Bilas Moulvibazar, Bilas

ঢাকা, বৃহস্পতিবার   ১৭ এপ্রিল ২০২৫,   বৈশাখ ৩ ১৪৩২

প্রকাশিত: ১৮:৫১, ২১ মে ২০২৪

ইরানের প্রেসিডেন্ট | ইবরাহিম রাইসি | জীবন ও ইতিহাস

সদ্য প্রয়াত ইরানের প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসি।

সদ্য প্রয়াত ইরানের প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসি।

ইবরাহিম রাইসি, বিশ্ব মুসলিমের কাছে বর্তমান সময়ে এক বেদনাবিদুর নাম। ইরানের শীর্ষ এই নেতা সম্প্রতি হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় চার সঙ্গীসহ প্রাণ হারিয়েছেন। ধারণা করা হয়, ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনির পর ইরানের প্রেসিডেন্ট ইবরাহিম রাইসি হতেন তাঁর উত্তরসূরী। অনেকে খামেনির যোগ্য উত্তরসুরী হিসেবেই মান্য করতে ইবরাহিম রাইসিকে। 

ইবরাহিম রাইসি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারানোর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা শোকবার্তা জানিয়েছেন। রাশিয়া, চীন, বাংলাদেশসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশেও চলছে ইবরাহিম রাইসি মারা যাওয়ার মাতম। ইরানের নতুন প্রেসিডেন্টও নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মুসলিমদের কাছে রাইসি পশ্চিমা পরাশক্তির বিরুদ্ধে এক বলিষ্ঠ কণ্ঠস্বর। তিনি কট্টরপন্থী নেতা হিসেবে পরিচিত। ২০২১ সালে দ্বিতীয় দফায় নির্বাচন করে ইরানের অষ্টম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ইব্রাহিম রাইসি। ইব্রাহিম রাইসি ২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার জন্য ছয়টি প্রধান শক্তির সঙ্গে স্থগিত আলোচনায় দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন। 

ইরানের গুরুত্বপূর্ণ এই নেতার মৃত্যুতে মুসলিমরা শোকাহত। ইবরাহিম রাইসি ১৯৬০ সালে উত্তর-পূর্ব ইরানের শহর মাশহাদে জন্মগ্রহণ করেন। মেধার কারণে মাত্র ২০ বছর বয়সে তিনি তেহরানের পার্শ্ববর্তী শহর কারাজের প্রসিকিউটর-জেনারেল নিযুক্ত হন।

১৯৮৯ থাকে ১৯৯৪ সাল পর্যন্ত রাইসি তেহরানের প্রসিকিউটর-জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৪ সাল থেকে তিনি এক দশক জুডিশিয়াল অথোরিটির উপপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। ২০১৯ সালে তাকে বিচার বিভাগের প্রধান নিযুক্ত করেন দেশটির সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ খামেনি। অর্থাৎ, খুব অল্প সময়েই ইরানের উচ্চপদস্থ পদ-পদবী লাভ করেছিলেন ইবরাহিম রাইসি। যা তাঁকে কট্টরপন্থী মুসলমানরা সামনে আইডলিকভাবে গ্রহণ করেছেন। 

ইবরাহিম রাইসিকে দীর্ঘদিন ধরেই ইরানের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির স্বাভাবিক উত্তরসূরি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি ইরানের ক্রমবর্ধমান উন্নত পারমাণবিক কর্মসূচিতে শুধুমাত্র ন্যূনতম নিষেধাজ্ঞার বিনিময়ে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা থেকে উল্লেখযোগ্য ত্রাণ নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়েছিলেন। 

২০১৮ সালে তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ছয় বড় শক্তির সঙ্গে তেহরান যে পারমাণবিক চুক্তিতে সম্মত হয়েছিল তা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে নেয় এবং ইরানের ওপর কঠোর মার্কিন নিষেধাজ্ঞা পুনরায় আরোপ করে। জবাবে তেহরান ধীরে ধীরে চুক্তির পারমাণবিক বিধিনিষেধ লঙ্ঘন করতে শুরু করে। এসবকিছুতে ইবরাহিম রাইসিও অংশগ্রহণ করেছেন। যেকারণে, ইরানের বর্তমান রাজনীতিতে ইবরাহিম রাইসি ছিলেন একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। 

যদিও ইবরাহিম রাইসির মৃত্যুর পর নতুন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করতে খুব বেশি সময় নেয়নি ইরান। ভাইস প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মোখবার দেজফুলিকে বর্তমানে প্রেসিডেন্ট পদে স্থলাভিষিক্ত করা হয়েছে। সেইসঙ্গে ইরানের জনগণকে রাইসির মৃত্যুতে উদ্বিগ্ন না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে ইরানি সরকার। বর্তমানে প্রেসিডেন্ট হিসাবে নির্বাচিত মোখবারও ইবরাহিম রাইসির বেশ কাছের মানুষ ছিলেন বলে জানিয়েছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম।

