কেননা, তিনি লিখছেন এমনকিছু, যা অবশ্য পাঠ্য; অবসরে পাঠের নয়। তাঁর বই দার্শনিক রচনাবলী-১, আধুনিক গরু রচনা সমগ্র, মূর্তিভাঙা প্রকল্প কিংবা টয়োটা করোলা। প্রতিটি বই আমাদেরকে দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে এমন কিছু বিষয়ের সম্মুখে যা আমাদের আরও আগে প্রয়োজন ছিল। এ বইগুলো নিয়ে লুকোচুরি করতে হয় না। অনায়াসে আপনার, আমার সন্তানদের হাতে, শিক্ষার্থীদের হাতে তোলে দেওয়ার মত বই এগুলো। কেননা, এই বইগুলোতে হিমু-রুপার সেই মোহনীয় প্রেমের গল্প নেই, প্রিয়দর্শিনীর কাম জাগানো ডায়ালগ নেই। আছে গরুকে গরু হিসেবে চেনার পন্থা, জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা এবং সম্ভাবনা সম্পর্কে তত্ত্বজ্ঞান। আছে আহরিত সাবেক জ্ঞানকে শান দিয়ে নতুন করার দিশা।
আমাদের আগের লেখকরা, সাহিত্যিকরা (একেবারে সবাই নয়, প্রায় সবাই) আমাদেরকে যে ঘুমের দেশে 'সাহিত্যিক ঘুমের বড়ি' খাইয়ে বইয়ের বিছানায় শায়িত করে রেখেছিলেন মহিউদ্দিন মোহাম্মদ সেই ঘুম ভাঙাচ্ছেন। এই ঘুম ভাঙা প্রয়োজন। প্রেম করবার আগে প্রেমের গঠন-ক্রিয়া জানা প্রয়োজন। মহিউদ্দিন মোহাম্মদ আমাদেরকে সেই গঠন, ক্রিয়াদির সাথে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন এই সময়ে দাঁড়িয়ে। এটি আমাদের তরুণ পাঠকদের জন্য, শিক্ষার্থীদের জন্য সৌভাগ্যের।
লেখক- শ্যামলাল গোসাঁই, কবি ও সংস্কৃতিকর্মী
- কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ: বাঙলা ভাষার প্রথম বই
- জীবনানন্দ দাশের কবিতা: বৃক্ষ-পুষ্প-গুল্ম-লতা (শেষ পর্ব)
- জীবনানন্দ দাশের কবিতার পাখিরা
- দুঃখের নাগর কবি হেলাল হাফিজ
- সমরেশ মজুমদার এবং ২টি কবিতা
- মাকে নিয়ে লিখা বিখ্যাত পঞ্চকবির কবিতা
- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ৯ দিনব্যাপী অমর একুশের অনুষ্ঠানমালা
- হ্যারিসন রোডের আলো আঁধারি
- পিকলু প্রিয়’র ‘কবিতা যোনি’
- গল্পে গল্পে মহাকাশ
মেজোমামা খুব বোকা