ইবরাহিম রাইসি ইরানের বর্তমান প্রজন্মের নারী ও তরুণদের কাছে বিতর্কিত তাঁর হিজাব এবং সতীত্ব নিয়ে কঠোর আইনবিধির কারণে। রাইসির নির্বাচনের এক বছর পর ইরানে হিজাব এবং সতীত্ব আইনের প্রয়োগকে কঠোর করা হয়। এর কয়েক সপ্তাহের মধ্যে সেই আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে নৈতিকতা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর মাহসা আমিনি নামে এক তরুণ কুর্দি ইরানি মহিলা হেফাজতে থাকা অবস্থায় মারা যান। এর প্রতিবাদে দেশব্যাপী বিক্ষোভের ফলশ্রুতিতে বিক্ষোভকারীদের ওপর নিরাপত্তাকর্মীদের হামলায় প্রায় ৫০০ জন নিহত হয়। এ সময় দেশব্যাপী আটক করা হয় ২২ হাজার মানুষকে। তবে নিজের এ কঠোর রাজনৈতিক অবস্থানের কারণে সমালোচনার মুখে পড়লেও ইরানের কট্টরপন্থীদের কাছে রক্ষণশীল প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেশ জনপ্রিয় ছিলেন ইব্রাহিম রাইসি। 

ইরাকের প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেনের সঙ্গে যুদ্ধের সময়টিও ইবরাহিম রাইসির রাজনৈতিক জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ২০২১ সালের নির্বাচনের পর এক সংবাদ সম্মেলনে তাকে ১৯৮৮ সালের মৃত্যুদণ্ডগুলো নিয়ে প্রশ্ন করা হলে রাইসি এ নিয়ে কোনো অনুশোচনা প্রকাশ করেননি। ইরান এবং সাদ্দাম হোসেনের ইরাকের মধ্যে ১০ বছর ব্যাপী রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর ১৯৮৮ সালে রাজনৈতিক বন্দী, জঙ্গি এবং অন্যান্যদের ভুয়া বিচার অনুষ্ঠিত হয়, যেগুলো ‘মৃত্যু কমিশন’ নামে পরিচিতি পায়।

ইরানের তৎকালীন সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহোল্লাহ খোমেনি জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে রাজি হবার পর, ইরানের সশস্ত্র বিরোধী গোষ্ঠী মুজাহিদিন-এ-খালক ইরাক থেকে ইরানে হামলা চালায়। তারা সাদ্দাম হোসেনের দেয়া ভারি অস্ত্রে সজ্জিত ছিল, কিন্তু ইরান তাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়।

ঐ সময়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। বন্দীদের প্রথমে নিজেদের পরিচিতি দিতে বলা হয়। যারা নিজেদের ‘মুজাহিদিন’ বলে পরিচয় দেয়, তাদের মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। মানবাধিকার গোষ্ঠী অ্যামনেসটির ১৯৯০ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী, অন্যান্যদের জিজ্ঞেস করা হয়, তারা “ইসলামী প্রজাতন্ত্রের সেনাবাহিনীর জন্য ভূমি থেকে মাইন সরানোর কাজ করতে রাজি কি না।”

আন্তর্জাতিক অধিকার গোষ্ঠীগুলোর হিসেব মতে, প্রায় ৫,০০০ মানুষের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছিল। রাইসির বয়স তখন ২৮, এবং তিনি কমিশনগুলোতে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।

যুক্তরাষ্ট্রের ট্রেজারি বিভাগ ২০১৯ সালে রাইসির উপর নিষেধাজ্ঞা জারী করে, যেখানে ১৯৮৮ সালের কথা উল্লেখ করা হয়। নিষেধাজ্ঞার কারণ হিসেবে বলা হয়, রাইসি এমন অপরাধীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার প্রক্রিয়ায় প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেছেন, যারা ‘অপরাধ সংঘটনের সময় অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছিল।’

ইরানের রাজনীতিকে ইবরাহিম রাইসি নানান সময় নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন। তিনি তরুণ বয়স থেকেই ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সব জায়গাগুলোতে কাজ করার, অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ করে দিয়েছিল। যার ফলে একজন বিচারক থেকে ইবরাহিম রাইসি হয়ে ওঠেছিলেন ইরানের কট্টরপন্থী মুসলমানদের আদর্শিক প্রতিমূর্তি। ইবরাহিম রাইসির মৃত্যুতে বাংলাদেশের ইরানপন্থী মুসলমানরাও তীব্র শোক জানিয়েছেন। কেননা, পশ্চিমা বিশ্বের সঙ্গে মুসলমানদের দ্বৈরত যুদ্ধে ইবরাহিম রাইসিকে অনেকে পথপ্রদর্শক হিসেবে মানেন। 

ইবরাহিম রাইসির মৃত্যু হয়েছে দুর্ঘটনায় পড়ে। তিনিসহ তাঁর ৪ সঙ্গী আজারবাইজানে একটি বাঁধ প্রকল্প উদ্বোধনের অনুষ্ঠান থেকে ফেরার সময় পাহাড়ি দুর্গম অঞ্চলে হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে প্রাণ হারান। যে কোনো পরিস্থিতিতে মাথা ঠাণ্ডা করে কাজ করার সুনাম ছিল তার।

আই নিউজ/এইচএ 

Green Tea
সর্বশেষ
জনপ্রিয়